সংবিধান সংশোধন : প্রাপ্তি কতটুকু? by ড. তুলসী কুমার দাস

বেশ কয়েক দিন ধরে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত দেশের খ্যাতনামা কলামিস্টদের লেখা নানা প্রবন্ধ পড়ে আসছি। আমরা সবাই জানি, পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন বিল ৩০ জুন ২০১১-তে মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়ে গেছে এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইতিমধ্যে বিলটিতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষরও করেছেন।


সংবিধানের এই সংশোধনীটি নিয়ে সারা দেশে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো চলবে বলে মনে হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে সেটা খুবই প্রত্যাশিত। যে প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেটিও আমার দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সংশোধন প্রক্রিয়ার কোনো স্তরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা যায়নি। সে কারণেই দেশের বিবেকবান অনেক মানুষই আজ খুবই উদ্বিগ্ন। রাজপথ ক্রমেই গরম হচ্ছে এবং দেশ নিয়ে নানা আশঙ্কা আমাদের বিচলিত করছে। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হলো কেন? উত্তরটি সহজ। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষ চেয়েছে সংবিধান সংশোধিত হোক। কারণ, যে আদর্শ, মূল্যবোধ ও চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতত্বে দেশের লক্ষ কোটি মানুষ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং যার সম্পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে, সেটি আবার সংবিধানে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি ছিল। বঙ্গবন্ধু জানতেন একটি সমাজকে গোড়া থেকেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ধর্ম০িনরপেক্ষতার আদর্শে উজ্জীবিত করা দরকার, নতুবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব নয়। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলের পতন ঘটে ১৯৯০ সালে। এরশাদের পতন দেশবাসীর মনে নতুন আশা সঞ্চারিত করে, মানুষ গণতন্ত্রের জন্য আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, তিন মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। আশা করা গিয়েছিল, গণতন্ত্রের ভিত ক্রমেই মজবুত হবে, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি মানুষের সব স্বপ্ন বারবার ব্যর্থ করে দিচ্ছে। পর পর বেশ কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও পরাজিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফলাফল কখনো মেনে নেয়নি। বিএনপির নেতৃত্বে পরিচালিত সর্বশেষ জোট সরকারের শাসনামলে জঙ্গিদের বিস্ময়কর উত্থান এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি দেশকে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে যায়। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি অনেকের কাছেই প্রতীয়মান হয় এবং দেশে এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং একধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেই জোট সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করে। এর পর পরই রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে ১/১১-এর উদ্ভব ঘটে এবং ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট এই সরকার প্রায় দুই বছর দেশ শাসন করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সমর্থ হয়। এই সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। জনগণ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়। মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর স্বভাবতই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রত্যাশার পারদ ওপরে উঠতে থাকে। সরকার কর্তৃক গৃহীত কয়েকটি পদক্ষেপ আশার আলো দেখাতে সমর্থ হয়। সংবিধান সংশোধনের জন্য যখন বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, তখন আমরা একবুক স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। মনে হয়, এবার বোধ হয় দেশটি সত্যিই ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাবে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান নিশ্চিত করা হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে কোনো সমাজ গণতান্ত্রিক হতে পারে না। সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির সদস্যদের নাম যখন ঘোষণা করা হয়, তখন একধরনের স্বস্তি অনুভব করেছিলাম। বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো প্রাজ্ঞ ও উদার রাজনীতিকদের বিশেষ কমিটির সদস্য করায় মনে হয়েছিল, সরকার সত্যিই ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যেতে আগ্রহী।
কিন্তু কী সংশোধন করা হলো? চার মূলনীতি সংবিধানে প্রতিস্থাপন করা হলো, পাশাপাশি বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের বিধান অক্ষুণ্ন রাখা হলো। এটা কি ১৯৭২ সালের সংবিধান? সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্মের সংযোজন তো যথাক্রমে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অবদান। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ দুজনই তাঁদের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। তাঁরা দুজনই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য আমাদের মূল সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছেন। মহাজোট সরকার কিসের ভয়ে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সংবিধান কাটাছেঁড়াকে বৈধতা দিল? বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক এবং তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি পছন্দ করে বলে মনে হয় না। ১৯৭১ তার বড় প্রমাণ। স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধা করতে পারেনি। এটা ঠিক যে বিএনপি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর কারণগুলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করা দরকার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতা দখল করেছে তারা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষের নির্দোষ ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। এই গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য ধর্মকে অপব্যবহার করেছে। এরশাদ ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের কারণেই এই দীর্ঘ সময় আমাদের সমাজকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক করে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। সম্ভবত সে কারণেই আমাদের সমাজে এত হানাহানি। দিন বদলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ অনেক গুণ বেড়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারও অন্য অনেক দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের মতো দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং ভাবাবেগকে উপেক্ষা করল। সেটা কি ভোট হারানোর ভয়ে?
এবারের সংশোধনীতেও আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না। তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, তবু তাদের বাঙালি বলা হলো। তার মানে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি তার ভূখণ্ডে বসবাসরত আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকার করে না। এসব কি গণতন্ত্রের নমুনা? আমরা কি সত্যিই গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই? আমাকে কেউ কি বলবেন, আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হতো?
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, tulshikumardas@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.