বিজয় দিবস ২০১১-বিজয়ের ৪০ বছর ও যুদ্ধাপরাধের বিচার by শহিদুল ইসলাম
এক. স্বাধীনতার ৪০ বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে দেশ আজ সোচ্চার। প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হলো, এই ৪০ বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচার হলো না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলা যায়, দেশে প্রতিষ্ঠিত সরকারই সে বিচারের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এখন প্রশ্ন আসে, এই ৪০ বছর তো বাংলাদেশ কখনো সরকারবিহীন চলেনি। এই ৪০ বছর যেসব রাজনৈতিক দল কিংবা অবৈধ হলেও সামরিক সরকার বাংলাদেশ শাসন করেছে, সেসব
সরকার কী করেছে? যুদ্ধাপরাধের বিচার করল না কেন? তাই এ কথা বলা যায়, বিগত ৪০ বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচার না হওয়ার ব্যর্থতার দায়ভার ওইসব রাজনৈতিক দল কিংবা সামরিক ব্যক্তিত্বের ওপরই বর্তায়। তাদের এ ব্যর্থতার দায়ভার দীর্ঘ ৪০ বছর এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হচ্ছে। একটু হিসাব নেওয়া যাক, কারা বা কোন দল বিগত ৪০ বছর দেশ শাসন করেছে। স্বাধীনতার পর প্রথম সাড়ে তিন বছর শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দেশটি শাসন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগত করেন মেজর জিয়াউর রহমান। প্রথমে তাঁর কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। ক্ষমতায় বসে বিভিন্ন দলের চরিত্রহীন রাজনীতিবিদদের নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) জন্ম দেন। ১৯৮১ সালের ৩১ মে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই দেশ পরিচালনা করেন। তাঁকে হত্যা করার পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেন এবং ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে পতনের আগ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। অতঃপর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে এক সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দেশীয় দালাল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবারও বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং পাঁচ বছর দেশ শাসন করে। মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুখোশ এঁটে জেনারেল মইনের নেতৃত্বে দেশে এক অঘোষিত সামরিক শাসন ক্ষমতায় বসে। ২০০৮ সালে সেই অবৈধ সরকারের অধীনে এক নির্বাচনে আবারও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং এখনো দেশ শাসন করছে।
দুই. শেখ মুজিবের শাসনামলে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ কোলাবরেটর (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) এবং ওই বছর ১০ জুন কুষ্টিয়ায় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল সর্বপ্রথম একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে এবং তার ফাঁসির আদেশ দেয়। Bangladesh collaborators (Special Tribunal) Order, 1972-এর ৩০২ ধারায় কুষ্টিয়ার মিরপুরের চিকন আলীর বিচার শুরু হয় ৮ জুন, ১৯৭২। তার অপরাধ ছিল এই যে সে রাজাকার ছিল। সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে সহায়তা দান করে। চিকন আলীর উকিল বলেন, চিকন আলী রাজাকার ছিল না_ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু প্রমাণ সাপেক্ষে বিচারক তার ফাঁসির আদেশ দেন। তবে সে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পেয়েছিল। এই একটি বা দুটি ঘটনার উল্লেখ প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি দালালদের বিচার শুরু হয়েছিল। ন্যুরেমবার্গ চার্টার ও জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পূর্ণ অধিকার আছে বাংলাদেশের। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে যুদ্ধাপরাধ বলতে বোঝায়_ক. শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, খ. যুদ্ধাপরাধ ও গ. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তদুপরি জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী যে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ওই সব অপরাধ সংঘটিত হয়, সেই রাষ্ট্রের আইনগত অধিকার আছে ওই সব অপরাধের বিচার করা। এমনকি ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিরাও যদি ওই সব অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাদেরও বিচার ও শাস্তি প্রদান করা আইনের চোখে বৈধ। তাই স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার বৈধ আইনের আওতায় বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) ১৯৭২ গঠন করেছিল।
তিন. কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর অবৈধ সামরিক শাসক মেজর জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ওই দালাল আইনটি বাতিল করে ওই আইনে ধৃত সব দালালকে মুক্তি দেন এবং রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজকে, যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে বিশ্বজনমত বিপক্ষে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন, জিয়াউর রহমান তাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে তাঁর নিজের রাজনৈতিক আদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের আবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন। এভাবেই জিয়াউর রহমানের সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, তাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সিপাহি এরশাদের প্রায় ১০ বছরের বাংলাদেশবিরোধী শাসন শুরু হয়। তিনিও রাজাকার-আলবদরদের মধ্যে বসবাস করতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এরশাদের পতনের পর এ দেশে তথাকথিত 'নির্বাচনী গণতন্ত্র' শুরু হয়। প্রথম নির্বাচিত সরকার খালেদা জিয়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা মুখে আনেননি। বরং রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচারের পথের সব বাধা অপসারণ করে শেখ মুজিব হত্যার বিচারকাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু সে দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগেই ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়; আবার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং বিচারের সে রায় কার্যকরের সম্ভাবনা ঝুলে যায়। যত দিন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সে রায় কার্যকর হয়নি। উপরন্তু নিজামী-মুজাহিদ মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দুই বছরের 'তত্ত্বাবধায়ক সামরিক শাসনামলে' যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথাবার্তা শোনা গেলেও মইন ঝুঁকি নিতে চাননি। দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য Bangladesh Collaborators (Special Tribunal) পুনরুজ্জীবিত করে কয়েকজন প্রধান যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করেছেন। সবেমাত্র চার্জশিট হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে সে বিচারকাজ সম্পন্ন হবে বলে কেউ মনে করেন না। আর এটা প্রমাণিত সত্য যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবার ওই খুনি, ধর্ষক, লুটপাটকারীরা মন্ত্রিসভায় স্থান পাবে। ইতিমধ্যে তার প্রমাণ দেশবাসী পেয়ে গেছে।
চার. গত ৩ ডিসেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিলেন যে 'বিএনপি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে।' বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদর্শই প্রচার করলেন ব্যারিস্টার মওদুদ। রোডমার্চের একপর্যায়ে খালেদা জিয়া বগুড়ায় বলেছেন, 'যে বিচারপ্রক্রিয়া শেখ হাসিনা শুরু করেছেন, সেটা বিচার নয়, প্রহসন। চারদলীয় জোটকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সরকার এই বিচার করছে। সেই জন্য নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকাচৌকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।' এই বিচারের বিরোধিতা করে ও ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে বিএনপি প্রমাণ করল যে দলটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। অনেকেই বিএনপির জামায়াত-নির্ভরতার কথা বলে থাকে। কিন্তু আজ প্রমাণ হলো, বিএনপি, জামায়াত ও মুসলিম লীগ আলাদা কোনো দল নয়। তিনটি দলই পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। জামায়াত এ দেশে আল্লাহর শাসন কায়েম করে ক্ষমতায় বসতে চায়। বিএনপির গঠনতন্ত্রে পরিষ্কার ভাষায় লেখা আছে, বিএনপি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। খালেদাসহ বিএনপির নেতারা আজ আবার বলতে শুরু করেছেন, 'আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে নই। তবে বিচারপ্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।' তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আপনারা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন; 'স্বচ্ছ' ও 'নিরপেক্ষভাবে' বিচার করলেই পারতেন। আপনাদের তো কেউ বাধা দেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে 'যুদ্ধাপরাধের' বিচার করা যায় না, এই বোধটুকু এ দেশের সাধারণ মানুষের আছে। যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকাচৌ খালেদা জিয়ার চোখে 'স্বাধীনতাবিরোধী' নন। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক! তাই ৩ ডিসেম্বরের ওই সংবাদ সম্মেলনে মওদুদ দাবি করেন, 'অবিলম্বে এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাতিল করা হোক।' তাঁর এই দাবিতে আজ দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি আরো জোরে উচ্চারিত হচ্ছে। জনগণের এই ক্ষোভ লাঘব করার চেষ্টায় বিএনপির নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। বারবার বলতে হচ্ছে, 'আমরা বিচারের বিরুদ্ধে নই।' এভাবেই বিএনপির রাজাকারপ্রীতি দেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিকে এক আলাদা মাত্রা প্রদান করেছে। বিএনপি আজ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলে প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে। স্বাধীনতার ৪০ বছরে আমরা যুদ্ধাপরাধ বিচার করতে পারিনি এটা ঠিক; কিন্তু যুদ্ধাপরাধের পক্ষের শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
দুই. শেখ মুজিবের শাসনামলে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ কোলাবরেটর (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) এবং ওই বছর ১০ জুন কুষ্টিয়ায় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল সর্বপ্রথম একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে এবং তার ফাঁসির আদেশ দেয়। Bangladesh collaborators (Special Tribunal) Order, 1972-এর ৩০২ ধারায় কুষ্টিয়ার মিরপুরের চিকন আলীর বিচার শুরু হয় ৮ জুন, ১৯৭২। তার অপরাধ ছিল এই যে সে রাজাকার ছিল। সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে সহায়তা দান করে। চিকন আলীর উকিল বলেন, চিকন আলী রাজাকার ছিল না_ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু প্রমাণ সাপেক্ষে বিচারক তার ফাঁসির আদেশ দেন। তবে সে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পেয়েছিল। এই একটি বা দুটি ঘটনার উল্লেখ প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি দালালদের বিচার শুরু হয়েছিল। ন্যুরেমবার্গ চার্টার ও জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পূর্ণ অধিকার আছে বাংলাদেশের। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে যুদ্ধাপরাধ বলতে বোঝায়_ক. শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, খ. যুদ্ধাপরাধ ও গ. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তদুপরি জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী যে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ওই সব অপরাধ সংঘটিত হয়, সেই রাষ্ট্রের আইনগত অধিকার আছে ওই সব অপরাধের বিচার করা। এমনকি ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিরাও যদি ওই সব অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাদেরও বিচার ও শাস্তি প্রদান করা আইনের চোখে বৈধ। তাই স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার বৈধ আইনের আওতায় বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) ১৯৭২ গঠন করেছিল।
তিন. কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর অবৈধ সামরিক শাসক মেজর জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ওই দালাল আইনটি বাতিল করে ওই আইনে ধৃত সব দালালকে মুক্তি দেন এবং রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজকে, যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে বিশ্বজনমত বিপক্ষে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন, জিয়াউর রহমান তাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে তাঁর নিজের রাজনৈতিক আদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাদের আবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন। এভাবেই জিয়াউর রহমানের সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, তাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সিপাহি এরশাদের প্রায় ১০ বছরের বাংলাদেশবিরোধী শাসন শুরু হয়। তিনিও রাজাকার-আলবদরদের মধ্যে বসবাস করতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এরশাদের পতনের পর এ দেশে তথাকথিত 'নির্বাচনী গণতন্ত্র' শুরু হয়। প্রথম নির্বাচিত সরকার খালেদা জিয়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা মুখে আনেননি। বরং রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচারের পথের সব বাধা অপসারণ করে শেখ মুজিব হত্যার বিচারকাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু সে দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগেই ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়; আবার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং বিচারের সে রায় কার্যকরের সম্ভাবনা ঝুলে যায়। যত দিন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সে রায় কার্যকর হয়নি। উপরন্তু নিজামী-মুজাহিদ মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দুই বছরের 'তত্ত্বাবধায়ক সামরিক শাসনামলে' যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথাবার্তা শোনা গেলেও মইন ঝুঁকি নিতে চাননি। দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য Bangladesh Collaborators (Special Tribunal) পুনরুজ্জীবিত করে কয়েকজন প্রধান যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করেছেন। সবেমাত্র চার্জশিট হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে সে বিচারকাজ সম্পন্ন হবে বলে কেউ মনে করেন না। আর এটা প্রমাণিত সত্য যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবার ওই খুনি, ধর্ষক, লুটপাটকারীরা মন্ত্রিসভায় স্থান পাবে। ইতিমধ্যে তার প্রমাণ দেশবাসী পেয়ে গেছে।
চার. গত ৩ ডিসেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিলেন যে 'বিএনপি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে।' বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদর্শই প্রচার করলেন ব্যারিস্টার মওদুদ। রোডমার্চের একপর্যায়ে খালেদা জিয়া বগুড়ায় বলেছেন, 'যে বিচারপ্রক্রিয়া শেখ হাসিনা শুরু করেছেন, সেটা বিচার নয়, প্রহসন। চারদলীয় জোটকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সরকার এই বিচার করছে। সেই জন্য নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকাচৌকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।' এই বিচারের বিরোধিতা করে ও ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে বিএনপি প্রমাণ করল যে দলটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। অনেকেই বিএনপির জামায়াত-নির্ভরতার কথা বলে থাকে। কিন্তু আজ প্রমাণ হলো, বিএনপি, জামায়াত ও মুসলিম লীগ আলাদা কোনো দল নয়। তিনটি দলই পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। জামায়াত এ দেশে আল্লাহর শাসন কায়েম করে ক্ষমতায় বসতে চায়। বিএনপির গঠনতন্ত্রে পরিষ্কার ভাষায় লেখা আছে, বিএনপি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। খালেদাসহ বিএনপির নেতারা আজ আবার বলতে শুরু করেছেন, 'আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে নই। তবে বিচারপ্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।' তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আপনারা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন; 'স্বচ্ছ' ও 'নিরপেক্ষভাবে' বিচার করলেই পারতেন। আপনাদের তো কেউ বাধা দেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে 'যুদ্ধাপরাধের' বিচার করা যায় না, এই বোধটুকু এ দেশের সাধারণ মানুষের আছে। যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকাচৌ খালেদা জিয়ার চোখে 'স্বাধীনতাবিরোধী' নন। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক! তাই ৩ ডিসেম্বরের ওই সংবাদ সম্মেলনে মওদুদ দাবি করেন, 'অবিলম্বে এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাতিল করা হোক।' তাঁর এই দাবিতে আজ দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি আরো জোরে উচ্চারিত হচ্ছে। জনগণের এই ক্ষোভ লাঘব করার চেষ্টায় বিএনপির নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। বারবার বলতে হচ্ছে, 'আমরা বিচারের বিরুদ্ধে নই।' এভাবেই বিএনপির রাজাকারপ্রীতি দেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিকে এক আলাদা মাত্রা প্রদান করেছে। বিএনপি আজ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলে প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে। স্বাধীনতার ৪০ বছরে আমরা যুদ্ধাপরাধ বিচার করতে পারিনি এটা ঠিক; কিন্তু যুদ্ধাপরাধের পক্ষের শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments