জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত ড. এমাজউদ্দীন : তিন আমলের অভিজ্ঞতা নিয়ে আত্মজীবনীই হবে শেষ লেখা by হাসান শান্তনু

ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—এ তিন আমলের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ, আন্দোলন-সংগ্রাম, মানুষের জীবনযাত্রা ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একাত্তরে বিজয় লাভ ইত্যাদি নিয়ে আত্মজীবনী লিখছেন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর এ আত্মজীবনীতে থাকবে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের চল্লিশ বছরে প্রাপ্তি ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন। থাকবে বাংলাদেশ নিয়ে অমিত সম্ভাবনার কথা। এ আত্মজীবনীই হবে বরেণ্য এ শিক্ষাবিদের শেষ লেখা।


তবে দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তেও তিনি লিখবেন। বাকি জীবনটা দেশ ও মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। গতকাল তার ৮০তম জন্মদিনে এসব ভাবনার কথা জানান। জন্মদিনে তিনি পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন।
অন্যদিকে বিজয়ের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাব আয়োজিত বইমেলার আজ শেষদিন। গতকাল সপ্তম দিনে মেলা পাঠক, প্রকাশক, নবীন-প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অংশগ্রহণে জমে ওঠে। এছাড়া গতকাল বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিশু একাডেমী ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ নগরের বিভিন্ন মিলনায়তন আর মঞ্চ বিজয়ের আয়োজনে মুখর ছিল। আজ বিজয়ের দিনেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনজুড়ে থাকছে বৈচিত্র্যময় আয়োজন।
ফুলেল শুভেচ্ছা : ড. এমাজউদ্দীনের শুভানুধ্যায়ী, ভক্তরা মিলে গতকাল তাঁর বাসায় কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করেন। এবারের জন্মদিন উদযাপনে ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় তাঁকে শুভেচ্ছা জানান দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর সুহৃদরাও দিনভর ফুল ও উপহারসামগ্রী দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনেকে টেলিফোন, মোবাইল ফোনেও শুভেচ্ছা জানান। বিকালে বাসায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে পরিবারের সবাইসহ বাসভবনে আগতদের নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী গত বছর দেড়েক ধরে অসুস্থ। তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তিনি আজ সুস্থ থাকলে এ আয়োজন দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।’ স্বাধীনতা ফোরামের উদ্যোগে এ ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জন্মদিনের অনুভূতি জানিয়ে ড. এমাজউদ্দীন বলেন, ‘আশি বছর তো আর কম বয়স নয়। এত বছর বেঁচেছি, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এখনও সভা-সেমিনারে কথা বললে মানুষ শোনে। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সমস্যা আর এগুলোর সমাধান নিয়ে ভাবতে পারছি। সমস্যার সমাধানের বিষয়গুলো যাদের শোনার কথা, তারা কতটা শোনেন জানি না।’ অনুষ্ঠানে তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় বাকি জীবনটা কাজে লাগাতে চাই। যতই বাধা আসুক না কেন, দেশের স্বার্থে তা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আল্লাহর কাছে শক্তি ও সামর্থ্য প্রার্থনা করছি।’
গত ঊনআশি বছরের মধ্যে প্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘চারপাশে যখন দেখি আমার ছাত্রছাত্রীরা সফলতা অর্জন করছে বা আমার ছাত্রতুল্যরা সাফল্য লাভ করছে, তখন মনে হয় আমার জীবনে কেবল প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি। না পাওয়ার বেদনার বোধটা তখন আর মনে থাকে না। প্রাতিষ্ঠানিক কাজগুলো নিয়েও আমার সন্তোষ বোধ আছে।’
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ১৯৩২ সালে জন্ম নেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ দেশের রাজনীতি, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও ফলাফল, ভূমি সংস্কার, সিভিল সোসাইটি বিষয়ে বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রায় ৫৭টি বই আছে তাঁর। তবে আত্মজীবনীই হবে শেষ বই। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম ব্রিটিশ আমলে, পড়াশোনা করেছি পাকিস্তান আমলে। সংগ্রাম করে একাত্তর সালে লাভ করেছি স্বাধীনতা। এরপর দেখেছি বাংলাদেশকে। এসবের অভিজ্ঞতা নিয়েই জীবনী লিখব।’
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দেশ এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সঙ্কটগ্রস্ত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ের দেশ। এ দেশে তো এটা হওয়ার কথা ছিল না। সংসদীয় ব্যবস্থায় এটা হয় না।’ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি সব সময় বলি বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দেশ। আমরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছি, আমাদের সন্তানরা সেখানে সফল হবে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের এই ব্যর্থতা থেকে মুক্তি দেবে। আমাদের ভরসার জায়গা তারা। তাদের মানবসম্পদ হিসেবে রাষ্ট্রকে গড়তে হবে। তারা গড়ে উঠলে দেশ আরও উন্নত হবে।’
গতকাল তাকে শুভেচ্ছা জানান ও কুশল বিনিময় করেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। দুপুরে অন্যান্যের মধ্যে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানান কবি হাসান হাফিজ। শুভেচ্ছা জানান বিএনপি নেতা আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ। দৈনিক আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান সিনিয়র সহকারী সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমান প্রমুখ আর উত্সঙ্গ সৃজন চিন্তন সংগঠনের পক্ষে পরিচালক আহমদ বাসির। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা ফোরামের পক্ষে আওলাদ হোসেন বুলবুল, খালেদা ইয়াসমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রেস ক্লাব বইমেলা : গতকাল বেলা এগারোটা থেকে প্রেস ক্লাব বইমেলা শুরু হয়। চলে রাত আটটা পর্যন্ত। মেলার সপ্তম দিনেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিক্রি ও ভিড়ে মুখর ছিল প্রেস ক্লাব চত্বর। বই কেনার সঙ্গে ক্রেতাদের জন্য ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘আলোর মিছিল’-এর প্রদর্শনী। প্রখ্যাত নির্মাতা মিতার নির্মিত এ সিনেমা সন্ধ্যায় উপভোগ করেন নানা বয়সের দর্শক। গতকালও পাঠকপ্রিয় লেখকদের উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের বই বেশি বিক্রি হয় বলে প্রকাশকরা জানান। বিজয়ের চল্লিশ বছর পূর্তিতে প্রেস ক্লাব আয়োজিত সাতদিনের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ৯ ডিসেম্বর থেকে ক্লাব চত্বরে এ মেলার আয়োজন হচ্ছে।
প্রকাশকরা জানান, মেলা উপলক্ষে ক্রেতাদের দেয়া হচ্ছে শতকরা পঁচিশ ভাগ ছাড়। মেলায় আছে চল্লিশটি স্টল। মেলা কমিটির আহ্বায়ক নুরুল হাসান খান জানান, আজ শেষদিনে মেলা শুরু হবে বেলা এগারোটা থেকে। চলবে রাত আটটা পর্যন্ত।
বাংলা একাডেমীর উত্সব : বিজয়ের চল্লিশ বছর পূর্তিতে বাংলা একাডেমী আয়োজিত তিনদিনের উত্সবের গতকাল ছিল দ্বিতীয় দিন। বিকাল চারটা থেকে একাডেমীর রবীন্দ্র চত্বরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক এএফ সালাহউদ্দিন আহমদ। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। প্রবন্ধ পড়েন অধ্যাপক ড. সেলিম। আলোচনা করেন সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর-রশিদ, সাংবাদিক আবেদ খান, কবি ড. মুহাম্মদ সামাদ ও অধ্যাপক ড. আবু দেলোয়ার হোসেন। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বের জন্য পূর্বনির্ধারিত ছিল অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নাম। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে সভাপতির আসন শূন্য রাখা হয়। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। এতে কল্যাণী ঘোষ, নমিতা ঘোষ, ফকির আলমগীর, শেখ জমিরউদ্দিন, শ্রেয়সী রায়, আমজাদ দেওয়ান, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ গান গেয়ে শোনান।
সাংস্কৃতিক জোটের উত্সব : মঙ্গলবার থেকে রাজধানীর আটটি স্থানে একযোগে শুরু হয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে বিজয় উত্সব। এতে গতকাল শহীদ মিনারে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচী, আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী ও বহ্নিশিখা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন মলয় কুমার গাঙ্গুলী, শিবু রায়, রূপু খান, সালমা চৌধুরী, মাহবুব রিয়াজ, শেখ আওয়াল হক, শামীম আল মামুন, আবিদা রহমান সেতু, সফিউল আলম রাজা ও মহাদেব ঘোষ। দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ ও মৈত্রী থিয়েটার মঞ্চস্থ করে পথনাটক। প্রদর্শিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’। উত্সবের আজ শেষদিন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : বিজয় উত্সবের ষষ্ঠদিনে গতকাল জাদুঘর প্রাঙ্গণে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ও চরমপত্র পাঠ। চরমপত্র পাঠ করেন শহীদুল ইসলাম নাজু, দেবব্রত সরকার ডিউক ও তামান্না সারোয়ার নীপা। সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয় যশোরের বুরুজা বাগান মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও রংপুরের পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। চন্দ্রাবতীয় কথন ও গান পরিবেশন করে কিশোরগঞ্জ সংস্থার শিল্পীরা।
শিশু একাডেমী : বিজয় দিবস উপলক্ষে শিশু একাডেমী গতকাল দিনজুড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মধ্যে সকালে ছিল শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন ও দেশের গানের প্রতিযোগিতা। বিকালে একাডেমীর মূল মঞ্চে ছিল আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক সচিব তারিক-উল-ইসলাম।

No comments

Powered by Blogger.