ধর নির্ভয় গান-চোখ ভিজে আসে, চোখ ভেসে যায় by আলী যাকের
টেপ রেকর্ডারটা আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। আমি শুয়ে পড়লাম মাটির ওপরেই। এরপর গড়াতে শুরু করলাম আমার বাংলার মাটিতে। গড়াতে গড়াতে কখন যে রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গেছি ধানক্ষেতের মাঝে, লক্ষ্যই করিনি। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বয়ে চলেছে আনন্দাশ্রু। আমি হাপুস নয়নে কাঁদছি। সেই অশ্রু গিয়ে মিশেছে বাংলার মাটিতে। মনে হলো এত গাঢ় নীল আকাশ কখনও দেখিনি। এমন টকটকে অস্তগামী সূর্য কখনও
দেখিনি যেন আগে পঁচিশে মার্চ রাতে রাজারবাগ আর পিলখানা ছাড়াও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ঢাকার কয়েকটি বাজারে। ওই সব বাজারের মধ্যে শুয়ে থাকা অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তখন। আগুনে না পুড়লেও বাজার থেকে প্রাণভয়ে বাইরে বেরিয়ে এলে পাকিস্তানিদের গুলির শিকার হয়েছে তারা। সদরঘাটের লঞ্চঘাটে, ভিক্টোরিয়া পার্কের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে, রিকশাওয়ালাকে রিকশায়, মুদি দোকানদারকে দোকানে, বস্তিবাসীদের বস্তির ভেতরে... যাকে যেখানে পেয়েছে ওরা, অবলীলায় হত্যা করেছে ঐ রাতে।
তারপর...
২৯ তারিখ ঢাকা ছাড়লাম...
সেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার গ্রাম রতনপুরে...
১২ এপ্রিল আগরতলার উদ্দেশে ছাড়লাম গ্রাম...
ওইদিনই পেরিয়ে গেলাম আমার ভালোবাসার বাংলাদেশের সীমানা। আমি মুঠো ভরে বাংলাদেশের মাটি নিয়ে কেঁদেছিলাম প্রায় শিশুর মতোই হাউমাউ করে।
অবশেষে ধর্মনগর। স্টেশন সংলগ্ন একটি রাস্তা। রাস্তাটি দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এসে রাস্তার দক্ষিণ-পশ্চিমে শালকাঠের বন। বনের পথে পায়ে হাঁটা রাস্তা। আমি সেই রাস্তায় নেমে পড়লাম। হাঁটছি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। হঠাৎ মনে হলো, আরে! যেদিকে পথ হাঁটছি সেদিকেই তো আমার বাংলাদেশ। একটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতো হেঁটে চললাম সামনে। আমার সারা মন আচ্ছন্ন করেছে তখন বাংলাদেশের স্মৃতি, আমার গ্রাম, আমার ঢাকা শহর। কতদূর যে হেঁটেছি তা লক্ষ্য করিনি। ভাবছি, এই তো এসে গেলাম বাংলাদেশে। এক্ষুণি দেখা পাব বাংলাদেশের মাটির। ঘাসে ঘাসে পা ফেলব। হঠাৎ পেছন থেকে একটু রুক্ষ স্বরেই কে যেন বলে উঠল, 'রোকো।' থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছনে ঘুরে দাঁড়ালাম, দেখি দু'জন ভারতীয় আর্মির পোশাক পরা মানুষ। তাদের কাঁধ থেকে ঝুলছে অস্ত্র। তারা দু'জন আমার কাছে এলো। তাদের মধ্যে একজন, মনে হলো অফিসার, আমায় চোস্ত ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছি। আমি ততক্ষণে বাস্তবে ফিরে এসেছি। বললাম, 'জানি না।' সে আমায় বলল, 'তুমি কি জানো, আর কিছু দূরেই বাংলাদেশের বর্ডার?' হঠাৎ মনে হলো, আরে! তাহলে তো প্রায় এসেই পড়েছিলাম আমার জন্মভূমিতে! অফিসার বলল, 'এবং বর্ডারের অদূরেই পাকিস্তানি আর্মি আর্টিলারি নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে আছে। একটু নড়াচড়া দেখলেই তারা গুলি করে উড়িয়ে দিত তোমাকে। চলো ফিরে চলো।' অতঃপর পা বাড়ালাম এক অবশ্যম্ভাবী অনিশ্চিত শরণার্থী জীবনের দিকে।
২. কলকাতার পার্ক সার্কাসে শামসি রেস্তরাঁয় অতি অল্প পয়সায় মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিনি পয়সার একমুঠ ধনে মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভাবছি, এখন কী করা যায়। এমন সময় আমার কাঁধের ওপর এসে পড়ল বিশাল এক থাবা। 'কী ব্যাপার, কী করছ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?' আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পাই কবির ভাইকে। আলমগীর কবির, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার। বলি, 'কিছু না কবির ভাই।' 'কিছু না? দেশে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে আর তুমি বলছ কিছু না?' 'তাই তো ভাবছি, কাল একবার কল্যাণীতে রিক্রুটমেন্ট অফিসে যাব। দেখি যদি কিছু একটা হিল্লে হয়।' 'তুমি আমার সঙ্গে এসো। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।' বলেই পাশের মিষ্টি কাম চায়ের দোকানটাতে ঢুকে পড়েন আলমগীর কবির।
'শোনো, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে', বললেন কবির ভাই। "রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে প্রচারিত 'দ্য হোল ট্রুথ' কমেন্টারিটা শুনেছ?" 'শুনেছি, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়', বলি আমি। 'আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি সার্ভিসটা দেখি। আমার একার পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমার সাহায্য চাই। ইংরেজি ভাষার ওপর তো তোমার দখল ভালোই। তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দাও না কেন? আমরা দু'জনে একসঙ্গে হলে, ডব পধহ ঃধশব ঃযবস ড়হ. আর বহির্বিশ্বে আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক সংবাদ আরও বেশি করে দেওয়া সম্ভব। বাংলায় তো সেটা সম্ভব নয়।' 'কিন্তু আমি যে যুদ্ধে যাব?', বললাম আমি। 'আহা, এও তো যুদ্ধ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যুদ্ধ। শব্দসৈনিক!' আমি দু'দিনের সময় চেয়ে নিই। কবির ভাই দু'দিন পর দেখা করতে বলে বালীগঞ্জের একটা ঠিকানা আমার হাতে গুঁজে দেন। এবং ঋজু, টান-টান পদক্ষেপে, ঠিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যেমন ছিলেন, একটা ট্রামে লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যান। আমি ভাবতে থাকি। যেদিন আলমগীর কবিরের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা, সেদিন ভোরবেলা আমি হাঁটছিলাম পার্ক সার্কাসের সীমান্তে অবস্থিত বিখ্যাত চার নম্বর পুল পার হয়ে ধাপার পাশে জলার ধার ধরে। এই চার নম্বর পুলের নিচ দিয়ে চলে গেছে কলকাতার চক্র রেলের লাইন। আমার হাতে একটা নুড়িপাথর। আমি নুড়িপাথরটাকে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ সেটাকে ছুড়ে দিলাম জলের ওপর। জলের ওপর কতগুলো তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, 'শব্দসৈনিক!'
