এ ই দি নে-বাংলাদেশ আমার যমজ ভাই

৯৭১। উত্তাল পূর্ববঙ্গ। বর্বর পাকবাহিনী নির্মম গণহত্যা চালাচ্ছে। চারদিকে গোলাগুলি। মানুষ পালাচ্ছে। বাংলার দামাল সন্তানরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে শত্রু মোকাবেলায়। পুরো দেশ নিরাপত্তাহীন। এ সময় আমি মায়ের পেটে আসি। হয়তো মায়ের পেটেই আরেক যুদ্ধ শুরু করেছিলাম, পৃথিবীতে আসব, কি আসব না? আমি কি নতুন দেশ পাব? স্বাধীনতা পাব? না পরাধীন কোনো দেশে জন্ম নেব_ এ ধরনের প্রশ্ন অঙ্কুরেই হয়তো আমার মনের ভেতর ছিল।


যা-ই হোক, আমার জন্ম গ্রামে, মফস্বলে। চট্টগামের ফটিকছড়ির [বর্তমান ভূজপুর থানা] নারায়ণ হাটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় আমি মায়ের পেটে ভ্রূণ মাত্র।
তখন আমার বাবার ৫টি কন্যা। পুত্রের আশায় তিনি বারবার সন্তান নিচ্ছেন। অনেকেই বাবাকে বলতেন, আমার মায়ের পেটে পুত্র সন্তান আসবে না। এ নিয়ে বাবা-মায়ের সংসারে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। পুত্রের জন্য মা লুকিয়ে নিভৃতে কাঁদতেন। দরগায় মানত করতেন। মায়ের ইচ্ছা, খোদা তাকে যেন পুত্র সন্তান দান করে সবার ধারণা মিথ্যা করে দেন।
১৯৭১ সালে মা দুটি যুদ্ধ করেছেন। একটি দেশের জন্য, আরেকটি অনাগত সন্তানের জন্য। দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ। দুটিই মুক্তির। একটি দেশের, অন্যটি ছেলে জন্ম দিয়ে সবার অবজ্ঞা থেকে নিজেকে মুক্তির। বাবা ছিলেন উদ্যোমী যুবক। তাই মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। একদিন বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে স্থানীয় নারায়ণ হাটে যাচ্ছিলেন। পথে পাকবাহিনী বাবাকে ঘেরাও করে। বাবার সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন। সবাই নিরস্ত্র। সাধারণ পোশাকে এবং সংখ্যায় এরা প্রায় ৪০। সবাইকে একটা লম্বা রাস্তায় দাঁড় করাল পাকবাহিনী। একে একে সবাইকে পরীক্ষা করছিল তারা। বাবা বাঁচার জন্য প্রায় সবার পেছনে দাঁড়ালেন। বিধিবাম। সবাইকে ছেড়ে দিলেও আমার বাবাকে ছাড়ল না তারা। আলাদা করে একপাশে নিয়ে গেল। এরপর বাবাকে কালেমা জিজ্ঞেস করলেন। বাবা কালেমা বললেন। লুঙ্গি খুলেও বাবাকে প্রমাণ দিতে হলো, তিনি মুসলমান কি-না! এরপর পাকবাহিনী বাবাকে শত্রুজ্ঞানে নিশ্চিত হয়ে জুজখোলা স্কুলের পাশের শ্রীমতি ছড়ায় গুলি করার জন্য নিয়ে যায়। এ খবর দ্রুত পেঁৗছে গেল মায়ের কাছে। বাড়ি পরিণত হয়ে যায় কারবালায়! মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তখন। আর ভাবছিলেন, ৫টি কন্যা আর অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এদিকে পাকবাহিনী বাবাকে শ্রীমতি ছড়ার মাঝখানে নামিয়ে কেবলামুখী করে দাঁড় করাল। বাবা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বারবার কালেমা পড়ছিলেন আর মৃত্যুর প্রাক-প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ চলে যায়। কেউ গুলি করছে না দেখে বাবা অধৈর্য হয়ে উঠলেন, মৃত্যুর আর কত দেরি? তিনি পেছনে তাকালেন এবার। দেখলেন, পাকবাহিনীর মধ্যে দুটি ভাগ হয়ে গেছে। একভাগ বলছে গুলি করতে, আরেকভাগ বলছে না করতে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে এক সৈনিক বাবাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ করলে ওখান থেকে তিনি সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। আড়চোখে পেছনে তাকাচ্ছিলেন বারবার, ওরা বুঝি এই গুলি করে বসল! বাবা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এলেন সেদিন। এ এক অলৌকিক বেঁচে আসা। বাবার সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা অদূরে গুলির আওয়াজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যাতে লাশটা বাড়িতে পেঁৗছানো যায়। না, বাবা লাশ হয়ে এলেন না, তবে জিন্দা লাশের মতো ওখান থেকে ফিরে এলেন। বাবার এ ফিরে আসায় আমার পৃথিবীতে আসার পথও সুগম হলো।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের পরিবারে দুটি বিজয় আসে। একটি মুক্তিযুদ্ধ, অন্যটি আমার জন্ম। কারণ, এই দিন আমি মায়ের কোল আলো করে পৃথিবীতে এসেছিলাম। আমার জন্মে মায়ের সংসার হয়তো টিকে যায়। আমার বয়স আর বাংলাদেশের বয়স তাই সমান-সমান। আমরা যমজ।
আমি বড় হলে বাবাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, পাকবাহিনী যখন তোমাকে ধরে নিয়ে যায়, তখন তোমার কার কার কথা মনে পড়েছিল বাবা? বাবা বললেন, তোর কথা। বাবা তখন নাকি ভেবেছিলেন, এবার তার পুত্র সন্তান হবে। তিনি তাকে আর দেখে যেতে পারবেন না। আমি একই প্রশ্ন করেছিলাম মাকেও। আব্বু যদি যুদ্ধে শহীদ হতেন আমি কি পৃথিবীতে আসতাম? না, অনাগত সন্তানকে বোঝা ভেবে গোপনে একা একা কাঁদতে? মা কোনো জবাব না দিয়ে শুধু হেসেছেন।
১৬ ডিসেম্বর এলে আমার আনন্দ অন্যদের চেয়ে আলাদা। কারণ, আমার জন্মদিনে সরকারি ছুটি। চারদিকে উৎসব! কত কোলাহল!
১৬ ডিসেম্বর আমার যমজ ভাইয়েরও জন্মদিন। এদিন আমি তাকেও অভিনন্দিত করি। ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস, তুমি অমর হও। তোমার অমরত্বে আমরাও অমর হতে চাই।
জুলফিকার শাহাদাৎ

No comments

Powered by Blogger.