ইসলামপন্থিরা অধিক গণতান্ত্রিক! by সোহেব আহমেদ
আরব বিশ্বে দশকের পর দশক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বিরুদ্ধে সম্প্রতি গণতান্ত্রিক আন্দোলন 'আরব গণজাগরণ'-এ যদি উদারপন্থিরা বীজ বপন করে থাকেন, তবে শরতে এসে সেই পাকা ফসলে গোলা ভরেছেন ইসলামপন্থিরা। ইসলামী মতাদর্শের ধারক-বাহক দলগুলো নির্বাচনের পর নির্বাচনে উদারপন্থিদের পশ্চাদ্দেশে চাটি মেরেছেন বলা যেতে পারে। তিউনিসিয়ার কথাই ধরুন, দীর্ঘদিনের একনায়ক জয়নাল আবেদিন বেন আলিকে হটিয়ে
প্রথম যে নির্বাচন হলো, তাতেই ইসলামপন্থি ইন্নাহদা পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ২৩ অক্টোবরের ওই ভোটে বিজয়ী ইসলামপন্থিদের পার্লামেন্টই এখন দেশের জন্য নতুন সংবিধান রচনা করবে। মাসখানেক পর মরক্কোর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও তাদের জোট। আর এখন সম্ভবত মধ্যপ্রাচের এ যাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্ববহ নির্বাচনে মিসরে ইসলামপন্থি দলগুলোই দেশটির প্রথম অবাধ নির্বাচনে পার্লামেন্টে আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে চলেছে। মিসরে তিন দফার প্রথম ভোটে দুটি ইসলামী দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ৩৭ শতাংশ ভোট। আর আল নুর পার্টি পেয়েছে ২৪.৪ শতাংশ, পক্ষান্তরে উদারপন্থিদের দল ইজিপশিয়ান ব্লক পেয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ ভোট।
এফজেপি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা। এটি প্রগতিশীল ইসলামপন্থি। আর আল নুর কট্টর সালাফিস্টদের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম দফা ভোটে নিজেদের গতিবেগে ইসলামপন্থিরা আশা করছে, বুধবারের (১৪ ডিসেম্বর) এবং ৩ জানুয়ারির দুই দফায়ও তারা সুখবর পাবে।
তবে আরব বসন্তের অগ্রপথিক উদারপন্থি নেতাদের নির্বাচনে কেন এই দৈন্যদশা? কায়রোতে ভগ্নহৃদয় উদারপন্থিদের কাছ থেকে অবশ্য নানা ব্যাখ্যা শোনা যায়। তারা গীত গাইছে, উদারপন্থিদের মাত্র আট মাসের নির্বাচনী প্রস্তুতি আর ব্রাদারহুড ৮০ বছরের অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল। ইসলামপন্থিরা সৌদি আরব, কাতারের মতো দেশ থেকে অর্থপুষ্ট, পক্ষান্তরে লিবারেলরা সে রকম তহবিল পায়নি। তাছাড়া মিসরের ক্ষমতাসীন জেনারেলরা তাদের পুরনো বস হোসনি মোবারককে উৎখাত করায় উদারপন্থিদের ওপর ক্ষুব্ধ। আর এতে ভোট পড়েছে ইসলামপন্থিদের ব্যালটে। ব্রাদারহুড ও সালাফিস্টরা ধর্মীয় প্রপাগান্ডাও চালিয়েছে_ 'আমাদের ভোট দাও, ভালো মুসলিম হও।' তাদের এই অপপ্রচার বৃহত্তর দরিদ্র, অশিক্ষিত ভোটারদের ভুল পথে পরিচালিত করেছে।
উদারপন্থিদের এসব অজুহাত আপাতগ্রাহ্য। তবে তা ধোপে টেকে না। কেননা, সালাফিস্টরা ১০ মাস আগেও কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। আর উদারপন্থিদের ফান্ড অপ্রতুল, তাও নয়; উদারহস্ত টেলিকম বিলিয়নেয়ার নাগিব সাওয়ারিস ইজিপশিয়ান ব্লকের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। ইসলামপন্থিরা ভোটারকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফেরেববাজি করেছে বলে যে অভিযোগ এবং বলা হচ্ছে, বেশির ভাগ ভোটারই অশিক্ষিত, নির্বোধ। এতেই বোঝা যায়, জনগণের প্রতি উদারপন্থিদের দৃষ্টিভঙ্গি, যা মোটেই শুভ নয়। আর এটিই তাদের গো-হারা করেছে।
এসব বিবেচনায় বলা যায়, ইসলামপন্থিরা গণতন্ত্রকে উদারপন্থিদের চেয়ে বেশি ধারণ করতে পেরেছে। ভোটারদের প্রতি তাদের সম্মান রয়েছে। অতটা সংগঠিত না হলেও ইন্নাহদা বা এফজেপির প্রচারণা ছিল জোরালো ও পরিচ্ছন্ন। এখন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসলামপন্থিরা উত্তর আফ্রিকায় ইরানি স্টাইলে মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে চাইছে। কিন্তু তারা কিছু সেক্যুলার ও বামপন্থি দল নিয়ে জোট করেছে এবং শিগগিরই তারা ঘোষণা দেবে যে, তারা কোনো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার চায় না। তারা সর্বত্র একটি শক্তি পুঁজি করে লড়েছে, সেটি সুনাম। কেননা, বছরের পর বছর তারা জনগণের সেবা করে গেছে_ বিনামূল্যে চিকিৎসা, খাদ্য দিয়েছে দরিদ্রদের। তারা ভোটারদের আশ্বস্ত করতে পেরেছে, তারা পরিচ্ছন্ন সরকার গঠন করবে। যুগ যুগ ধরে চলা যে দুর্নীতি জনগণকে ত্যক্ত করে ফেলেছে, সেই দুর্নীতিকে একবিন্দু প্রশ্রয় দেবে না। এমনকি সালাফিস্টরা যারা প্রকাশ্যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে ফিরে যেতে চায়, তারাও জনগণের কাছে আপাদমস্তক সৎ। নির্বাচনে জিতে ইসলামপন্থিরা কি এবার নিজেদের প্রমাণ দেবে_ ভালো গণতান্ত্রিক বলে? সেই আশার সূর্য উঁকি দিচ্ছে। ইন্নাহদা বা এফজেপি নেতারা বিজয়োল্লাসের চেয়ে বেশি আপসি মানসিকতার। তারা চাইছে, জোটের ক্ষেত্র বাড়াতে এবং তাদের পতাকাতলে উদারপন্থিদের টানতে।
নিন্দুকেরা বলছে, এটি তাদের চাতুরী। যদি তাও হয়, ভয়ের কিছু নেই। কারণ তিউনিসিয়া বা মিসরীয় ভোটাররা তাদের গণতন্ত্র নিশ্চিত রেখেছে, ইসলামপন্থিদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি।
এদিকে নির্বাচনে হেরে নিজেদের দুর্বল প্রমাণ করে এখন উদারপন্থিরা কি পারবে গণতন্ত্রের পথে চলতে? যেহেতু, তাদের আগামীতে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আর সেজন্য পার্লামেন্টে তাদের শক্তিশালী গঠনমূলক বিরোধী দল হতে হবে। রপ্ত করতে হবে অধিকতর ভালো গণতন্ত্র_ ইসলামপন্থিদের মতো। সূত্র :টাইম ম্যাগাজিন।
No comments