মূল্যস্ফীতি-অর্থনীতিতে অনর্থ ঘটার আগে by ফারুক মঈনউদ্দীন
দেশে বর্তমানে বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থায় মূল্যস্ফীতি অথবা মুদ্রাস্ফীতি, সামষ্টিক অর্থনীতির মারপ্যাঁচে যা-ই বলা হোক না কেন, ভোগাচ্ছে সাধারণ সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি এখন আর নতুন বিষয় নয়, মানুষ পত্রপত্রিকায় যেমন পড়ছে, তেমনি টের পাচ্ছে বাজারে গেলে।
আপাতদৃষ্টিতে মানুষের গড় আয়স্তর ওপরে উঠে এলেও মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় নেমে গেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতির হার ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে আগস্ট মাসেই। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে মৌলিক খাদ্যপণ্য তথা চাল, ডাল, নুন, তেল, শাকসবজি ইত্যাদির মূল্যস্ফীতি মানুষকে বিপন্ন করে সবচেয়ে বেশি। কারণ, মানুষের জীবনধারণের প্রধানতম মৌলিক এই উপাদানগুলো সমাজের নিম্নতম স্তরের মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত সবার চাহিদারই প্রথম সারিতে থাকে। তাই এগুলোর চাহিদা অর্থনীতির ভাষায় অস্থিতিস্থাপক (মূল্য যা-ই হোক না কেন চাহিদা থাকবে অপরিবর্তিত), আর সে কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে ভোগায় সবচেয়ে বেশি। মূল্যস্ফীতির একটা সরাসরি অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া থাকে, সেটি হচ্ছে মানুষের দুর্গতি ও দারিদ্র্য। কিন্তু এটির অন্য তথা অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াগুলো আরও বেশি শক্তিশালী। লাগামহীন এবং ক্রমাগত চলতে থাকা মূল্যস্ফীতির ফলে সামাজিক যে অভিঘাত, সেটি সরাসরি লক্ষণীয় না হলেও নীরব প্রতিক্রিয়া হিসেবে যথেষ্ট শক্তিশালী, সেটি এমনকি মূল্যস্ফীতির রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার চেয়েও বেশি শক্তিধর। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জের ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে, বাড়তে পারে রাজনৈতিক অস্থিরতা, এমনকি বড়জোর সরকার পরিবর্তন হতে পারে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু সামাজিক প্রতিক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে নীরবে এবং তার ফলাফল হয় গভীর ও সুদূরপ্রসারী। সুতরাং বিশাল এবং বিশ্বের সবচেয়ে ঘন জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। কারণ এই বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সুলভ খাদ্যই তাদের জীবনসংগ্রামের মূল লক্ষ্য। খাদ্যমূল্যের ওপর নির্ভর করে সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের বাঁচা-মরা, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী জয়-পরাজয়।
আমাদের হাতের কাছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধকরি চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, কারণ সে সময় দুর্ভিক্ষ ঘটার কোনো সংগত কারণ না থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল কেবল যথাযথ বিতরণব্যবস্থা কার্যকর না থাকা এবং অতি মুনাফালোভী খাদ্য ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে। রেহমান সোবহানের ভাষায়, ‘১৯৭৩ সালে ভালো আমন ফসল দ্রব্যমূল্যের চাপ কমাতে পারত এবং বাস্তবিকপক্ষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চালের দাম পড়ে যায়। কিন্তু যা-ই হোক, সংশোধিত রেশন বরাদ্দ যখন পাশাপাশি কমতে থাকে এবং চতুর চাল ব্যবসায়ীরা যখন অনুধাবন করে যে সরকারের স্টকে যথেষ্ট চাল মজুদ নেই তখন থেকেই খোলাবাজারে চালের সরবরাহে ভাটা দেখা দেয়। ফলে ১৯৭৪-এর মার্চ থেকে চালের দাম আবার দ্রুত বাড়তে শুরু করে।’ আর সেই দুর্ভিক্ষের যাবতীয় দায়দায়িত্ব আজ অবধি বহন করে বেড়াতে হচ্ছে তখনকার ক্ষমতাসীন দলটিকে। তাই দুর্ভিক্ষ না হোক, খাদ্য মূল্যস্ফীতির দায়িত্বও বহন করতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে, এমনকি সেটি যদি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে আর যদি তাকে সামাল দিতে ব্যর্থ হয় সরকার। এবং তার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে অর্থনৈতিক তাৎপর্যের চেয়ে অনেক বড়।
তবে খাদ্যমূল্য শুধু আমাদের দেশে যে বেড়েছে তা নয়, সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির নিকটতম প্রতিবেশী দেশটিতেও খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছুঁয়ে গেছে। সেটা নিয়ে কোনো ঢাক ঢাক গুড়গুড় না করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং ভারতীয় অর্থমন্ত্রী। এবারের দুর্গাপূজায় নাকি তিনি বিশেষ প্রার্থনাও করেছেন যাতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকে। চাল-ডাল না হলেও তেল-মসলা ইত্যাদি খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ভারতের অবস্থান আর দশটি আমদানিকারক দেশের মতো। কিন্তু কেবল আমদানিকৃত খাদ্যপণ্য নয়, দেশীয় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও ভারত সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যস্ফীতি বাদ দিলেও, অভ্যন্তরীণ বাজারের মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দেড় বছরে সুদের হার বাড়িয়েছে ১২ বার। কিন্তু তাতে তেমন কোনো ফলোদয় হয়নি। এটি আমাদের সরকারের কোনো আত্মতৃপ্তির বিষয় নয়, বরং বিরোধীদের জন্য ভাবনার বিষয়, কারণ আরও একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মূল্যস্ফীতি যেমন আমাদের মতো দেশগুলোকে ভাবাচ্ছে, তেমনি উন্নত বিশ্বও ভাবিত তাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্বাস্থ্য নিয়ে। এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দেশে-বিদেশে সরকারের ঋণ দেশটির মোট জিডিপির সমান হয়ে গেছে, একসময় হয়তো ছাড়িয়েও যাবে। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা উচিত যে দেশটির মোট জিডিপি হচ্ছে ১৪ লাখ কোটি ডলার এবং সরকারের ঋণও ১৪ লাখ কোটি ডলার।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকারের ঋণ গ্রহণ নিয়ে অর্থনীতিবিদ মহলে যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা খুবই সংগত। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ যে অর্থনীতির জন্য শুভ নয়, সেটাই হচ্ছে উদ্বেগের মূল কারণ। এক হিসাবে জানা যাচ্ছে যে বর্তমান অর্থবছরের তিন মাসের মধ্যেই সরকার আট হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে, যা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি। এই ঋণের প্রায় অর্ধেক বহন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাকি অংশ নেওয়া হয়েছে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর হলেও যে বিষয়টি আমরা বিস্মৃত হই, বিদ্যুৎ উৎপাদনের দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত পন্থা হিসেবে জনপ্রিয় দাবি মেটাতে সরকার যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করেছে সেগুলোর জন্য জ্বালানি তেল আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারের এই দুর্গতি। এটা কেবল সরকারের দুর্গতি হলে না হয় দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখা যেত, কিন্তু সেটা যে সাধারণ মানুষের ওপর এসে পড়েছে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। ব্যাংকিং খাত থেকে কিংবা নতুন ছাপানো ব্যাংক নোট থেকে নেওয়া সরকারের ঋণ অর্থনীতির জন্য কখনোই শুভ ফল বয়ে আনে না। নতুন ছাপানো ব্যাংক নোটই হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে ধ্রুপদি উদাহরণ, কীভাবে অনেক বেশি টাকা খুব কম পণ্যকে ধাওয়া করতে থাকে। আর ব্যাংকিং খাত থেকে গৃহীত ঋণ সংকুচিত করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, যার ফলে বাধাগ্রস্ত হয় প্রবৃদ্ধির হার।
তবে আশার কথা যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের এই ঋণ গ্রহণ নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়, কারণ ঋণের এই পরিমাণ পূর্বানুমিত এবং বর্তমান অর্থবছরের ঋণ লক্ষ্যমাত্রার সীমা লঙ্ঘন করেনি। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়—এই ধারণা সঠিক নয়। সরকারি ঋণ বেসরকারি বিনিয়োগ সংকুচিত করে—এ কথা ঠিক, তবে উভয় ঋণের অর্থনৈতিক ফলাফল একই। সরকারি ঋণের টাকার একটা অংশ অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হয় বলে তা মুদ্রাস্ফীতির আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় এটা যেমন সঠিক, তেমনি এই ঋণের একটা বড় অংশ যায় ভর্তুকিতে, যা বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে, এটাও ঠিক। আমরা আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের ভর্তুকির বিষয়টি থেকেই সরকারি ঋণের ব্যবহার এবং তার অর্থনৈতিক ফলাফলটা বুঝে নিতে পারি। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে যদি তেল-গ্যাস ইত্যাদির ওপর ভর্তুকি আরও কমিয়ে দেওয়া হতো, তার ফলাফল কী হতো, সেটা সহজেই অনুমেয়।
তবে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে খুব বেশি নির্ভার থাকার অবকাশ আমাদের নেই। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখনো পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত স্থিতিতে থাকলেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, অভিবাসী জনসম্পদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রার প্রবাহের প্রবৃদ্ধিহীনতা এবং বাড়তি চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিব্যয় বৃদ্ধি অচিরেই এই স্থিতিকে নিম্নগামী করবে। আর সেটি হবে সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ, যদিও বিদেশি বাণিজ্যে লেনদেনের অনুকূল ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আইএমএফ থেকে সরকার যে ঋণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে, সেটা দিয়ে যা হবে তাকে আমরা কথ্য ভাষায় বলি ঠেকা দেওয়া। এই ঠেকা দিয়ে সংকটকে কত দিন ঠেকানো যাবে, সেটাই ভাবনার বিষয়। দেশে লাগামহীনভাবে বাড়ছে জনসংখ্যা, কার্যকর জন্মশাসনব্যবস্থা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচারণা ও ব্যবস্থা প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। অথচ এটিকে রোধ করা না গেলে সরকারি ব্যয়, ভর্তুকি সবকিছু কেবল বাড়তেই থাকবে।
সুতরাং বহির্বিশ্বের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকারকে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতে হবে, যথার্থ হারে আয়কর এড়িয়ে যাওয়া বিশাল পেশাজীবী গোষ্ঠীকে সঠিক হিসাবে আয়করের আওতায় আনতে হবে, সরকারের অপচয়ী স্বভাব পাল্টাতে হবে, যত বাধাই আসুক অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল পণ্যের আমদানি বন্ধ করতে না পারলেও নিরুৎসাহিত করতে হবে। উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে এই কাজটি করা যায়, এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প অবিলম্বে চালু এবং শুরু করতে হবে, জন্মশাসন বিষয়ে আমাদের একসময়কার প্রশংসনীয় সাফল্য আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এবং আরও অনেক কিছু করতে হবে, যা এই সীমিত পরিসরের নিবন্ধে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়, তবে সরকারের দায়িত্বশীল মহল জানে কী কী করতে হবে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments