সাংবাদিকতা জগতের মহীরুহ by লোটন একরাম

আবদুস সালাম। গণমাধ্যমের প্রবাদপুরুষ। আপন আলোয় উদ্ভাসিত এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের লেখায় প্রকাশ পেত অধিকারবঞ্চিত মানুষের কথা। মাতৃভাষা বাংলা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার লেখনী। অবশ্য এ জন্য তাকে কোপানলে পড়তে হয়েছে। তিনি চাকরি হারিয়েছেন।


কারাবরণ করেছেন। নির্যাতন ও হয়রানি তার পিছু ছাড়েনি। সৎ ও নির্লোভ উপমহাদেশের মহীরুহ সাংবাদিক আবদুস সালামের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
১৯১০ সালে ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুন্সীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবদুস সালাম। ফেনী হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। অতঃপর ভারতের কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। তিনি উত্তীর্ণদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ফেনী কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে আবদুস সালামের কর্মজীবন শুরু। অতঃপর অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন আয়কর বিভাগে। পরে তিনি সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন এবং কলকাতা রেশনিং অফিসে ডিরেক্টর অব অ্যাকাউন্টসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারও পরে তিনি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিসে যোগ দেন। বাঙালি অফিসারদের পীড়নের প্রতিবাদে তিনি ১৯৪৯ সালে চাকরিতে ইস্তফা দেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি পাকিস্তান অবজারভারে যোগ দেন এবং ১৯৫০ সালের ৩ জুন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় পত্রিকাটি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষায় বেশকিছু রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করছিল। বাংলাকে মাতৃভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন সম্পাদক আবদুস সালাম। তিনি এর ফলে তখনকার মুসলিম লীগ সরকার ১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কাগজটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরের দিন সালাম সাহেব গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশিত হয়, আবদুস সালামই এর সম্পাদক থেকে যান। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয়। ফলে তিনি পাকিস্তান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি আইয়ুব সরকার প্রণীত সংবাদপত্রবিরোধী কালাকানুনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্ভীক প্রকৃতির মানুষ। তিনিই প্রথম তদানীন্তন ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রচিত গ্রন্থ 'ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস'-এ বাঙালিদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের সমালোচনা ও নিন্দা করেন। সম্পাদক হিসেবে ব্যস্ত জীবনযাপনের মধ্যেও তার জ্ঞানচর্চা অব্যাহত গতিতে চলত। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি অঙ্গনে তার অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে এক 'গ্রন্থকীট'। উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় কতগুলো সম্পাদকীয় ছাড়াও অবজারভারের পাতায় প্রকাশিত হতো তার কলাম 'আইডেল থটস্' মলোজ নামে। এ কলামটি থেকে তার জ্ঞানচর্চার বহুমুখিতার পরিচয় মেলে।
১৯৭২ সালে দেশে সাংবিধানিক সংকট নিয়ে 'দি সুপ্রিম টেস্ট' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখায় ক্ষুব্ধ হয় তৎকালীন সরকার। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে তার মতবিরোধ হওয়ায় তিনি অবজারভার ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নিযুক্ত হন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক মহীরুহ সম্পাদকের জীবনাবসান হয়। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৭৬ সালে একুশে পদক পান। তিনি বহু দেশ সফর করেন। সাহসী সম্পাদক আবদুস সালাম কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। কোনো লোভ-লালসাই তাকে অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম বন্ধ করতে পারেনি। সারাজীবন সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন তিনি। বিত্তবৈভব নিয়ে কখনও চিন্তা করতেন না সালাম সাহেব। সরকারের কাছ থেকে রাজধানীতে একটি প্লট পেলেও টাকার অভাবে তাতে ভালো করে একটি বাড়ি নির্মাণ করেননি তিনি। এমনকি পৈতৃক জমি বিক্রি করে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে আইন পরিষদের নির্বাচন করে বিজয়ী হন। আজকের প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমিক সাংবাদিক আবদুস সালামের মতো সৎ, সাহসী ও নির্ভীক সাংবাদিকের বড় প্রয়োজন। আমাদের নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা আবদুস সালামের আদর্শ অনুসরণ করলে মহান এই পেশার প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ আরও বাড়বে বলে আশা করছি। একই সঙ্গে গুণী সাংবাদিক আবদুস সালামের স্মৃতিরক্ষায় সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করব।

লোটন একরাম :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.