সমকালীন প্রসঙ্গ-সিটি করপোরেশন নির্বাচন, প্রাসঙ্গিক আইন ও কিছু পর্যবেক্ষণ by বদিউল আলম মজুমদার
কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দাখিল করেন তাহলে উভয় মনোনয়নপত্র বাতিল হবে। তবে সিটি করপোরেশনের মেয়াদকালে মেয়র পদ শূন্য হলে, কোনো কাউন্সিলর, স্বীয় পদ ত্যাগ করে মেয়র পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। আমি মনে করি, যোগ্যতা-অযোগ্যতার এসব বিধিবিধান মেনে চললেই সজ্জনদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ
সৃষ্টি হবে আগামী ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। পরবর্তীকালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের। এসব নির্বাচন একটি আইনি কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সংসদ প্রণীত আইন এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তৈরি নির্বাচনী বিধিমালা ও আচরণবিধি যে কাঠামোর অংশ। আমাদের জাতীয় সংসদ ১৫ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে 'স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯' পাস করে। নির্বাচন কমিশন ৬ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে 'স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০' এবং একই তারিখে 'সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১০' প্রকাশ করে। এসব আইন ও বিধিতে অনেক বিধান রয়েছে, যা সম্পর্কে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং নির্বাচনের অব্যবহিত পরে নির্বাচিতদের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে ভোটারদের সচেতনতাও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, শপথ গ্রহণ ও সম্পত্তি সম্পর্কিত ঘোষণা, নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তি, রিটার্নিং বা প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ, হলফনামা প্রদান, নির্বাচনী ব্যয়, প্রচার সংক্রান্ত বাধানিষেধ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত বিধানগুলো বেশি প্রাসঙ্গিক। এর কয়েকটি সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
মেয়র ও কাউন্সিলরদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা (আইনের ধারা ৯ ও ১০) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কোনো ২৫ বছর বয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিক সিটি করপোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। তবে তাদের নাম যে কোনো ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার বা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকার যোগ্য হবেন না_ যদি তিনি কিছু শর্ত পূরণ করতে না পারেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ বা হারান; আদালতের মাধ্যমে অপ্রকৃতস্থ ঘোষিত প্রভৃতি। প্রত্যেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এই মর্মে একটি হলফনামা দাখিল করবেন যে, উপরোলি্লখিত ধারা অনুযায়ী তিনি মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচনের অযোগ্য নন।
কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দাখিল করেন তাহলে উভয় মনোনয়নপত্র বাতিল হবে। তবে সিটি করপোরেশনের মেয়াদকালে মেয়র পদ শূন্য হলে, কোনো কাউন্সিলর, স্বীয় পদ ত্যাগ করে মেয়র পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। আমি মনে করি, যোগ্যতা-অযোগ্যতার এসব বিধিবিধান মেনে চললেই সজ্জনদের নির্বচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং নির্বাচনের সুফল নাগরিকরা ভবিষ্যতে পাবে।
আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সম্পত্তির হলফনামা। মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ গ্রহণ (আইনের ধারা ৭) ও সম্পত্তি সম্পর্কিত ঘোষণা (বিধিমালা ধারা-৮) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে মেয়র ও কাউন্সিলররা সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তির সামনে শপথ গ্রহণ করবেন এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করবেন। গেজেটে নাম প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। একই সঙ্গে তারা টিআইএন নম্বরসহ (যদি থাকে) কর অফিসে দাখিলকৃত ও গৃহীত তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের দেশে, বিদেশে অবস্থিত সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণ হলফনামা আকারে সরকার মনোনীত কর্তৃৃপক্ষের কাছে দাখিল করবেন। দাখিলকৃত লিখিত বিবরণ অসত্য প্রমাণিত হলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং ক্ষেত্রমতো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। আমরা জানি, অতীতেও আইনে সম্পদের বিবরণী দাখিলের এমন বিধান ছিল, যা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে রাজনীতি আর দুর্নীতি আমাদের দেশে বহুলাংশে সমার্থক হয়ে পড়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এর ফল নিয়ে বিতর্ক আমাদের দেশে নতুন নয়। কেউ ফল মেনে নিতে না পারলে প্রতিকারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ও নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন (আইনের ধারা ৩৮, বিধিমালা ৬১) সম্পর্কে বলা হয়েছে, নির্বাচন সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশন একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। নির্বাচনী ফলাফল গেজেটে প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যাবে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল মামলা দায়ের করার ১৮০ দিনের মধ্যে সব প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিবাদীকে শুনানির সুযোগ দিয়ে এবং উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের পর তা নিষ্পত্তি করবে। মামলার রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যাবে এবং আপিল ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল নিষ্পত্তি করবে এবং আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অতীতে নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি যথাযথভাবে কাজ করেনি। ফলে অনেক আইনগতভাবে অযোগ্য ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে তাদের মেয়াদ পার করতে পেরেছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
প্রিসাইডিং বা রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের (বিধি ৫, ৮) বিষয়টি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত ব্যক্তিরা যাতে এসব পদে নিয়োগ না পান তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
মেয়র বা সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক প্রার্থীকে তার মনোনয়নপত্রের (ফরম 'ক', 'ক-১' বা 'ক-২') সঙ্গে নির্ধারিত ফরমে হলফনামা জমা দিতে হয় (বিধিমালা ১২) । হলফনামায় প্রার্থীর সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফৌজদারি মামলা সংক্রান্ত তথ্য, পেশা, আয়ের উৎস, নিজের বা অন্য নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায় এবং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের বা নির্ভরশীলদের গৃহীত ঋণ ইত্যাদি তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। হলফনামায় প্রদত্ত এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভোটারদের কাছে পেঁৗছানো সম্ভব হলে তারা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে; নির্বাচিতদের গুণগত মানে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এবং ভবিষ্যতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্ভাব্য নির্বাচনী ব্যয় এবং উৎসের বিবরণীর (বিধিমালা ৪৮, ৫০, ৫২) বিষয়টি বহুল আলোচিত। নির্বাচনী বিধিমালার ৪৮ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রার্থী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে তার নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রদান করে ফরম 'ঢ'তে একটি বিবরণী রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করতে হয়।
নির্বাচনী বিধি ৫২ অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার দাখিলকৃত নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন তার অফিসে সুবিধাজনক স্থানে সংরক্ষণ করবেন, যা ১০০ টাকা প্রদান করে পরবর্তী এক বছর সময়ের মধ্যে যে কোনো ব্যক্তির পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দাখিলকৃত হলফনামা, উৎসের বিবরণী, নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হবে এবং নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্নের কোনো অংশের কপি পৃষ্ঠাপ্রতি ৫ টাকা ফি প্রদানসাপেক্ষে সরবরাহ করা যাবে। এসব তথ্য অতীতে কখনও যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়নি। তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেই আমাদের রাজনীতি কলুষমুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে, প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনী ব্যয়সীমা মেনে চলেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা পেয়েছে (বিধিমালা ৯১)। এ সংক্রান্ত বিধিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড অথবা মৌখিক বা লিখিত রিপোর্ট থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, মেয়র বা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছেন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেছেন এবং অনুরূপ লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টার জন্য তিনি মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হতে পারেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তদন্তের নির্দেশ প্রদান করবে। তদন্ত রিপোর্টে যদি তিনি তার স্বীয় কর্মের জন্য মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হন, তাহলে নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত আদেশ দ্বারা ওই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। নির্বাচন কমিশনের এটি নতুন ক্ষমতা। আশা করি, প্রয়োজনে কমিশন এ ক্ষমতা ব্যবহারে দ্বিধা করবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, শপথ গ্রহণ ও সম্পত্তি সম্পর্কিত ঘোষণা, নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তি, রিটার্নিং বা প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ, হলফনামা প্রদান, নির্বাচনী ব্যয়, প্রচার সংক্রান্ত বাধানিষেধ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত বিধানগুলো বেশি প্রাসঙ্গিক। এর কয়েকটি সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
মেয়র ও কাউন্সিলরদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা (আইনের ধারা ৯ ও ১০) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কোনো ২৫ বছর বয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিক সিটি করপোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। তবে তাদের নাম যে কোনো ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার বা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকার যোগ্য হবেন না_ যদি তিনি কিছু শর্ত পূরণ করতে না পারেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ বা হারান; আদালতের মাধ্যমে অপ্রকৃতস্থ ঘোষিত প্রভৃতি। প্রত্যেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এই মর্মে একটি হলফনামা দাখিল করবেন যে, উপরোলি্লখিত ধারা অনুযায়ী তিনি মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচনের অযোগ্য নন।
কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দাখিল করেন তাহলে উভয় মনোনয়নপত্র বাতিল হবে। তবে সিটি করপোরেশনের মেয়াদকালে মেয়র পদ শূন্য হলে, কোনো কাউন্সিলর, স্বীয় পদ ত্যাগ করে মেয়র পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। আমি মনে করি, যোগ্যতা-অযোগ্যতার এসব বিধিবিধান মেনে চললেই সজ্জনদের নির্বচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং নির্বাচনের সুফল নাগরিকরা ভবিষ্যতে পাবে।
আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সম্পত্তির হলফনামা। মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ গ্রহণ (আইনের ধারা ৭) ও সম্পত্তি সম্পর্কিত ঘোষণা (বিধিমালা ধারা-৮) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে মেয়র ও কাউন্সিলররা সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তির সামনে শপথ গ্রহণ করবেন এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করবেন। গেজেটে নাম প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। একই সঙ্গে তারা টিআইএন নম্বরসহ (যদি থাকে) কর অফিসে দাখিলকৃত ও গৃহীত তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের দেশে, বিদেশে অবস্থিত সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণ হলফনামা আকারে সরকার মনোনীত কর্তৃৃপক্ষের কাছে দাখিল করবেন। দাখিলকৃত লিখিত বিবরণ অসত্য প্রমাণিত হলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং ক্ষেত্রমতো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। আমরা জানি, অতীতেও আইনে সম্পদের বিবরণী দাখিলের এমন বিধান ছিল, যা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে রাজনীতি আর দুর্নীতি আমাদের দেশে বহুলাংশে সমার্থক হয়ে পড়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এর ফল নিয়ে বিতর্ক আমাদের দেশে নতুন নয়। কেউ ফল মেনে নিতে না পারলে প্রতিকারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ও নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন (আইনের ধারা ৩৮, বিধিমালা ৬১) সম্পর্কে বলা হয়েছে, নির্বাচন সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশন একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। নির্বাচনী ফলাফল গেজেটে প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যাবে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল মামলা দায়ের করার ১৮০ দিনের মধ্যে সব প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিবাদীকে শুনানির সুযোগ দিয়ে এবং উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের পর তা নিষ্পত্তি করবে। মামলার রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যাবে এবং আপিল ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল নিষ্পত্তি করবে এবং আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অতীতে নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি যথাযথভাবে কাজ করেনি। ফলে অনেক আইনগতভাবে অযোগ্য ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে তাদের মেয়াদ পার করতে পেরেছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
প্রিসাইডিং বা রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের (বিধি ৫, ৮) বিষয়টি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত ব্যক্তিরা যাতে এসব পদে নিয়োগ না পান তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
মেয়র বা সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক প্রার্থীকে তার মনোনয়নপত্রের (ফরম 'ক', 'ক-১' বা 'ক-২') সঙ্গে নির্ধারিত ফরমে হলফনামা জমা দিতে হয় (বিধিমালা ১২) । হলফনামায় প্রার্থীর সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফৌজদারি মামলা সংক্রান্ত তথ্য, পেশা, আয়ের উৎস, নিজের বা অন্য নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায় এবং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের বা নির্ভরশীলদের গৃহীত ঋণ ইত্যাদি তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। হলফনামায় প্রদত্ত এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভোটারদের কাছে পেঁৗছানো সম্ভব হলে তারা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে; নির্বাচিতদের গুণগত মানে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এবং ভবিষ্যতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্ভাব্য নির্বাচনী ব্যয় এবং উৎসের বিবরণীর (বিধিমালা ৪৮, ৫০, ৫২) বিষয়টি বহুল আলোচিত। নির্বাচনী বিধিমালার ৪৮ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রার্থী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে তার নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রদান করে ফরম 'ঢ'তে একটি বিবরণী রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করতে হয়।
নির্বাচনী বিধি ৫২ অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার দাখিলকৃত নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন তার অফিসে সুবিধাজনক স্থানে সংরক্ষণ করবেন, যা ১০০ টাকা প্রদান করে পরবর্তী এক বছর সময়ের মধ্যে যে কোনো ব্যক্তির পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দাখিলকৃত হলফনামা, উৎসের বিবরণী, নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হবে এবং নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্নের কোনো অংশের কপি পৃষ্ঠাপ্রতি ৫ টাকা ফি প্রদানসাপেক্ষে সরবরাহ করা যাবে। এসব তথ্য অতীতে কখনও যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়নি। তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেই আমাদের রাজনীতি কলুষমুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে, প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনী ব্যয়সীমা মেনে চলেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা পেয়েছে (বিধিমালা ৯১)। এ সংক্রান্ত বিধিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড অথবা মৌখিক বা লিখিত রিপোর্ট থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, মেয়র বা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনী এজেন্ট এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছেন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেছেন এবং অনুরূপ লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টার জন্য তিনি মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হতে পারেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তদন্তের নির্দেশ প্রদান করবে। তদন্ত রিপোর্টে যদি তিনি তার স্বীয় কর্মের জন্য মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হন, তাহলে নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত আদেশ দ্বারা ওই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। নির্বাচন কমিশনের এটি নতুন ক্ষমতা। আশা করি, প্রয়োজনে কমিশন এ ক্ষমতা ব্যবহারে দ্বিধা করবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
No comments