বিজয় দিবসে স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

শ্মশ্রুশোভিত তরুণ কণ্ঠশিল্পী হায়দারের একটা গান আমার খুব ভালো লাগে। বারবার শুনি। কিছু কথা হৃদয়ের গভীরে আঘাত হানে। দলিত-মথিত করে। তবুও শুনি। আবারও শুনি। 'কি বলার ছিল, কি বলছি। কি শোনার ছিল, কি শুনছি। কি দেখার ছিল, কি দেখছি। তিরিশটি বছর আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি...।' হায়দার গানটা হয়তো ২০০১ সালে রচনা করে থাকবেন। আজ ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে গানটা আমার কাছে আরো অর্থবহ আরো


বেদনাদায়ক মনে হয়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ ঘোর অন্ধকার হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে তন্ন তন্ন করে স্বাধীনতাটাকে খুঁজছে। কোথায় তুমি হে আমার স্বাধীনতা? কোথায় তুমি আমার মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ফসল? বাংলার মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র আপামর জনতা অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। বাংলার শ্যামল প্রান্তর লক্ষ-নিযুত শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার এ বিস্তৃত ভূখণ্ডে, এ বিশাল উপমহাদেশের আর কোনো দেশে এমন তো আর হয়নি। এত ত্যাগ, এত বিসর্জন আর কোনো দেশকে তা দিতে হয়নি। কোনো দেশের প্রত্যেক মানুষকে অস্ত্র হাতে এমনভাবে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা তো আনতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে করেছে মহিমান্বিত। ইতিহাসকে করেছে গৌরবোজ্জ্বল আর ঐশ্বর্যমণ্ডিত। বাংলাদেশকে একসঙ্গে ব্রাকেটবন্দি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন, ভিয়েতনামের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। হাজার বছরের ইতিহাসে আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে গৌরবের এক মহান অধ্যায়। চিন্তা করলেও কী এক অপূর্ব অনুভূতি জাগায়। সারা দেহে এক রোমাঞ্চ আনে। বুক ফুলে ফুলে ওঠে। আমার মস্তক হিমালয়ে দেখি।
বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতার এক অদম্য স্পৃহা তাদের ঠেলে দিয়েছিল যুদ্ধে। নিপীড়িত বাংলার মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘিষ্ঠ এক দুর্বৃত্ত শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত ও শোষিত। মুক্তিযুদ্ধ বাংলার মানুষের স্বাধীনতার প্রশ্নে দীর্ঘ সংগ্রামে চূড়ান্ত পর্ব। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। আমাদের প্রথম এক স্বাধীনসত্তার বীজ রোপণ করে। বঙ্গভঙ্গ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হিংসা-বিদ্বেষ আর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রহিত হয় বঙ্গভঙ্গ ১৯১১ সালে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের স্বাধিকারের সংগ্রাম থেমে থাকেনি। ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরেবাংলা ফজলুল হকের প্রস্তাবিত লাহোর প্রস্তাব (ব্রিটিশের ভারত বিভক্তির কর্মসূচিতে ভারতবর্ষের পূর্বে ও পশ্চিমে দুই মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে) সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ভারত বিভক্ত হলো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলো। বিভক্ত ভারত স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হলো। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের সত্যিকার বাস্তবায়ন গোষ্ঠীস্বার্থে কপটতা আর কৌশলী ষড়যন্ত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলো। আজকের বাংলাদেশ নামক এ ভূখণ্ড পাকিস্তানেরই একটি অংশ হয়ে থাকল। ১৯৪৭-পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস, পূর্ব বাংলার মানুষের চরম বঞ্চনার ইতিহাস, পদানত মানবাধিকারের পদে লাঞ্ছনার ইতিহাস, চরম বৈষম্য-অপমান আর অবজ্ঞার ইতিহাস। আমাদের মনে করিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার চরম বর্ণবাদী ইতিহাসের কথা। এ যেন তারই এক এশীয় সংস্করণ।
নরম মাটির দেশ বাংলাদেশ। এখানের মানুষ ছোটখাটো। নরম, সহজ আর সরল। শাসক শ্রেণী বন্দুকের নল আর শক্তি দিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। ভাষার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে বাংলার মানুষকে ভিন ভাষা রাষ্ট্র ভাষা বলে জোর করে মুখে পুরে দিচ্ছিল। বাঙালি গর্জে উঠল। ঢাকার রাস্তায় মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিল। ইতিহাসে এমনটি আর কোথাও ঘটেনি। বাংলার মানুষের এমন মাতৃভক্তি, এমন মাতৃভাষাপ্রীতি পৃথিবী দেখেনি। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১। দীর্ঘ ১৯ বছরের বৈষম্য আর শোষণের পরিধি বিস্তৃত হতে বিস্তৃততর হতে থাকে। জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে তা তীব্রভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে জনগণের পর্বতপ্রমাণ রায়কে পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা শাসক দল পায়ে ঠেলে দেয় তাচ্ছিল্যভরে। বাংলার মানুষ, গোটা বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহায় ঐক্যবদ্ধ হয়। হাতে হাতিয়ার তুলে নেয়, সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এটা অবিসংবাদিত সত্য যে এ কঠিন মুক্তিযুদ্ধের মূলে যে চালিকাশক্তি ছিল, তা ছিল মানুষের সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য গণমানুষের অদম্য স্পৃহা আর তার ওপর প্রতিষ্ঠিত এক বঞ্চনাহীন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। আজ চার দশক সময় অতিবাহিত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। শিকড় প্রোথিত হয়নি। বারবার শুধু আছাড় খেয়েছে। কখনো স্বৈরতন্ত্র, কখনোবা সামরিক শাসন, কখনোবা নৈরাজ্য-নৈরাশ্য পথ রুদ্ধ করেছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান এই সেদিনও বাংলাদেশে bastardization of democracy গণতন্ত্রের জারজিকরণের কথা বলেছেন। বাজিকরদের শাসন বলেছেন। সব জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও সংসদ আজ চরমভাবে অকার্যকর। বিরোধী দল (সে যে দলই হোক না কেন) দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সংসদে অনুপস্থিত থেকেছে। সংসদে জাতীয় বড় বড় ইস্যু অনালোচিত থেকেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সব নদ-নদীর পানির উলঙ্গ অপহরণ, খাদ্য নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ নিরাপত্তা, সীমান্ত নিরাপত্তা, জাতীয় নিরাপত্তা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক অভিঘাত, সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্বসহ তালপট্টি দ্বীপের অধিকার, তেল-গ্যাস-কয়লা উত্তোলনে বৈদেশিক অসম চুক্তি ইত্যাদি অত্যন্ত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংসদে আলোচিত হয়নি। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, একটা সাংঘর্ষিক বিকৃত সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে জগদ্দল পাথরের মতো বাংলাদেশের রাজনীতিতে চেপে বসেছে। এর থেকে কোনো নিষ্কৃতি নেই, মুক্তি নেই। সরকার বদল হয়, শাসনযন্ত্রে পরিবর্তন আসে, দিনবদলের অঙ্গীকার হয়; কিন্তু সাংঘর্ষিক রাজনীতির রীতি-আচারের কখনো কোনো পরিবর্তন হয় না। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এ যেন পালাবদলের পালা মাত্র।
অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহে প্রসবিত এক দেশপ্রেমিক জাতীয় সেনাবাহিনী যার উত্থান, যার বিকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। এই সেই সেনাবাহিনী যে গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। ফোর্স সংগঠিত করেছে। অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। রসদ সম্ভার জুগিয়েছে। অভিযান পরিচালনা করেছে। শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। দেশকে স্বাধীন করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ বিনির্মাণে সীমাহীন অবদান রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে জাতীয় সব সংকটে এই সেনাবাহিনীর সাহসী সদস্যরাই জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সিডরে, আইলায়, প্লাবনে, জলোচ্ছ্বাসের মহাদুর্যোগে তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকেই ত্রাণকর্তা হিসেবে কাছে পেয়েছে। এ বাহিনীই জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় অখণ্ডতা নিশ্চিত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যে উত্তুঙ্গ পর্বতমালাসহ দেশের প্রতি ইঞ্চি পবিত্র ভূমি জীবনপণ করে ঘাম আর রক্ত ঝরিয়ে রক্ষা করেছে। জাতিকে আশার বাণী শুনিয়েছে। বাঁচার প্রেরণা দিয়েছে। সংকটে বিহ্বল জাতিকে উত্তরণ ঘটিয়েছে বারবার পৌনঃপুনিকভাবে। দেশকে দুর্যোগমুক্ত করেছে তা হোক প্রকৃতির অথবা দুর্বৃত্তসৃষ্ট। গণতন্ত্রের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। আর এসব করেছে এক কঠিন সময়ের অগি্নপরীক্ষার মধ্যে, সীমাহীন ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, কর্তব্যনিষ্ঠা আর প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম থেকে। তাই বিশ্বজুড়ে সেনাবাহিনী এত প্রশংসিত, এত সমাদৃত, এত নন্দিত। বিশ্ব শান্তি আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ যেন সমার্থক শব্দ। এত সম্পদ আর এত সম্ভাবনা নিয়েও কেন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে পারছে না? সে কেন এখনো শুধুই হামাগুড়ি খাচ্ছে এক বিকলাঙ্গ শিশুর মতো? আজ আশপাশের দেশগুলোর দিকে যখন তাকাই, দেখি তারা কী শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা সবাই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। অর্জন আর সাফল্য তাদের কদম ছুঁয়েছে। তারা সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তির পথ ধরে আগুয়ান তারা, নব নব দিগন্ত উন্মোচন করছে। বিশ্বসভায় নিজেদের গৌরব আর সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করছে। চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া_যেদিকে তাকাই শুধু জয়ধ্বনি শুনি। দেখি সবাই তো আমাদের পেছনে ফেলে দূর থেকে আরো দূরে এগিয়ে চলেছে। আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবসের প্রভাত সূর্যকে স্বাগত জানাই। তার আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার মাটিতে। মুক্ত হোক, নির্মল হোক বাংলার অবরুদ্ধ বায়ু। স্রোত হারানো বাংলার সব স্রোতস্বিনী, তিস্তা, করতোয়া, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কুশিয়ারা, বরাক, সুরমা ফিরে পাক তাদের স্রোতধারা। বাঁধ ভেঙে কূল ছাপিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাক সব নদ-নদী। বাংলার সাগর তাই তো সে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর হোক সীমাহীন, দিগন্ত, বিস্তৃত, সুরক্ষিত, একচ্ছত্র শুধু বাংলার। বাংলার আকাশ দিনের আলোয় হোক নীলিমায় নীল, আর রাতে লাখো-কোটি তারার আলোয় হোক ঝলমল। উত্তর আকাশের জ্বলজ্বল করা ধ্রুব তারাটিকে বাংলার দিশাহীন মানুষ প্রত্যক্ষ করুক, সহজেই চিনে নিক, দিশা পাক। এক জ্যোতির্ময়, মহাজ্ঞানী মহাজন মহাকল্যাণময় মহাপুরুষের আগমন হোক। এ দুর্ভাগা দেশ থেকে সব অপমানের গ্লানি অপসৃত হোক, পুঞ্জিত সব অভিমান বিস্মৃত হোক। সব দেহ, সব মন এক হোক। নব উদ্যমে, নব প্রত্যয়ে, নব প্রত্যাশায় আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে বিজয় দিবসের আজকের এই দিনে স্বাধীনতাটাকে আবিষ্কার করি, সোনার বাংলা গড়ি।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান

No comments

Powered by Blogger.