৩.কলকাতায় এই সময় প্রতিদিন একটা না একটা সুখবর কিংবা দুঃসংবাদ পাওয়া যেত এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল সংবাদাগার। এই সময় একটা যুদ্ধ প্রতিবেদনের বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করলাম আমি। আলমগীর কবিরকে পরিকল্পনাটি সম্পর্কে অবহিত করি। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে যে সাব-সেক্টর কমান্ড, সেখানে লেফটেন্যান্ট নূরউন্নবীর সাক্ষাৎকার নেব আমি। এখানে তখন দাপটে যুদ্ধ করছেন আট নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা। আলমগীর কবিরের সম্মতি পাওয়া যায়। ওই সাব-সেক্টরের কয়েক গজ দূরেই মুক্ত বাংলাদেশ। নূরউন্নবী আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'বাংলাদেশে যাবেন?' 'অবশ্যই!' 'চলুন।' আমাকে আত্মরক্ষার জন্য একটা স্টেনগান দেওয়া হয়। নলে অজস্র ফুটোওয়ালা এই অস্ত্রগুলোকে বলা হতো স্টার্লিং স্টেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের উদ্ভাবন বলেই বোধহয় এই নাম।
অস্ত্র হাতে আমার মনে হয়, আমি যেন মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়েছি একজন মুক্তিযোদ্ধায়। এগিয়ে যাই আমরা তিন-চারজন। আমাদের সবার আগে লে. নূরউন্নবী। শ'তিনেক গজ দূরে একটা কুঁড়েঘর আর পুড়ে যাওয়া খড়ের গাদার পরে একটা কাঁঠাল গাছের নিচে এসে নূরউন্নবী বলেন, 'আমরা এখন বাংলাদেশে।' রোমাঞ্চিত হই আমি। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল অনুভূতি নিচের দিকে নেমে যায়। আমি জিজ্ঞেস করি, 'পাকিস্তানিরা কোনদিকে?' পুবদিকে ইঙ্গিত করেন নূরউন্নবী। 'কতদূর?' 'এই আধা মাইল দূরেই ওদের ডিফেন্স। তবে ভয়ের কিছু নেই। গত কয়দিন যা মার খেয়েছে, আমাদের দেখতে পারলেও টুঁ শব্দটি করবে না।' এরপর নূরউন্নবী যখন অন্যদের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত, আমি তখন বন্দুকটা ওপরে তুলে নিই। তাক করি পুবদিকে। ঘৃণার তাড়নায় মোহাবিষ্টের মতো কাজটা করতে যাই আমি। হঠাৎ নূরউন্নবী দেখতে পান। হাত তুলে বাধা দেন। বলেন, 'করছেন কী? এখন গুলি করলে ওরা খামোখা এলোপাতাড়ি গোলাগুলি শুরু করে দেবে। চলুন যাওয়া যাক।'
তারপর আমি সেদিন কী সাক্ষাৎকার নিয়েছি, ট্রাকে চড়ে কীভাবে ফিরে এসেছি, কিছুই মনে নেই। শিয়ালদহ স্টেশনে যখন ট্রেন পেঁৗছল তখন পুবদিক ফিকে হয়ে এসেছে।
৪. প্রতিটি দিন পার হচ্ছিল, বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছিল। কিন্তু আমরাও, সবকিছু জেনেই, অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম। কেবলই দেশের কথা মনে আসত। দেশের মাটি, শস্যভরা মাঠ, নিশ্ছিদ্র বন আর মানুষগুলোর মুখ। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ত। আবার গা ঝাড়া দিয়ে নিজ নিজ কাজে আত্মনিয়োগ করতাম। অবাক লাগে, দেশ যখন ছেড়েছি তখন এই মনোভাব নিয়ে ছেড়েছি যে, এই পরাধীন দেশে আর নয়। যেখানেই যাই না কেন, রাস্তায় ভিক্ষা করেও যদি জীবন চালাতে হয়, তা-ই করব, কিন্তু পরাধীন দেশে আর ফিরে যাব না। তখনও জানতাম না যে, নিরস্ত্র বাঙালি কোনোদিন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবে, দেশকে মুক্ত করবে। এখন ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছে। মনে হচ্ছে দেশ একদিন মুক্ত হবেই। এখন উতলা হচ্ছি কেন? মানুষের মন বোধহয় এরকমই। আমরা সবসময় তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, তারপর আর বিলম্ব সহ্য হয় না। আমার মনের অবস্থা এরকম হলেই আমি কবির ভাইয়ের কাছ থেকে একটা অ্যাসাইনমেন্টের অনুমোদন নিয়ে বেরিয়ে পড়ি সীমান্তের উদ্দেশে। যেখানেই যতদূর আমাদের দেশকে মুক্ত করছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ততদূর পর্যন্ত চষে ফেলি সর্বত্র। এমনও দিন গেছে, যখন আমি আমার অ্যাসাইনমেন্টের কথা দিব্যি ভুলে গেছি। বাংলাদেশের কোনো বৃক্ষের নিচে সবুজ ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে থেকে কী এক নেশায় বুঁদ হয়ে গেছি। ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় নানা গ্রামে পরিত্যক্ত বাড়িঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এর মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে। সামান্য দু'একটি মাথা উঁচু করে আছে এখনও। দরজা-জানালা নেই কোথাও। বুঝেছি এসব বাড়িঘরের সব মানুষ হয় কোথাও পালিয়েছে, নয়তো বুলেটের শিকার হয়েছে। আমি আবার আবেগাহত হয়ে বাড়ির ভেতরে এদিক-ওদিক খুঁজেছি কোনো একটি আসবাব অথবা ক্ষুদ্র কোনো নিদর্শন, যাতে করে ওই সব বাড়িতে যারা থাকত, তাদের সম্পর্কে কিছু জানতে পারি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছি। আবার মাঝে মধ্যে খুঁজে পেয়েছি একটা ছোট্ট পিতলের ঘটি কিংবা একপাটি খড়ম। একবার খুঁজে পেয়েছিলাম একটা বাচ্চা মেয়ের পরিত্যক্ত খেলার পুতুল। মনের ভেতরটা হুহু করে উঠেছিল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেছি, জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই অমোঘ কথাগুলো, 'আবার আসিব ফিরে... এই বাংলায়...'।
৫. সাতক্ষীরা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত। এখানেই আমি খবর সংগ্রহের জন্য ঘুরতে ঘুরতে বালিয়াডাঙ্গার বিলের তীরে এসে উপস্থিত হই। আমার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও)। তিনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন না। আমিও জানতাম না তার কথা। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে, তিনি ওই ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মাহবুবের অধীনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই আমাকে বললেন, এক প্রচণ্ড যুদ্ধের শেষে মাহবুব যখন একটু মাথা উঁচু করেছে, শত্রুপক্ষের একটা গুলি তার বুকের একপাশ দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তারা সবাই চেষ্টা করেন পরনের কাপড় ইত্যাদি দিয়ে সেই রক্ত ঠেকানোর। কিন্তু রক্ত যেন বাধ মানছিল না। যুদ্ধ আরও তীব্র হলো। হঠাৎ একসময় দেখা গেল, আহত মাহবুব তাদের পাশে নেই। মাহবুব তখন লক্ষ্য করেছিল যে, তার শুশ্রূষা করতে গিয়ে তার সহযোদ্ধাদের মনোযোগ যুদ্ধ থেকে সরে যাচ্ছিল। সে জন্য সে বাঙ্কার থেকে কোনো মতে ওপরে উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে বালিয়াডাঙ্গার বিলের মধ্যে পড়ে যায়। তখন বেশ হাওয়া ছিল সেই এলাকায়। মাহবুব শুরুতে পা দিয়ে পানিতে সাঁতরানোর চেষ্টা করে, এরপর কোনো একসময় অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্য এবং ক্লান্তিতে তার তন্দ্রা এসে যায়। সে অবস্থায় কতক্ষণ সে পানিতে ভেসে ছিল, জানে না। তার ভাগ্য ভালো যে ওই সময় বাতাসের ধাক্কায় তার ভাসমান দেহ আস্তে আস্তে অনেক দূরে গিয়ে কোনো একটি ডাঙায় থিতু হয়। তার তন্দ্রা যখন ভাঙে, তখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দিন। পাশের গ্রামের লোকেরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বালিয়াডাঙ্গার বিলের কোনো এক তীরে আধমরা অবস্থায় শুয়ে আছে। অধিক রক্তক্ষরণের জন্য তার সারা দেহ ফ্যাকাসে। ওই গ্রামবাসীরাই তাকে নিকটস্থ মুক্তিবাহিনীর ছাউনিতে নিয়ে যায়। সেখানে নানা রকম শুশ্রূষা দেওয়ার পর মাহবুব বেঁচে ওঠে।
আমার যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল এ ধরনের সংবাদ সম্পর্কে জানা। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমি আমার বরাদ্দকৃত কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, সব খবর লিখে রাখতে পারিনি। না হলে কেবল এই অবিস্মরণীয় ঘটনাগুলো নিয়েই একটি গ্রন্থ রচনা করা যেত।
৬. কবির ভাই আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন যশোর হয়ে খুলনা যাওয়ার। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তখন দুর্বার গতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একের পর এক অঞ্চল স্বাধীন করে চলেছে। তারিখ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমি যশোর রোডের ধারে নাভারণ বলে একটি জায়গায় সদ্যমুক্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তার ইংরেজি ট্রান্সক্রিপ্ট টেপে রেকর্ড করে একা একা সম্পূর্ণ জনশূন্য রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি যশোরের দিকে। ভাবছি, ভারতের দিক থেকে যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো গাড়ি যশোরের দিকে যায়, তবে সেই গাড়িতে চড়ে যশোর পর্যন্ত পেঁৗছানো যাবে। এমন সময় ঠিক উল্টো দিক থেকে একটি সেনাবাহিনীর জিপ এলো। আমার কাছে এসে জিপটি গতি শ্লথ করল। চালক একজন ভারতীয় সেনা অফিসার। হাসতে হাসতে আমায় বলল, 'জবলড়রপব, ণড়ঁৎ ধৎব ভৎবব.' বলেই জিপটি ভুস করে বেরিয়ে গেল আর কিছু না বলেই। ণড়ঁৎ ধৎব ভৎবব! তোমরা স্বাধীন! কথাটি কানে ভাসতে লাগল। করোটির ভেতরে ঢুকে গেল যেন। আমি স্থাণুর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। টেপ রেকর্ডারটা আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। আমি শুয়ে পড়লাম মাটির ওপরেই। এরপর গড়াতে শুরু করলাম আমার বাংলার মাটিতে। গড়াতে গড়াতে কখন যে রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গেছি ধানক্ষেতের মাঝে, লক্ষ্যই করিনি। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বয়ে চলেছে আনন্দাশ্রু। আমি হাপুস নয়নে কাঁদছি। সেই অশ্রু গিয়ে মিশেছে বাংলার মাটিতে। মনে হলো এত গাঢ় নীল আকাশ কখনও দেখিনি। এমন টকটকে অস্তগামী সূর্য কখনও দেখিনি যেন আগে। এমন সুখের অপরাহ্ন কখনও আসেনি জীবনে। এখন সুখ আর সুখ চারপাশে। ঘাসের ওপর গজিয়ে ওঠা বনফুল সুখের রসে টইটম্বুর, ঘাসের ডগায় সুখ শিশিরের বিন্দু, শালিকের-দোয়েলের-ময়নার মুখে সুখের কলকাকলি। হঠাৎ অবসাদে ছেয়ে গেল মন। আজ থেকে তবে আমার দায়িত্ব শেষ। নির্ধারিত কাজের সমাপ্তি। বড্ড ক্লান্ত মনে হলো নিজেকে। সদ্য স্বাধীন বাংলার শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে আছি আমি। টেপ রেকর্ডার, ট্রানজিস্টার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মহাসড়কে। এখন আর কী আসে যায়?
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments