যুক্তরাষ্ট্র-ইরান-বিশ্বের বিপজ্জনক স্পট হরমুজ প্রণালি by মাইকেল টি. ক্লেয়ার
বিশ্বের উত্তোলন ও ব্যবহারযোগ্য অধিকাংশ তেল মজুদ রয়েছে উপসাগরীয় এলাকাতেই। এ কারণেই উপসাগরীয় এলাকায় কোনো বৈরী শক্তির আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা প্রতিহত করা মার্কিন নীতি। তারা এই এলাকা ও হরমুজ প্রণালিতে আধিপত্য কায়েমের শক্তি অন্য কেউ অর্জন করুক চায় না আকস্মিকভাবে হরমুজ প্রণালি বিশ্বের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ স্পটে পরিণত হয়েছে।
এখানে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্রতিপক্ষ শক্তির মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিস্থিতি কীভাবে এতটা অগি্নগর্ভ হলো?
বিশ্বের জ্বালানি উৎসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পেট্রোলিয়ামের অবস্থান অগ্রগণ্য। আর বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশই এই প্রণালি দিয়ে ট্যাঙ্কারে করে চালান হয়। মার্কিন জ্বালানি দফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে প্রতিদিন গড়ে এই সরু প্রণালি দিয়ে প্রায় ১৭ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়েছে। অন্য কোনো পথ দিয়ে এই পরিমাণ বাড়তি তেল পরিবহন করা সম্ভব নয়। কোনো কারণে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি তেলের ঘাটতি দেখা দেবে। দাম বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে আতঙ্ক ও নৈরাজ্য দেখা দেবে।
এ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যারেলপ্রতি ৫০ ডলার আবার কেউ কেউ একশ' ডলার বৃদ্ধি পেয়ে দুইশ' ডলারে পেঁৗছাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এই প্রণালিতে ইরানের পেতে রাখা মাইনসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সরাতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করছেন; কিন্তু এতে অনিশ্চয়তা সহসা দূর হবে না বিধায় দর বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে বলে মনে করেন অন্য বিশ্লেষকরা। এতে মার্কিন ও ইউরোপীয় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নষ্ট হবে এবং বিশ্ব নতুন করে মহামন্দায় পতিত হবে।
ইরানিরা এ ধরনের সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই পশ্চিমা নেতাদের তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে বিরত রাখতে তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এতে ভীত না হয়ে যে কোনো মূল্যে হরমুজ প্রণালি উন্মুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বিশ্বের উত্তোলন ও ব্যবহারযোগ্য অধিকাংশ তেল মজুদ রয়েছে উপসাগরীয় এলাকাতেই। এ কারণেই উপসাগরীয় এলাকায় কোনো বৈরী শক্তির আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা প্রতিহত করা মার্কিন নীতি। তারা এই এলাকা ও হরমুজ প্রণালিতে আধিপত্য কায়েমের শক্তি অন্য কেউ অর্জন করুক চায় না। ইরানে ইসলামী বিপ্লব ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলার পর ১৯৮০ সালে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রথম প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে মার্কিন নীতি-অবস্থান জানান। তিনি বলেন, 'যে কোনো বাইরের শক্তির উপসাগরীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের ওপর আঘাত বলে বিবেচনা করা হবে।'
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে উপসাগরীয় এলাকার অধিপতি মনে করে। সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জারকে প্রতিহত করার জন্য সামরিক প্রস্তুতিও তাদের থাকে। মার্কিন এই নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য পেন্টাগন মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ড (সেন্টকম) নামে একটি কাঠামোও গড়েছে। সেন্টকম প্রথম ১৯৮৭-৮৮ সালে ইরানের সামরিক বাহিনী কুয়েতি ও সৌদি তেলের ট্যাঙ্কারে হামলা চালিয়ে হরমুজ প্রণালি দিয়ে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যায়। ট্যাঙ্কারগুলোকে রক্ষা করার জন্য প্রেসিডেন্ট রিগ্যান এগুলোতে মার্কিন পতাকা ব্যবহার করতে বলেন। তখন এসব ট্যাঙ্কারকে মার্কিন রণতরী পাহারা দিয়ে ওই প্রণালি অতিক্রম করিয়ে দিত। কিন্তু ২৯০ জন যাত্রী নিয়ে পারস্য উপসাগর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমান মার্কিন নৌবহর থেকে ছোরা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হলে বিয়োগান্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিমানটিকে একটি যুদ্ধবিমান সন্দেহ করে আঘাত হানা হয় বলে দাবি করে। কিন্তু ইরানিদের মন থেকে সে ক্ষত মুছে যায়নি।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় সাদ্দাম কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের ১৯৯০-এর কুয়েত আক্রমণকে উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে হুমকি বলে বিবেচনা করা হয়। তখন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ সৌদি আরবকে রক্ষা ও ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করার জন্য সেন্টকমকে নির্দেশ দেন। আর সাদ্দাম যখন তার বাহিনীকে সুসংগঠিত করার জন্য আবার উদ্যোগ নেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় এলাকায় তার আধিপত্যের প্রতি সাদ্দামের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করে। প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ তখন সেন্টকমকে ইরাক আক্রমণ এবং একই সঙ্গে সাদ্দামকে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন। শীতল যুদ্ধ অবসানের পর এখন একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে তার কর্তৃত্বকে আরও চ্যালেঞ্জবিহীন রাখতে চাইবেই।
উপসাগরে মার্কিন আধিপত্যের প্রতি সম্ভাব্য হুমকি এখন ইরান। শাহের আমলে ইরান যখন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র ছিল, তখনও দেশটি পারস্য উপসাগরে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে গণ্য হতে চেয়েছে। এখন শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইরান তো সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা চাইবেই। ইরাকেও এখন শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত। এভাবে গোটা এলাকায় শিয়া আধিপত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাদ্দামের পরিণতি মূল্যায়ন করে তারা নিজেদের সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য বৃদ্ধি করার কৌশল নিয়েছে।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দু'ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। দেশটির প্রচলিত অস্ত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় একেবার নগণ্য হলেও তার অব্যাহতভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ওই এলাকায় একাধিপত্যের প্রতি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জস্বরূপ। ইরাকে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকায় সেটাও ওই এলাকায় শক্তি ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হবে। তাই ইরানের পারমাণবিক বোমা আছে কি নেই বা সেটা বানাতে তার আরও কতটা সময় লাগতে পারে এর চেয়েও বড় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন ইরান ওই এলাকায় তার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর একমাত্র প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সরকারকেই ইরান নিয়ে ওবসেশনে ভুগতে দেখা গেছে। কীভাবে ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে বিরত রাখা যাবে এ নিয়েই তাদের চিন্তা আবর্তিত হয়েছে। বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কয়েকটি পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত রূপায়িত হতে পারেনি।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ ধরনের হামলা চালানো হলে ইরান মারাত্মক প্রতিশোধমূলক প্রতিহামলা চালাবে এবং এতে বিপদের বেশ ঝুঁকি রয়েছে। তাই তারা ইরানকে কাবু করার জন্য প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ জোরদার করছে।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় একাধিপত্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা এবং ইরানের ওই এলাকায় নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার বিপরীতমুখী চেষ্টার কারণে হরমুজ প্রণালি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্পট। আগামী দিনগুলোতে হরমুজ নিয়ে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি এটি বিশ্বের সম্ভাব্য যুদ্ধের কেন্দ্রেও পরিণত হতে পারে।
মাইকেল টি. ক্লেয়ার :হ্যাম্পশেয়ার কলেজের বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা স্টাডিসের অধ্যাপক
অল্টারনেট থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
বিশ্বের জ্বালানি উৎসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পেট্রোলিয়ামের অবস্থান অগ্রগণ্য। আর বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশই এই প্রণালি দিয়ে ট্যাঙ্কারে করে চালান হয়। মার্কিন জ্বালানি দফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে প্রতিদিন গড়ে এই সরু প্রণালি দিয়ে প্রায় ১৭ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়েছে। অন্য কোনো পথ দিয়ে এই পরিমাণ বাড়তি তেল পরিবহন করা সম্ভব নয়। কোনো কারণে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি তেলের ঘাটতি দেখা দেবে। দাম বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে আতঙ্ক ও নৈরাজ্য দেখা দেবে।
এ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যারেলপ্রতি ৫০ ডলার আবার কেউ কেউ একশ' ডলার বৃদ্ধি পেয়ে দুইশ' ডলারে পেঁৗছাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এই প্রণালিতে ইরানের পেতে রাখা মাইনসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সরাতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করছেন; কিন্তু এতে অনিশ্চয়তা সহসা দূর হবে না বিধায় দর বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে বলে মনে করেন অন্য বিশ্লেষকরা। এতে মার্কিন ও ইউরোপীয় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নষ্ট হবে এবং বিশ্ব নতুন করে মহামন্দায় পতিত হবে।
ইরানিরা এ ধরনের সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই পশ্চিমা নেতাদের তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে বিরত রাখতে তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এতে ভীত না হয়ে যে কোনো মূল্যে হরমুজ প্রণালি উন্মুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বিশ্বের উত্তোলন ও ব্যবহারযোগ্য অধিকাংশ তেল মজুদ রয়েছে উপসাগরীয় এলাকাতেই। এ কারণেই উপসাগরীয় এলাকায় কোনো বৈরী শক্তির আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা প্রতিহত করা মার্কিন নীতি। তারা এই এলাকা ও হরমুজ প্রণালিতে আধিপত্য কায়েমের শক্তি অন্য কেউ অর্জন করুক চায় না। ইরানে ইসলামী বিপ্লব ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলার পর ১৯৮০ সালে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রথম প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে মার্কিন নীতি-অবস্থান জানান। তিনি বলেন, 'যে কোনো বাইরের শক্তির উপসাগরীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের ওপর আঘাত বলে বিবেচনা করা হবে।'
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে উপসাগরীয় এলাকার অধিপতি মনে করে। সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জারকে প্রতিহত করার জন্য সামরিক প্রস্তুতিও তাদের থাকে। মার্কিন এই নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য পেন্টাগন মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ড (সেন্টকম) নামে একটি কাঠামোও গড়েছে। সেন্টকম প্রথম ১৯৮৭-৮৮ সালে ইরানের সামরিক বাহিনী কুয়েতি ও সৌদি তেলের ট্যাঙ্কারে হামলা চালিয়ে হরমুজ প্রণালি দিয়ে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যায়। ট্যাঙ্কারগুলোকে রক্ষা করার জন্য প্রেসিডেন্ট রিগ্যান এগুলোতে মার্কিন পতাকা ব্যবহার করতে বলেন। তখন এসব ট্যাঙ্কারকে মার্কিন রণতরী পাহারা দিয়ে ওই প্রণালি অতিক্রম করিয়ে দিত। কিন্তু ২৯০ জন যাত্রী নিয়ে পারস্য উপসাগর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমান মার্কিন নৌবহর থেকে ছোরা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হলে বিয়োগান্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিমানটিকে একটি যুদ্ধবিমান সন্দেহ করে আঘাত হানা হয় বলে দাবি করে। কিন্তু ইরানিদের মন থেকে সে ক্ষত মুছে যায়নি।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় সাদ্দাম কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের ১৯৯০-এর কুয়েত আক্রমণকে উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে হুমকি বলে বিবেচনা করা হয়। তখন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ সৌদি আরবকে রক্ষা ও ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করার জন্য সেন্টকমকে নির্দেশ দেন। আর সাদ্দাম যখন তার বাহিনীকে সুসংগঠিত করার জন্য আবার উদ্যোগ নেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় এলাকায় তার আধিপত্যের প্রতি সাদ্দামের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করে। প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ তখন সেন্টকমকে ইরাক আক্রমণ এবং একই সঙ্গে সাদ্দামকে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন। শীতল যুদ্ধ অবসানের পর এখন একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে তার কর্তৃত্বকে আরও চ্যালেঞ্জবিহীন রাখতে চাইবেই।
উপসাগরে মার্কিন আধিপত্যের প্রতি সম্ভাব্য হুমকি এখন ইরান। শাহের আমলে ইরান যখন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র ছিল, তখনও দেশটি পারস্য উপসাগরে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে গণ্য হতে চেয়েছে। এখন শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইরান তো সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা চাইবেই। ইরাকেও এখন শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত। এভাবে গোটা এলাকায় শিয়া আধিপত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাদ্দামের পরিণতি মূল্যায়ন করে তারা নিজেদের সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য বৃদ্ধি করার কৌশল নিয়েছে।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দু'ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। দেশটির প্রচলিত অস্ত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় একেবার নগণ্য হলেও তার অব্যাহতভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ওই এলাকায় একাধিপত্যের প্রতি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জস্বরূপ। ইরাকে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকায় সেটাও ওই এলাকায় শক্তি ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হবে। তাই ইরানের পারমাণবিক বোমা আছে কি নেই বা সেটা বানাতে তার আরও কতটা সময় লাগতে পারে এর চেয়েও বড় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন ইরান ওই এলাকায় তার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর একমাত্র প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সরকারকেই ইরান নিয়ে ওবসেশনে ভুগতে দেখা গেছে। কীভাবে ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে বিরত রাখা যাবে এ নিয়েই তাদের চিন্তা আবর্তিত হয়েছে। বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কয়েকটি পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত রূপায়িত হতে পারেনি।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ ধরনের হামলা চালানো হলে ইরান মারাত্মক প্রতিশোধমূলক প্রতিহামলা চালাবে এবং এতে বিপদের বেশ ঝুঁকি রয়েছে। তাই তারা ইরানকে কাবু করার জন্য প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ জোরদার করছে।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় একাধিপত্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা এবং ইরানের ওই এলাকায় নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার বিপরীতমুখী চেষ্টার কারণে হরমুজ প্রণালি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্পট। আগামী দিনগুলোতে হরমুজ নিয়ে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি এটি বিশ্বের সম্ভাব্য যুদ্ধের কেন্দ্রেও পরিণত হতে পারে।
মাইকেল টি. ক্লেয়ার :হ্যাম্পশেয়ার কলেজের বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা স্টাডিসের অধ্যাপক
অল্টারনেট থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments