ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধন by এ এম এম শওকত আলী
জানা গেছে, আইন কমিশন বিপুলসংখ্যক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের বিষয়ে সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে। বিচারপতি ও আইনবিদরা প্রায়ই জনগণকে একটি আশার বাণী শুনিয়ে থাকেন। তাঁরা বলেন, বিচার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার অর্থ ন্যায়বিচার থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা (Justice delayed, justice denied)।
বহু বছর ধরে এ বাণী উচ্চারিত হলেও কোনো ফল হয়নি। ১৬ জুলাই আইনমন্ত্রী এক সেমিনারে মন্তব্য করেন, ৩০ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের। এ কারণে অনেকেই বলেন, এ ব্যবস্থা একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী নয়। আক্ষরিক দৃষ্টিকোণে কথাটি সত্য। তবে এ ধরনের সহজ সুপারিশে এ ব্যবস্থার ভালো দিকগুলো উহ্য থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন, এ ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আমলের হলেও তা ধর্মভিত্তিক বিচারব্যবস্থাকে প্রায় সমূলে উৎপাটন করে একটি অসাম্প্রদায়িক বিচার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর মূল বৈশিষ্ট্য একাধিক। এক. অপরাধীর ন্যায়বিচারের অধিকার। দুই. আইনবিদ দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার। তিন. স্বচ্ছতা, যার ফলে বিচারকাজ উন্মুক্ত আদালতেই করার বাধ্যবাধকতা। চার. আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।
মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার ব্যাখ্যার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানাবিধ মত প্রকাশ করে। এসব মতামত খণ্ড খণ্ডভাবে বলা হয়। বিচারকদের অভিযোগ বিপুলসংখ্যক মামলার তুলনায় বিচারকের স্বল্পতা। তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ অনেকটা একই ধরনের। এ ছাড়া বলা হয়, তাদের দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজেও ব্যস্ততা থাকে। রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারীরা মনে করেন, তদন্তকাজে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মামলা পরিচালনাকারী আইনবিদরা কারণে-অকারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য মুলতবি প্রার্থনা করেন, যা আদালতও মঞ্জুর করেন। অন্যরা বলেন, বিচারকরা নির্ধারিত সময়ে বিচারকাজ শুরু না করার ফলে উপস্থিত অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে দেওয়া হয়; যার ফলে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় দালালের বেশে আদালত প্রাঙ্গণে কিছু অসাধু ব্যক্তির উপস্থিতি, যারা নগদ অর্থের বিনিময়ে প্রকৃত ঘটনা না জেনেই আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়।
সময় সময় মিডিয়া বিচারাধীন অনেক আসামির তথ্য প্রকাশ করলেও তা একটি পুকুরে পাথর ছুড়লে যে সামান্য আলোড়ন সৃষ্টি করে, অনেকটা তার মতোই হয়। দু-এক দিন পর এসব তথ্য ও বিচারাধীন আসামিদের দুঃখ-দুর্দশার কথা সবাই ভুলে যায়। চলতে থাকে গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় বিচারকাজ। এদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক হলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর কারাবাসের কথাও মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। বলা হয়, আইনের দৃষ্টিতে তারা অপরাধী নয়। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান এখনো স্থায়ীভাবে হয়নি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের অতি সহজে জামিনে মুক্তিলাভের বিষয়। জামিনে মুক্তিলাভের পর এসব অপরাধী অনেক সময় বাদী ও তার আত্মীয়স্বজনকে প্রাণনাশের হুমকিও দিয়ে থাকে। এহেন কার্যকলাপের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মামলায় সাক্ষ্য প্রদানে বিরত রাখা, যার ফলে অপরাধী সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সহজেই খালাস পেতে পারে। গুরুতর অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অনেক সময় আরো কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন প্রণয়নের কথাও উচ্চারিত হয়। কিন্তু অপরাধের সংখ্যা হ্রাস পায় না। সব শেষে বলা হয়, অপরাধীদের ক্ষমতাধর ব্যক্তি কর্তৃক সুরক্ষার বিষয়।
উপর্যুক্ত নানাবিধ যুক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা ১২ জন অন্ধ ব্যক্তির হাতি দেখতে কেমন_সেই চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব। তবে এ কথা বলা নিখুঁত। যে বিষয়টি কখনো বলা হয় না তা হলো, বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বা সততার অভাব। অবশ্য দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য বহু অর্থও ব্যয় করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধির যুক্তি ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণযোগ্য হলেও এদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি গৌণ থাকে।
আইন কমিশনের সাম্প্রতিক সুপারিশগুলো চার বা পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এক. বিচারব্যবস্থায় তথা অপরাধ দমনে তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে কমিশন একটি পৃথক এবং স্থায়ী তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। বিগত কয়েক বছর আগেও এটা সরকারিভাবে বলা হয়েছিল। কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল, পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি থানায় এ ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া কিছু কিছু থানায় উচ্চপদের কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়েছে। পৃথক ও স্থায়ী তদন্ত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলা যায়, এ ব্যবস্থা গুরুতর অপরাধের জন্য বহুকাল ধরেই বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানের নাম সিআইডি (Criminal Investigation Department)। এ সংস্থাটিও ক্ষেত্রবিশেষে গুরুতর মামলার তদন্ত করে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে মহানগরী এলাকায় পুলিশের ডিটেকটিভ দপ্তর। এরাও তদন্ত করে। এসব দপ্তরের অধিক্ষেত্রসহ দায়িত্ব পরিধি জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। বাদীকে শেষ পর্যন্ত থানা কর্তৃপক্ষের ওপরই নির্ভর করতে হয়। দক্ষতা ও সততা নিশ্চিত না করে সংখ্যা বৃদ্ধি করলে ফল হবে শূন্য। কারণ, শূন্য+শূন্য+শূন্য=শূন্যই হবে। তবে ঢালাওভাবে এহেন মন্তব্য সঠিক নয়। কারণ পুলিশ বাহিনীতে স্বল্পসংখ্যক হলেও নিবেদিত ও দক্ষ কর্মী রয়েছেন। এ কারণেই এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের তদন্ত সঠিক হয়, অর্থাৎ অপরাধী সাজা পায়।
এ ছাড়া সুপারিশ করা হয়েছে ক. তদন্তকারী কর্মকর্তাকে যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে যেন বদলি করা না হয় এবং খ. প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ফরেনসিক ল্যাবরেটরি স্থাপন। এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন পেশ করাও বাধ্যতামূলক করতে হবে। অন্যথায় এদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হবে বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ে যে তথ্য জানা যায়নি তা হলো, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের বাধ্যবাধকতা সুপারিশ করা হয়েছে কি না। অন্য একটি সুপারিশ হলো ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারার সংশোধন করা। এর ফলে সাক্ষীরা পুলিশের কাছে যে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবেন, তাতে তাঁদের স্বাক্ষর করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ ধরনের কোনো বিধান নেই। ধারণা করা সম্ভব, সংশোধিত বিধান আসামিদের জন্য হবে ভীতির কারণ। তারা পরবর্তী পর্যায়ে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ভীত হবে।
তারা মনে করবে, লিখিত বক্তব্যের বাইরে যদি কিছু সত্যি তথ্য প্রদান করা হয় তাহলে তারা বিপদের সম্মুখীন হবে। মিথ্যা সাক্ষ্যের দায়ে তাদের সাজা হতে পারে। উল্লেখ্য, অধিকাংশ সময় মৌখিক জবানবন্দি পুলিশ লিপিবদ্ধ করে। অনেকেই পুলিশের সামনে ভীত হয়ে স্বাক্ষর করবে কী লেখা আছে তা না জেনেই। বিষয়টি আরো গভীরভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের জবানবন্দি সাক্ষ্য আইনের সঙ্গেও জড়িত। খণ্ড খণ্ডভাবে সংশোধন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তৃতীয় সুপারিশ হলো, আদালতের বাইরে বাদী ও বিবাদী একমত হয়ে আপস করবেন। কমিশন এ বিষয়ে বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো সম্প্রসারণ করার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। তবে এ বিষয়ে কী ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। কমিশন বলেছে, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে না। এ বিষয়ে বিদ্যমান ধারার প্রয়োগসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেলে ভালো হতো।
চতুর্থ সুপারিশ হলো, যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিচারকাজ মুলতবি না করা। সাধারণ নাগরিকদের ধারণা, এ কারণে মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত হয়। কিন্তু এ বিষয়েও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। জজ বা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটরা সাধারণত কত সময়ের জন্য ও কী কারণে শুনানি মুলতবি করেন, তা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভালো হয়।
সর্বশেষ বলা হয়েছে, আপিলকৃত অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা অত্যধিক। এ বিষয়ে কমিশন দুটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এক. একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আপিল প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট আদালত মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সচেষ্ট হন না। দুই. অ্যাপিলেট আদালতকে সংশ্লিষ্ট মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করতে হয়। এসব সমস্যা নিরসনে কমিশনের সুপারিশ হলো, বিশেষ আপিল আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি। সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বারবার সুপারিশ করা হবে কেন? এ ক্ষেত্রে কমিশন আরো সুপারিশ করেছে, আপিল নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সময় বেঁধে দিতে হবে। এ ছাড়া জামিনের সময়সীমা সর্বোচ্চ ৯০ দিনের বেশি হতে পারবে না। এর মধ্যে অন্য একটি সুপারিশ হলো, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই পুনর্বিচারের আদেশ প্রদানের প্রবণতা। এ প্রবণতা রোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিচারকসহ আইনজীবীরা এ বিষয়ে সচেতন না হলে কোনো ফল হবে না।
পেছনের দিকে তাকালে বলা যায়, আশির দশকের প্রথম ভাগে সরকার কর্তৃক গঠিত একটি কমিটি ফৌজদারি কার্যবিধি সংস্কারের সুপারিশ করেছিল। কমিশন ওই প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখেছে কি না জানা নেই। এ ছাড়া ওই সময়ের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো মূল্যায়নও করা হয়নি। এ কারণে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি (সদ্য সাবেক) ও আইনমন্ত্রীর মধ্যে প্রকাশ্যে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে বাক্য বিনিময় হয়েছিল। মূল কথা ছিল, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি (সাফ) এবং ন্যায়বিচার (ইনসাফ) সমার্থক নয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার ব্যাখ্যার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানাবিধ মত প্রকাশ করে। এসব মতামত খণ্ড খণ্ডভাবে বলা হয়। বিচারকদের অভিযোগ বিপুলসংখ্যক মামলার তুলনায় বিচারকের স্বল্পতা। তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ অনেকটা একই ধরনের। এ ছাড়া বলা হয়, তাদের দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজেও ব্যস্ততা থাকে। রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারীরা মনে করেন, তদন্তকাজে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মামলা পরিচালনাকারী আইনবিদরা কারণে-অকারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য মুলতবি প্রার্থনা করেন, যা আদালতও মঞ্জুর করেন। অন্যরা বলেন, বিচারকরা নির্ধারিত সময়ে বিচারকাজ শুরু না করার ফলে উপস্থিত অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে দেওয়া হয়; যার ফলে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় দালালের বেশে আদালত প্রাঙ্গণে কিছু অসাধু ব্যক্তির উপস্থিতি, যারা নগদ অর্থের বিনিময়ে প্রকৃত ঘটনা না জেনেই আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়।
সময় সময় মিডিয়া বিচারাধীন অনেক আসামির তথ্য প্রকাশ করলেও তা একটি পুকুরে পাথর ছুড়লে যে সামান্য আলোড়ন সৃষ্টি করে, অনেকটা তার মতোই হয়। দু-এক দিন পর এসব তথ্য ও বিচারাধীন আসামিদের দুঃখ-দুর্দশার কথা সবাই ভুলে যায়। চলতে থাকে গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় বিচারকাজ। এদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক হলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর কারাবাসের কথাও মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। বলা হয়, আইনের দৃষ্টিতে তারা অপরাধী নয়। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান এখনো স্থায়ীভাবে হয়নি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের অতি সহজে জামিনে মুক্তিলাভের বিষয়। জামিনে মুক্তিলাভের পর এসব অপরাধী অনেক সময় বাদী ও তার আত্মীয়স্বজনকে প্রাণনাশের হুমকিও দিয়ে থাকে। এহেন কার্যকলাপের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মামলায় সাক্ষ্য প্রদানে বিরত রাখা, যার ফলে অপরাধী সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সহজেই খালাস পেতে পারে। গুরুতর অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অনেক সময় আরো কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন প্রণয়নের কথাও উচ্চারিত হয়। কিন্তু অপরাধের সংখ্যা হ্রাস পায় না। সব শেষে বলা হয়, অপরাধীদের ক্ষমতাধর ব্যক্তি কর্তৃক সুরক্ষার বিষয়।
উপর্যুক্ত নানাবিধ যুক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা ১২ জন অন্ধ ব্যক্তির হাতি দেখতে কেমন_সেই চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব। তবে এ কথা বলা নিখুঁত। যে বিষয়টি কখনো বলা হয় না তা হলো, বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বা সততার অভাব। অবশ্য দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য বহু অর্থও ব্যয় করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধির যুক্তি ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণযোগ্য হলেও এদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি গৌণ থাকে।
আইন কমিশনের সাম্প্রতিক সুপারিশগুলো চার বা পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এক. বিচারব্যবস্থায় তথা অপরাধ দমনে তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে কমিশন একটি পৃথক এবং স্থায়ী তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। বিগত কয়েক বছর আগেও এটা সরকারিভাবে বলা হয়েছিল। কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল, পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি থানায় এ ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া কিছু কিছু থানায় উচ্চপদের কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়েছে। পৃথক ও স্থায়ী তদন্ত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলা যায়, এ ব্যবস্থা গুরুতর অপরাধের জন্য বহুকাল ধরেই বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানের নাম সিআইডি (Criminal Investigation Department)। এ সংস্থাটিও ক্ষেত্রবিশেষে গুরুতর মামলার তদন্ত করে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে মহানগরী এলাকায় পুলিশের ডিটেকটিভ দপ্তর। এরাও তদন্ত করে। এসব দপ্তরের অধিক্ষেত্রসহ দায়িত্ব পরিধি জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। বাদীকে শেষ পর্যন্ত থানা কর্তৃপক্ষের ওপরই নির্ভর করতে হয়। দক্ষতা ও সততা নিশ্চিত না করে সংখ্যা বৃদ্ধি করলে ফল হবে শূন্য। কারণ, শূন্য+শূন্য+শূন্য=শূন্যই হবে। তবে ঢালাওভাবে এহেন মন্তব্য সঠিক নয়। কারণ পুলিশ বাহিনীতে স্বল্পসংখ্যক হলেও নিবেদিত ও দক্ষ কর্মী রয়েছেন। এ কারণেই এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের তদন্ত সঠিক হয়, অর্থাৎ অপরাধী সাজা পায়।
এ ছাড়া সুপারিশ করা হয়েছে ক. তদন্তকারী কর্মকর্তাকে যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে যেন বদলি করা না হয় এবং খ. প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ফরেনসিক ল্যাবরেটরি স্থাপন। এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন পেশ করাও বাধ্যতামূলক করতে হবে। অন্যথায় এদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হবে বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ে যে তথ্য জানা যায়নি তা হলো, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের বাধ্যবাধকতা সুপারিশ করা হয়েছে কি না। অন্য একটি সুপারিশ হলো ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারার সংশোধন করা। এর ফলে সাক্ষীরা পুলিশের কাছে যে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবেন, তাতে তাঁদের স্বাক্ষর করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ ধরনের কোনো বিধান নেই। ধারণা করা সম্ভব, সংশোধিত বিধান আসামিদের জন্য হবে ভীতির কারণ। তারা পরবর্তী পর্যায়ে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ভীত হবে।
তারা মনে করবে, লিখিত বক্তব্যের বাইরে যদি কিছু সত্যি তথ্য প্রদান করা হয় তাহলে তারা বিপদের সম্মুখীন হবে। মিথ্যা সাক্ষ্যের দায়ে তাদের সাজা হতে পারে। উল্লেখ্য, অধিকাংশ সময় মৌখিক জবানবন্দি পুলিশ লিপিবদ্ধ করে। অনেকেই পুলিশের সামনে ভীত হয়ে স্বাক্ষর করবে কী লেখা আছে তা না জেনেই। বিষয়টি আরো গভীরভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের জবানবন্দি সাক্ষ্য আইনের সঙ্গেও জড়িত। খণ্ড খণ্ডভাবে সংশোধন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তৃতীয় সুপারিশ হলো, আদালতের বাইরে বাদী ও বিবাদী একমত হয়ে আপস করবেন। কমিশন এ বিষয়ে বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো সম্প্রসারণ করার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। তবে এ বিষয়ে কী ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। কমিশন বলেছে, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে না। এ বিষয়ে বিদ্যমান ধারার প্রয়োগসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেলে ভালো হতো।
চতুর্থ সুপারিশ হলো, যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিচারকাজ মুলতবি না করা। সাধারণ নাগরিকদের ধারণা, এ কারণে মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত হয়। কিন্তু এ বিষয়েও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। জজ বা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটরা সাধারণত কত সময়ের জন্য ও কী কারণে শুনানি মুলতবি করেন, তা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভালো হয়।
সর্বশেষ বলা হয়েছে, আপিলকৃত অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা অত্যধিক। এ বিষয়ে কমিশন দুটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এক. একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আপিল প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট আদালত মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সচেষ্ট হন না। দুই. অ্যাপিলেট আদালতকে সংশ্লিষ্ট মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করতে হয়। এসব সমস্যা নিরসনে কমিশনের সুপারিশ হলো, বিশেষ আপিল আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি। সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বারবার সুপারিশ করা হবে কেন? এ ক্ষেত্রে কমিশন আরো সুপারিশ করেছে, আপিল নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সময় বেঁধে দিতে হবে। এ ছাড়া জামিনের সময়সীমা সর্বোচ্চ ৯০ দিনের বেশি হতে পারবে না। এর মধ্যে অন্য একটি সুপারিশ হলো, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই পুনর্বিচারের আদেশ প্রদানের প্রবণতা। এ প্রবণতা রোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিচারকসহ আইনজীবীরা এ বিষয়ে সচেতন না হলে কোনো ফল হবে না।
পেছনের দিকে তাকালে বলা যায়, আশির দশকের প্রথম ভাগে সরকার কর্তৃক গঠিত একটি কমিটি ফৌজদারি কার্যবিধি সংস্কারের সুপারিশ করেছিল। কমিশন ওই প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখেছে কি না জানা নেই। এ ছাড়া ওই সময়ের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো মূল্যায়নও করা হয়নি। এ কারণে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি (সদ্য সাবেক) ও আইনমন্ত্রীর মধ্যে প্রকাশ্যে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে বাক্য বিনিময় হয়েছিল। মূল কথা ছিল, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি (সাফ) এবং ন্যায়বিচার (ইনসাফ) সমার্থক নয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments