বিজয় দিবস ২০১১-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
আজ আমাদের ৪০তম বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমকালীন ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একটি সংকল্পবদ্ধ জাতি অজস্র সংগ্রাম করে শুধু ৯ মাসের মধ্যে একটি বহুগুণ শক্তিশালী এবং আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত দখলদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে দেশ স্বাধীন করে। সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত ৯৩ হাজার সদস্যের পাকিস্তানি বাহিনী আজকের দিনে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কাছে
আত্মসমর্পণ করে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই দশকে বিস্তৃত ছিল, এগিয়ে ছিল ধাপে ধাপে। ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং সত্তরের নির্বাচনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। বাঙালি জাতির এই মহান বিজয়ের প্রতিটি স্তরে বঙ্গবন্ধু সুযোগ্য নেতৃত্ব দেন। তাঁর কেন্দ্রীয় ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের তিনিই নায়ক এবং পথপ্রদর্শক। কেন্দ্র ছাড়া বৃত্ত রচনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর অবদান স্মরণ না করে বাংলাদেশের কোনো ইতিহাস রচনা করা যাবে না। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্বভার নিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে এলেন। পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বললেন, পিআইএর প্লেন ঢাকায় যেতে পারবে না; লন্ডন বা মস্কোতে পেঁৗছে দিতে পারবে। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পেঁৗছলেন ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। ব্রিটিশ সরকার ভিআইপি রুমে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। তখন ভারত ও ভুটান ছাড়া ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশ আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মিশনের অস্থায়ী প্রধান রেজাউল করীম এবং তাঁর সহকর্মীরা। ব্রিটিশ সরকার তাঁর জন্য একটি সরকারি লিমোজিন পাঠিয়ে দিল। সেটায় না উঠে তিনি তা পাঠালেন তাঁর সহযোগীদের। নিজে উঠলেন আমাদের অস্থায়ী মিশনপ্রধানের ছোট গাড়িতে। সারা পথজুড়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়। হোটেলে পেঁৗছে পরিবারের সদস্য এবং সহকর্মীদের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। এর পরই যোগাযোগ করলেন মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোর সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন তাঁকে। এক দিন যাত্রাবিরতির পর ঢাকার পথে রওনা হবেন। ব্রিটিশ সরকার একটি সরকারি বিমানের ব্যবস্থা করল। ইন্দিরা গান্ধীও একটি বিমান পাঠালেন এবং ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানালেন। কী করবেন বঙ্গবন্ধু? ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেন, তাঁর বাংলাদেশে ফিরে আসাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে একটি সুন্দর সমাধান বের করলেন। ব্রিটিশ প্লেনে যাবেন, তবে দিলি্লতে স্বল্প বিরতির জন্য থামবেন। বঙ্গবন্ধু তখন ভালোভাবেই জানতেন, ভারতের সাহায্য ছাড়া আমাদের মুক্তিসংগ্রাম আরো অনেক দীর্ঘায়িত হতো। জানতেন, তারা কিভাবে আমাদের উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছে, সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিনি কারো বা কোনো দেশের ওপর অতি নির্ভরশীল হতে চাননি। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জননায়ক বঙ্গবন্ধু যে আত্মমর্যাদা সেদিন দেখিয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা হয় না। আজ চার দশক পর ভাবি, কোথায় গেল আমাদের সেই সাহস, সেই দেশপ্রেম, সেই আত্মমর্যাদা।
স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এই আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে হলে সেই সময়কার অবস্থা বুঝতে হব। সারা পৃথিবী তখন দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ, অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলো সদ্য তাদের ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। তারা এই দ্বন্দ্বে জড়াতে চাইল না। গড়ল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। পাকিস্তান এই আন্দোলনে শরিক না হয়ে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধে সামরিক জোট ঝঊঅঞঙ ও ঈঊঘঞঙ-র সদস্য হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা সারা বিশ্বে জনমত গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু ভারত ও ভুটান ছাড়া আর কোনো সরকার আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তান তখন জোর গলায় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল। সারা বিশ্বের লোক তখন তাকিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু কী পদক্ষেপ নেন, তা দেখার জন্য।
দিলি্লতে স্বল্প বিরতির পর ঢাকায় ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, 'যেদিন বাংলাদেশ চাইবে, সেদিনই ভারতীয় সৈন্যরা প্রত্যাহৃত হবে।' ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতায় আলাপ করে তিনি ঘোষণা দিলেন, আমাদের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের আগেই ভারতীয় সৈন্যরা চলে যাবে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারতীয় সৈন্যরা ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ সমাপ্তির মাত্র ৯০ দিনের মাথায় বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার এক বিরল ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৭০ বছর পরও আজ বিদেশি সৈন্য জার্মানি ও জাপানে আছে। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাট প্রভাব ফেলবে এবং বাংলাদেশকে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল, সেটার অসারতাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশ অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় সব দেশের স্বীকৃতি পায় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তথা কমনওয়েলথ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ও জাতিসংঘের সদস্য হয়। শুধু চীন ও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৫ সালে আমাদের স্বীকৃতি জানায়।
ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দুই দেশের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ, পানিবণ্টন এবং দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক চুক্তি করেন। এমনকি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তখন ভারত ও মিয়ানমার প্রস্তুত ছিল না। সেই সময় আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের ওপর কোনো আলোচনাই শুরু হয়নি। 'সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়'_বঙ্গবন্ধুর এই অমর বাণীর মধ্যে প্রোথিত ছিল আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। দেশ-বিদেশে আমাদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ এবং প্রসারের মূলমন্ত্র এটি। পাকিস্তানের শত বৈরিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে যুদ্ধোদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সেই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার এক সভায় তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, 'যুদ্ধ নয়, সহযোগিতা, স্থিতিশীলতা ও শান্তিই আমাদের কাম্য। অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় আমাদের সীমিত জাতীয় সম্পদ ব্যয় না করে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। যদি তা না পারি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।' অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ফলে পাঁচজন রাষ্ট্রপ্রধান ঢাকায় এসে তাঁকে ১৯৭৪ সালের ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অবস্থানের জন্য বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর পরই বঙ্গবন্ধু নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে গেলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোর্ড, সিনেট এবং কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হলেন, আলোচনা করলেন। তাঁদের বললেন, বাংলাদেশ 'তলাবিহীন' ঝুড়ি নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তার পুনর্গঠনের জন্য আপনাদের সাহায্য-সহযোগিতা চাইছে। কিন্তু বেশি দিন আমরা কারো ওপর নির্ভরশীল থাকব না। বাংলাদেশ অতিসত্বর স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হবে। একজন পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে আমরা অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি আমাদের স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে সদ্য গঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের পরামর্শকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠানই বড়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি সুসংহত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর অবদান অপরিসীম।
কারো কাছে মাথা নত করেননি বঙ্গবন্ধু। বিদেশি চাপ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রতিহত করেছেন। কোনো দেশের স্বীকৃতির জন্য কোনো ধরনের আপস করেননি। কোনো প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্রপ্রধান বলেছিলেন, 'গণপ্রজাতন্ত্র' থেকে 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' হিসেবে দেশের নাম বদলালে তাঁর দেশ স্বীকৃতি দেবে। এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি বঙ্গবন্ধু। তাঁর সাড়ে তিন বছর শাসনকালে আমরা পৃথিবীর বুকে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান কোনো অন্যায় প্রভাব খাটাতে গেলে বঙ্গবন্ধু তাদের হাসিমুখে প্রতিহত করতেন কৌশলে। নাইজেরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াকুবু গাওয়ান তাঁর নিজ দেশে বিয়াফ্রা যুদ্ধের কারণে আমাদের প্রতি কিছুটা বিরূপ ছিলেন। কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'এক পাকিস্তান ভালো ছিল, কেন ভাঙলেন আপনারা?' বঙ্গবন্ধু হেসে উত্তর দিলেন, 'ইয়াকুবু, এক পাকিস্তান ভালো হতো। এক ভারত আরো ভালো হতো। এক বিশ্ব সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু সব কিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?' এই বলে তাঁর চাদর ইয়াকুবুর গলায় পরিয়ে দিলেন। এ ঘটনার অল্প দিন পর নাইজেরিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
আজ বিজয়ের এই দিনে শ্রদ্ধা জানাই সাহসী, আত্মমর্যাদাশীল ও স্বাধীনচেতা বঙ্গবন্ধুকে। আমাদের সংবিধানেই তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র। আগামী দিনে তা-ই করবে আমাদের অনুপ্রাণিত।
লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা
No comments