অধিকার-নাগরিক ক্যাম্পে তারা যেভাবে বেঁচে আছে by আলতাফ পারভেজ
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখেছি, ৪০.১১ বিঘার ওপর ৫ হাজার ৫০০ পরিবার থাকছে! বিস্ময়কর ঘনত্ব। এই বিশাল সংখ্যার শরণার্থীরা প্রতিদিন যে ময়লা পয়দা করে সেটাও সিটি করপোরেশন সরায় না। কারণ এরা যে এখনও ক্যাম্পের বাসিন্দা, 'শরণার্থী'। এই শরণার্থীদের আবার সরকার ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে রেখেছে। শরণার্থী হলেও ক্ষমতার সমীকরণে তাদের পাঁচ বছর পরপর ভোটকেন্দ্রে নিয়ে অনেকে লাভবান হন। আবার ভোটার আইডি কার্ড দেওয়া হলেও সেই কার্ড দিয়ে আশপাশের 'বাঙালি সমাজ' যেসব নাগরিক সুবিধার দাবি করতে পারে, ক্যাম্পবাসী তা পারে না।
জীবনানন্দ দাশের 'ক্যাম্পে' নামে বিখ্যাত কবিতাটি অনেকেরই পড়া। কিন্তু ঢাকার নাগরিক ক্যাম্পে দখিনা বাতাস কিংবা জ্যোৎস্নার দেখা মেলা দুঃসাধ্য। মোহাম্মদপুর, মিরপুরের 'জেনেভা ক্যাম্প'গুলোর কথা বলছি। সমাজ ও সভ্যতা নিয়ে যাদের আগ্রহ, যারা সাংবাদিক, শিল্পী, এনজিওকর্মী, সর্বোপরি অনুসন্ধানী মানুষ তাদের সবারই এই ক্যাম্পগুলো সরেজমিনে দেখা উচিত। সেখানে ঘোরা উচিত। সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। নিজেদের উদাসীনতার ব্যক্তিগত পরিধি এবং রাজনৈতিক জিঘাংসার উপমহাদেশীয় ঐতিহাসিক কাঠামো বোঝার স্বার্থেও আমরা সবাই সেখানে যেতে পারি।
২০১১ সালে এসেও নগর সভ্যতায় মানুষ যে কী দুর্বিষহ, অকল্পনীয়, অমানবিকতার মাঝে জীবনযাপন করতে পারে এর সঙ্গে তুলনাযোগ্য আর দ্বিতীয় কোনো নজির বাংলাদেশে আপাতত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ১৬ কোটি স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনাচারের মাঝে এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ অমানবিকতার ক্যাম্প লালন করার মাঝে বহু ধরনের সমাজতাত্তি্বক ও মনোজাগতিক বার্তা আছে। বুদ্ধিমান অনুসন্ধানকারী মাত্রই সেসব বার্তার তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।
দেশজুড়ে 'বিহারি' জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ রকম ক্যাম্প আছে ৭০টি। ১৯৭২ থেকে এই মানুষরা ক্যাম্পবদ্ধ। প্রায় তিন লাখ 'শরণার্থী' ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে এসব ক্যাম্পে। রাজধানীর বাইরের আগ্রহীরাও তাদের আশপাশের ক্যাম্পে ঢুঁ মারতে পারেন। এ বিষয়ে মননশীল ক্ষুধা নিবৃত্তির সুযোগ রয়েছে পুরো বাংলাদেশেই।
এ লেখায় বারবার 'বিহারি' সম্বোধন করা হচ্ছে; কারণ বাংলাদেশ যে এই ক্যাম্পবাসীদের এখনও 'মানুষ' মনে করে না তা বহুভাবে স্পষ্ট। নচেৎ এভাবে তাদের রাখা হতো না; এভাবে তাদের থাকতে হতো না।
কিন্তু মুশকিল হলো 'বিহারি' পরিবারের শিশুগুলো তো মানুষ; গত ৪০ বছর ধরে 'জেনেভা ক্যাম্প'গুলোতে যেসব শিশু জন্ম নিয়ে চলেছে তারা যখন প্রশ্ন করে, আমরা কেন এই রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত নূ্যনতম নাগরিক সুবিধাটুকুও পাব না, তখন উত্তর দেওয়া কঠিন বৈকি। উপমহাদেশের ইতিহাস এই শিশুদের মোকাবেলা করতে তখন প্রকৃতই ব্যর্থ। তাদের বাসস্থানের নামের সঙ্গে কীভাবে সুইজারল্যান্ডের রাজধানীর নাম এসে যুক্ত হলো সেও বহু ব্যাখ্যা করেই তাদের বোঝাতে হয়।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আজকের বিহারি শিশুদের পূর্বপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়ক মিলিশিয়া ছিল। ঐতিহাসিক সেই অপরাধের বিচার করতে পারিনি আমরা। বিহারিদেরও একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিজস্ব নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য বিস্তর মাশুল দিতে হয়েছে।
পাশাপাশি যুদ্ধে জিতেও পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে ব্যর্থ বাংলাদেশ সরকার। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যে কোনোভাবেই বাংলাদেশস্থ 'বিহারি'দের প্রতি তার নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। সে সত্য বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরার দায় থেকে কবে যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষ্কৃতি পেল তাও বোঝা মুশকিল। এমনকি পাকিস্তানের কাছে আমাদের সম্পদগত যে পাওনা ছিল সেটা আদায়ের প্রসঙ্গও আজ আর শোনা যায় না। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরপর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার চার বিলিয়ন ডলারের সমমানের সম্পদগত হিস্যার দাবি তুলেছিল। তাছাড়া সত্তরের সাইক্লোনে পূর্ববাংলার মানুষের জন্য বিশ্ব সমাজ পাকিস্তানকে যে দুইশ' মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল সেটাও আমরা পাইনি। আমাদের সাম্প্রতিক সরকারগুলো এসব বিষয়ে কী বিবেচনায় উদাসীন হয়ে গেল তা বোধগম্য নয়। প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক এত সব ব্যর্থতার দায় আড়াল করতেই বোধ হয় 'ক্যাম্প'গুলো লালন করা হচ্ছে এ দেশে। পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়াগত সব ব্যর্থতার দায় বইবে আজ ও আগামী দিনের বিহারি শিশুরা! যেভাবে ভারত-পাকিস্তানের নানা দরকষাকষির দায় বইছে কাশ্মীরি নিষ্পাপ তারুণ্য।
কমিউনিটিগতভাবে বিহারিরাও হয়তো এরূপ ভবিষ্যৎ আগেই আন্দাজ করে থাকবেন। যে কারণে ১৯৭২ সালে প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার বিহারি পশ্চিম পাকিস্তান চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ১৯৮২ সালের দিকে প্রায় সোয়া লাখ চলেও গিয়েছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠই ইতিহাস ও নিয়তির হাতে আজও বন্দি। পাকিস্তান গমনে ইচ্ছুক এই বিহারিদের সাময়িক অবস্থানের জন্য (সর্বোচ্চ তিন বছর) আলোচিত ক্যাম্পগুলো নির্মিত হয়েছিল ১৯৭২-এ।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪০ বছর। অনেক বড় সময় বৈকি। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখেছি, ৪০.১১ বিঘার ওপর ৫ হাজার ৫০০ পরিবার থাকছে! বিস্ময়কর ঘনত্ব। এই বিশাল সংখ্যার শরণার্থীরা প্রতিদিন যে ময়লা পয়দা করে সেটাও সিটি করপোরেশন সরায় না। কারণ এরা যে এখনও ক্যাম্পের বাসিন্দা, 'শরণার্থী'। এই শরণার্থীদের আবার সরকার ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে রেখেছে। শরণার্থী হলেও ক্ষমতার সমীকরণে তাদের পাঁচ বছর পরপর ভোটকেন্দ্রে নিয়ে অনেকে লাভবান হন। আবার ভোটার আইডি কার্ড দেওয়া হলেও সেই কার্ড দিয়ে আশপাশের 'বাঙালি সমাজ' যেসব নাগরিক সুবিধার দাবি করতে পারে, ক্যাম্পবাসী তা পারে না। সেক্ষেত্রে 'সরকারি অনুমোদন' নেই। দেশের বহু নির্বাচনী এলাকায় বিহারিরা গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক এখন। কিন্তু জাতীয় সংসদে তাদের ভোটে নির্বাচিত কোনো 'জনপ্রতিনিধি' কখনও ক্যাম্প জীবনের দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন বলে শোনা যায় না। চূড়ান্ত সত্য কেবল এটুকুই, আট ফুট বাই আট ফুটের মাঝে ৪০ বছর ধরে প্রতিটি পরিবার থাকছে সেখানে। ইতিমধ্যে এই চৌহদ্দিতে তিন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। একই কক্ষে পিতা-মাতার পাশেই ঘুমাতে হচ্ছে ছেলে ও ছেলের বৌকে। কখনও কখনও মেয়ে ও মেয়ের জামাইকেও। প্রকৃতই অসম্ভব এক জীবনযাপন। ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ারও জো নেই। আজও 'মুহাজির', 'নন-বেঙ্গলি', 'রিফুইজি', 'মাড়ূয়া' ইত্যাদি বহু নামে ডাকা হয় ক্যাম্পবাসী শরণার্থীদের। এসব সম্বোধনের মুখোমুখি হতে হয় ক্যাম্পবাসী শিশুদের আশপাশের স্কুলেও। এক সময় হতোদ্যম হয়ে শিক্ষার পাঠ ছেড়ে দেয় ওই শিশুরা। তাতে অবশ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য' বাধাগ্রস্ত হয় না; কারণ তারা তো আর বাঙালি শিশু নয়! ক্যাম্পবাসী অনেক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। বাঙালিরা বোধগম্য কারণেই তাদের বিয়ে করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু বিহারি ছেলেরাও অনাগ্রহী এ কারণে যে, বৌকে নিয়ে থাকবে কোথায়? রাজনীতি ও ইতিহাস এভাবেই বোধহয় দাম্পত্য সম্পর্কেও ঢুকে পড়ে।
এই লেখার শুরুতে জীবনানন্দ দাশের 'ক্যাম্পে' কবিতার উলেল্গখ করা হয়েছে। কবিতাটি লেখার পর কবিকে তীব্র সামাজিক বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও পড়েছিলেন তিনি। তৎকালীন সমাজে ক্যাম্পকে শনাক্ত করা হয়েছিল 'অশল্গীলতার ডিপো' হিসেবে। আমাদের 'জেনেভা ক্যাম্প'গুলো প্রকৃতই 'অশল্গীলতার ডিপো'। জগতের সব অসভ্যতা, উদাসীনতা, দারিদ্র্য যেন সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পের প্রতি ইঞ্চিতে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের মার্চে একটি খবর বেরিয়েছিল যে, মোহাম্মদপুর এলাকার ক্যাম্পগুলো ভেঙে বিহারিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ৪৫টি সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের এই উদ্যোগ সম্পর্কে এরপর থেকে আর সামান্যতম অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানা যায় না। ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে স্বাভাবিক নাগরিক জীবনযাপনের কোনো উদ্যোগ বা অন্যত্র বিহারিদের 'মানুষের মতো' করে পুনর্বাসনের কোনো আয়োজন নিয়ে বহু অনুসন্ধানের পরও কোনো সংবাদ দিতে পারেননি সরকারি-বেসরকারি কেউ। অন্যদিকে ক্যাম্পে বসবাস করলেও ২০০৩ সাল থেকে এই জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত রেশন ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়েছে। যত দূর জানা যায়, ঊনসত্তরের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বাংলার পাশাপাশি উর্দুতে তার নির্বাচনী মেনিফেস্টো ছেপেছিল এবং 'উর্দুবাসীদের এখানেই ভালোভাবে পুনর্বাসনে'র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অনেক উর্দুবাসী মনে করেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অশান্তি মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে বিহারিদের ক্ষেত্রেও সাহসী উদ্যোগ নিয়ে ঐতিহাসিক যন্ত্রণার হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি দিতে পারে।
আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
২০১১ সালে এসেও নগর সভ্যতায় মানুষ যে কী দুর্বিষহ, অকল্পনীয়, অমানবিকতার মাঝে জীবনযাপন করতে পারে এর সঙ্গে তুলনাযোগ্য আর দ্বিতীয় কোনো নজির বাংলাদেশে আপাতত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ১৬ কোটি স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনাচারের মাঝে এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ অমানবিকতার ক্যাম্প লালন করার মাঝে বহু ধরনের সমাজতাত্তি্বক ও মনোজাগতিক বার্তা আছে। বুদ্ধিমান অনুসন্ধানকারী মাত্রই সেসব বার্তার তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।
দেশজুড়ে 'বিহারি' জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ রকম ক্যাম্প আছে ৭০টি। ১৯৭২ থেকে এই মানুষরা ক্যাম্পবদ্ধ। প্রায় তিন লাখ 'শরণার্থী' ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে এসব ক্যাম্পে। রাজধানীর বাইরের আগ্রহীরাও তাদের আশপাশের ক্যাম্পে ঢুঁ মারতে পারেন। এ বিষয়ে মননশীল ক্ষুধা নিবৃত্তির সুযোগ রয়েছে পুরো বাংলাদেশেই।
এ লেখায় বারবার 'বিহারি' সম্বোধন করা হচ্ছে; কারণ বাংলাদেশ যে এই ক্যাম্পবাসীদের এখনও 'মানুষ' মনে করে না তা বহুভাবে স্পষ্ট। নচেৎ এভাবে তাদের রাখা হতো না; এভাবে তাদের থাকতে হতো না।
কিন্তু মুশকিল হলো 'বিহারি' পরিবারের শিশুগুলো তো মানুষ; গত ৪০ বছর ধরে 'জেনেভা ক্যাম্প'গুলোতে যেসব শিশু জন্ম নিয়ে চলেছে তারা যখন প্রশ্ন করে, আমরা কেন এই রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত নূ্যনতম নাগরিক সুবিধাটুকুও পাব না, তখন উত্তর দেওয়া কঠিন বৈকি। উপমহাদেশের ইতিহাস এই শিশুদের মোকাবেলা করতে তখন প্রকৃতই ব্যর্থ। তাদের বাসস্থানের নামের সঙ্গে কীভাবে সুইজারল্যান্ডের রাজধানীর নাম এসে যুক্ত হলো সেও বহু ব্যাখ্যা করেই তাদের বোঝাতে হয়।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আজকের বিহারি শিশুদের পূর্বপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়ক মিলিশিয়া ছিল। ঐতিহাসিক সেই অপরাধের বিচার করতে পারিনি আমরা। বিহারিদেরও একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিজস্ব নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য বিস্তর মাশুল দিতে হয়েছে।
পাশাপাশি যুদ্ধে জিতেও পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে ব্যর্থ বাংলাদেশ সরকার। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যে কোনোভাবেই বাংলাদেশস্থ 'বিহারি'দের প্রতি তার নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। সে সত্য বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরার দায় থেকে কবে যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষ্কৃতি পেল তাও বোঝা মুশকিল। এমনকি পাকিস্তানের কাছে আমাদের সম্পদগত যে পাওনা ছিল সেটা আদায়ের প্রসঙ্গও আজ আর শোনা যায় না। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরপর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার চার বিলিয়ন ডলারের সমমানের সম্পদগত হিস্যার দাবি তুলেছিল। তাছাড়া সত্তরের সাইক্লোনে পূর্ববাংলার মানুষের জন্য বিশ্ব সমাজ পাকিস্তানকে যে দুইশ' মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল সেটাও আমরা পাইনি। আমাদের সাম্প্রতিক সরকারগুলো এসব বিষয়ে কী বিবেচনায় উদাসীন হয়ে গেল তা বোধগম্য নয়। প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক এত সব ব্যর্থতার দায় আড়াল করতেই বোধ হয় 'ক্যাম্প'গুলো লালন করা হচ্ছে এ দেশে। পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়াগত সব ব্যর্থতার দায় বইবে আজ ও আগামী দিনের বিহারি শিশুরা! যেভাবে ভারত-পাকিস্তানের নানা দরকষাকষির দায় বইছে কাশ্মীরি নিষ্পাপ তারুণ্য।
কমিউনিটিগতভাবে বিহারিরাও হয়তো এরূপ ভবিষ্যৎ আগেই আন্দাজ করে থাকবেন। যে কারণে ১৯৭২ সালে প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার বিহারি পশ্চিম পাকিস্তান চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ১৯৮২ সালের দিকে প্রায় সোয়া লাখ চলেও গিয়েছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠই ইতিহাস ও নিয়তির হাতে আজও বন্দি। পাকিস্তান গমনে ইচ্ছুক এই বিহারিদের সাময়িক অবস্থানের জন্য (সর্বোচ্চ তিন বছর) আলোচিত ক্যাম্পগুলো নির্মিত হয়েছিল ১৯৭২-এ।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪০ বছর। অনেক বড় সময় বৈকি। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখেছি, ৪০.১১ বিঘার ওপর ৫ হাজার ৫০০ পরিবার থাকছে! বিস্ময়কর ঘনত্ব। এই বিশাল সংখ্যার শরণার্থীরা প্রতিদিন যে ময়লা পয়দা করে সেটাও সিটি করপোরেশন সরায় না। কারণ এরা যে এখনও ক্যাম্পের বাসিন্দা, 'শরণার্থী'। এই শরণার্থীদের আবার সরকার ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে রেখেছে। শরণার্থী হলেও ক্ষমতার সমীকরণে তাদের পাঁচ বছর পরপর ভোটকেন্দ্রে নিয়ে অনেকে লাভবান হন। আবার ভোটার আইডি কার্ড দেওয়া হলেও সেই কার্ড দিয়ে আশপাশের 'বাঙালি সমাজ' যেসব নাগরিক সুবিধার দাবি করতে পারে, ক্যাম্পবাসী তা পারে না। সেক্ষেত্রে 'সরকারি অনুমোদন' নেই। দেশের বহু নির্বাচনী এলাকায় বিহারিরা গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক এখন। কিন্তু জাতীয় সংসদে তাদের ভোটে নির্বাচিত কোনো 'জনপ্রতিনিধি' কখনও ক্যাম্প জীবনের দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন বলে শোনা যায় না। চূড়ান্ত সত্য কেবল এটুকুই, আট ফুট বাই আট ফুটের মাঝে ৪০ বছর ধরে প্রতিটি পরিবার থাকছে সেখানে। ইতিমধ্যে এই চৌহদ্দিতে তিন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। একই কক্ষে পিতা-মাতার পাশেই ঘুমাতে হচ্ছে ছেলে ও ছেলের বৌকে। কখনও কখনও মেয়ে ও মেয়ের জামাইকেও। প্রকৃতই অসম্ভব এক জীবনযাপন। ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ারও জো নেই। আজও 'মুহাজির', 'নন-বেঙ্গলি', 'রিফুইজি', 'মাড়ূয়া' ইত্যাদি বহু নামে ডাকা হয় ক্যাম্পবাসী শরণার্থীদের। এসব সম্বোধনের মুখোমুখি হতে হয় ক্যাম্পবাসী শিশুদের আশপাশের স্কুলেও। এক সময় হতোদ্যম হয়ে শিক্ষার পাঠ ছেড়ে দেয় ওই শিশুরা। তাতে অবশ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য' বাধাগ্রস্ত হয় না; কারণ তারা তো আর বাঙালি শিশু নয়! ক্যাম্পবাসী অনেক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। বাঙালিরা বোধগম্য কারণেই তাদের বিয়ে করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু বিহারি ছেলেরাও অনাগ্রহী এ কারণে যে, বৌকে নিয়ে থাকবে কোথায়? রাজনীতি ও ইতিহাস এভাবেই বোধহয় দাম্পত্য সম্পর্কেও ঢুকে পড়ে।
এই লেখার শুরুতে জীবনানন্দ দাশের 'ক্যাম্পে' কবিতার উলেল্গখ করা হয়েছে। কবিতাটি লেখার পর কবিকে তীব্র সামাজিক বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও পড়েছিলেন তিনি। তৎকালীন সমাজে ক্যাম্পকে শনাক্ত করা হয়েছিল 'অশল্গীলতার ডিপো' হিসেবে। আমাদের 'জেনেভা ক্যাম্প'গুলো প্রকৃতই 'অশল্গীলতার ডিপো'। জগতের সব অসভ্যতা, উদাসীনতা, দারিদ্র্য যেন সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পের প্রতি ইঞ্চিতে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের মার্চে একটি খবর বেরিয়েছিল যে, মোহাম্মদপুর এলাকার ক্যাম্পগুলো ভেঙে বিহারিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ৪৫টি সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের এই উদ্যোগ সম্পর্কে এরপর থেকে আর সামান্যতম অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানা যায় না। ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে স্বাভাবিক নাগরিক জীবনযাপনের কোনো উদ্যোগ বা অন্যত্র বিহারিদের 'মানুষের মতো' করে পুনর্বাসনের কোনো আয়োজন নিয়ে বহু অনুসন্ধানের পরও কোনো সংবাদ দিতে পারেননি সরকারি-বেসরকারি কেউ। অন্যদিকে ক্যাম্পে বসবাস করলেও ২০০৩ সাল থেকে এই জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত রেশন ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়েছে। যত দূর জানা যায়, ঊনসত্তরের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বাংলার পাশাপাশি উর্দুতে তার নির্বাচনী মেনিফেস্টো ছেপেছিল এবং 'উর্দুবাসীদের এখানেই ভালোভাবে পুনর্বাসনে'র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অনেক উর্দুবাসী মনে করেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অশান্তি মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে বিহারিদের ক্ষেত্রেও সাহসী উদ্যোগ নিয়ে ঐতিহাসিক যন্ত্রণার হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি দিতে পারে।
আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
No comments