বিজয় দিবস-স্বাধীনতা কথাটির তাৎপর্য
বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনীয় একটি দিন নেই। কেননা, ১৯৭১ সালের আগে জাতি হিসেবে আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার বিরল অভিজ্ঞতা বাঙালি আর আস্বাদন করেনি। কখনও স্বাধীনতার বিভ্রম দেখা দিলেও পরক্ষণেই তা মায়া-মরীচিকা বলেই প্রতিভাত হয়েছে। শাসনের দণ্ড হস্তান্তর ছাড়া সে ঘটনাগুলোর বিশেষ তাৎপর্য জাতি অনুভব করেনি। দীর্ঘ অতীত জুড়ে বিদেশি শাসকের পদানত বাঙালির কাছে তাই স্বাধীনতা শব্দের প্রধান অর্থ_
পরাধীনতা থেকে মুক্তি। পরাধীনতার বিপরীত শব্দ স্বাধীনতা। আত্মশাসনের অধিকারই স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এ কথা সত্য যে, স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশ লালন করেছে অমিত সম্ভাবনা, আশা ও স্বপ্ন। হাজারো পিছুটান সত্ত্বেও দেশটির অগ্রগতি বিস্ময়কর। তারপরও অপ্রাপ্তির তালিকা দীর্ঘ। অনেকেই মনে করেন, দেশ সঠিক পথে চলেনি। চললে আরও অগ্রগতি নিশ্চিত হতো। সঠিক পথ অবশ্যই তা স্বাধীনতার পথ। গুণীরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বাধীনতার চেতনা থেকে বিচ্যুত হওয়া অন্যায়। কিন্তু বারবার এ দেশে ব্যত্যয় ঘটেছে। বিগত ৪০ বছরে সরকারগুলো স্বাধীনতার চেতনা থেকে বিচ্যুত তো হয়েছেই, কখনও কখনও এ চেতনার কথা বিস্মৃতও হয়েছে। স্বাধীন জাতির স্বাধীনতা কেউ ছিনিয়ে নেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা বলতে আমাদের বীর সেনানীরা যে সার্বিক চেতনার কথা বলেছেন, তা থেকে জাতি বিচ্যুত হয়েছে। স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত গণতন্ত্র বারবার পদদলিত হয়েছে। স্বাধীনতার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক 'আরব বসন্তে'র কথা অনেকেই স্মরণ করিয়ে দেন। আরব দেশগুলো স্বাধীন; নিজেদের জাতির লোকদের দ্বারা শাসিত। তারপরও সেখানকার অধিবাসীরা স্বাধীন নয়। দেশগুলোতে গণতন্ত্রের দাবিতে পথে নেমেছে লাখো মানুষ_ তাদের মুখে স্বাধীনতার দাবি। নিজের দেশের স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাতের সংগ্রামকে স্বাধীনতার দাবি হিসেবে উত্থাপনের এই উদাহরণ ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে আমরা সরকার নির্বাচিত করেছি। আরব বিশ্বের অচলায়তনসম স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না_ এটি যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে, পৃথিবীর অপরাপর স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গেও বাংলাদেশের তুলনা চলে না। এমনকি পার্শ্ববর্তী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলেও ফারাকটা স্পষ্ট ধরা দেয়। প্রতিবেশী ভারতে নাগরিকরা যে স্বাধীনতা ভোগ করে, সেই স্বাধীনতা কি বাংলাদেশিদের আছে? স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ভারতীয়দের নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, কখনও কেউ বন্দুক ঠেকিয়ে সেখানে ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে ক্ষমতাসীনদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করেই কাজ করতে পারে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সুরাহাও নিশ্চিত। ক্ষমতাধরদের কঠোর সমালোচনা করলেও সংবাদমাধ্যমের ভয় নেই। পাশ্চাত্যের উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র কি সুখকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে_ সে উদাহরণগুলোও আমাদের সামনে আছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির গালভরা বুলি না আওড়েও রাষ্ট্র যে নাগরিকদের মৌল চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারে, নাগরিক কল্যাণের সার্বিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, তেমন উদাহরণও এন্তার। নাগরিকদের কাজকর্ম, চিন্তা-ভাবনা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তো সেখানে তুলনাহীন। জীবন সেখানে অনেক সাবলীল। নাগরিকরা আইন মেনে, রীতি অনুসরণ করে নিজের ও অপরের চলাফেরা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে অটুট রাখে। রাষ্ট্র যেমন, নাগরিকরাও তেমন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে লালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই মুক্তির স্বাদ কই? ঘর থেকে বাইরে বেরোলেই বিশৃঙ্খলা পদে পদে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়াচ্ছে। রাস্তায় মর্জিমতো চলার ব্যবস্থা যেমন নেই, তেমনি বাজারে গিয়েও স্বাস্থ্যকর ও সাশ্রয়ী একটি পণ্য কেনার স্বাধীনতাও নেই। আইন-কানুন সর্বদা নাগরিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে না। নাগরিকরা মুক্তমনে কথা বলতে পারছে কি-না এবং মতপ্রকাশের অবারিত ব্যবস্থা আছে কি-না সেটি একটি বড় প্রশ্ন। মোটকথা, রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংস্কৃতির মূল সুর গণতন্ত্র নয়। কিন্তু একাত্তরের বিজয়ী জাতির কাছে স্বপ্নের সেই দেশ অধরা থেকে যেতে পারে না। তাই আমরা আশা করি, স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করে বাংলাদেশ আগামীতে গণতান্ত্রিক, অগ্রসর, প্রগতিশীল একটি দেশ হওয়ার সাধনায় ব্রতী হোক। স্বাধীনতার নায়কদের প্রকৃত সম্মান দেওয়ার সেটিই পথ। বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির বীর সেনানীদের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।
No comments