মহান বিজয় দিবস আজ by জাকির হোসেন
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। এ দেশের ইতিহাসে এক গৌরব ও অহঙ্কারের দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। এ বছর আমরা দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ৪০ বছর উদযাপন করছি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ’৭১-এর এ দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয়
অর্জন করে। সেদিন জাতি নির্ভয়ে গেয়ে উঠেছিল বিজয়ের অবিনাশী গান। জাতি আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া শহীদদের।
দেশের বিশিষ্টজনরা বিগত ৪০ বছরে নানা বিষয়ে আমাদের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। তারা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি এবং অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষা, কৃষি উত্পাদন, প্রবাসে শ্রমশক্তি বিনিয়োগ ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি এবং অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এসব উন্নতি এবং অগ্রগতির অন্তরালে একটি নির্মম সত্য আছে—যে আশা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই আশা এখনও পূরণ করতে পারিনি। মানুষের মৌলিক অধিকার অর্থাত্ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। একটি সুস্থ, সবল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি। গত ৪০ বছরে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। আমরা একত্রিতভাবে ’৭১-এ যুদ্ধ করেছি। পুরো দেশ ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারপর গত ৪০ বছরে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা হলো বিদ্বেষ, বিভক্তি ও দলাদলির ঘটনা। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশীরা। জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে আসছে অঢেল বৈদেশিক মুদ্রা। এ কৃতিত্ব প্রবাসী শ্রমজীবীদের। কিন্তু দেশের দলাদলি, কোন্দল বিদেশেও বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বিভেদ সৃষ্টি করায় দেখা দিয়েছে ইমেজ সঙ্কট। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমরা এগোচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সমাজকে গণতান্ত্রিক করা। এর জন্য দরকার ছিল মৌলিক সামাজিক রূপান্তর—কিন্তু সেই সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। ফলে নানা ক্ষেত্রে যে উন্নতি ঘটেছে তার মাধ্যমে নানাভাবে সামাজিক বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে।
অন্যদিকে এ বছর এমন একটি সময় আমরা বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদযাপন করছি যখন দেশি-বিদেশি চিহ্নিত অপশক্তির গভীর ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। সীমান্তে প্রতিদিনই চলছে গুলি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখছে কাঁটাতারের বেড়ায়। রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে বিদেশিদের হাতে। ট্রানজিট দেয়ার নামে বিপন্ন করা হচ্ছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এ দেশের মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীরা ভারত সরকারের সুরে কথা বলছেন। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে দেশের আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে। সত্য বলার অপরাধে টুটি চেপে ধরা হচ্ছে গণমাধ্যমের। শেয়ারবাজারকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ দিশেহারা। নিরন্তর পরিশ্রম করেও মানুষ দু’বেলা আহার জোগাড় করতে পারছে না। সারাদেশে চলছে লাগামহীন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রায়ই ঘটছে খুন এবং গুমের ঘটনা। সবমিলিয়ে এ রাষ্ট্রে সবচেয়ে সস্তা মানুষের জীবন। তবুও প্রতিবছর বিজয় দিবস আমাদের জীবনে আসে নতুন প্রেরণা নিয়ে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভোরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণীতে আত্মত্যাগকারী শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং দেশবাসী, প্রবাসী বাংলাদেশী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিদেশেও বাংলাদেশী মিশনগুলোয় বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটির দিন। ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোও আজ বিজয় দিবসে বন্ধ থাকবে। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ভবনে উত্তোলন করা হয়েছে জাতীয় পতাকা। সংবাদপত্রগুলোও এ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতারসহ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। সারাদেশে চলবে আনন্দ অনুষ্ঠান। বিজয় দিবস উপলক্ষে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। এদিকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ বিজয় দিবসের সব অনুষ্ঠান ঘিরেই গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তাবলয়।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১৯৭১ সালের এদিনে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির দেশপ্রেম, ঐক্য ও শৌর্যবীর্যের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তি আর মিত্রবাহিনীর সামনে অস্ত্র ফেলে দিয়ে হানাদাররা অবনত মস্তকে দাঁড়ায়। একই বছর ২৬ মার্চ বিজয় অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে অকুতোভয় বাঙালি জাতি যে যুদ্ধ শুরু করে তার সমাপ্তি হয় ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এক আনন্দ-বেদনার সম্মিলনে।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস শুধু একাত্তরেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে স্ফুরিত জাতীয় চেতনার পথ ধরে ধারাবাহিক সংগ্রামে ১৯৬৯ সালে ঘটে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার আদায়ের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তত্কালীন পাকিস্তানে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে রক্তস্রোতে ভাসিয়ে দিতে চায়, শুরু করে গণহত্যা। সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
আজ রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত উদযাপিত হচ্ছে বিজয় দিবস।
সশস্ত্রবাহিনী সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় ৩১ বার তোপধ্বনি করে দিবসের অনুষ্ঠানমালা শুরু করবে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বাদক দল রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে সকালে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতারা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারসহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, কূটনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
একাত্তরের সেই আনন্দময় দিনটি : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছেন সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে। সেখানে নিয়াজি নেই, ফরমান আলিকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। ফরমান আলি জানান, আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত মিত্রবাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেই সংবাদ জানাতে পারছেন না। প্রস্তাব দেয়া হলো জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহারের। আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেয়া সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে আরও ৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল ৯টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়র সরণি) একটি দোতলা বাড়িতে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সকাল। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোন বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারে না। কী কথা হলো জানা না গেলেও তার চোখ-মুখে আনন্দের ছাপ বোঝা গেল। ফোন রেখেই প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘সবাইকে জানিয়ে দিও আজ আমরা স্বাধীন। বিকাল ৪টায় আত্মসমর্পণ।
এদিকে কিছুক্ষণ আগে ঢাকায় খবর এসে পৌঁছেছে—বিকাল সাড়ে ৪টায় আত্মসমর্পণ হবে। ঢাকাবাসী কি করবে আর কি করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করল। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েছেন কাদের সিদ্দিকী।
পৌষের সেই পড়ন্ত বিকালে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন ‘বি’ এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ হানাদার সেনা। মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণের দলিলে বিকালে সই করলেন হানাদার বাহিনী লে. জেনারেল নিয়াজি ও মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এসময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। ৯ মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে জন্ম নিল একটি নতুন দেশ—বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তার বাণীতে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করে বলেন, বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসে মহান বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম।
বর্তমান সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে ‘ভিশন-২০২১’ ঘোষণা করেছে। আমাদের বিপুল মানবসম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তির সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এ ‘ভিশন’ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সেখানে ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ থাকবে না এবং সবার জন্য সম্ভাবনার দুয়ার থাকবে অবারিত। তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের তিরিশ লাখ শহীদ এবং দু’লাখ মা-বোনকে, যাদের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে। এ সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে দল-মত নির্বিশেষে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি সুখী, সুন্দর, শান্তিময় ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য; যেখানে প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য অধিকার যথাযথ সংরক্ষিত থাকবে।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের বাণী : বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিজয় দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণ করে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি দেশবাসীর অব্যাহত সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধ ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হয়। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গর্বিত বিজয় দিবস। এদেশের দামাল ছেলেরা হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হলেও দুশমনদের শ্যেন দৃষ্টি আজও বিদ্যমান। আধিপত্যবাদী শক্তি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে গ্রাস করে আমাদের একটি পদানত জাতিতে পরিণত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত। ওই অপশক্তির নীলনকশা বাস্তবায়নে এদেশেরই কিছু চিহ্নিত মহল মদত জুগিয়ে চলেছে। তাদের হাত থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
দিনব্যাপী কর্মসূচি : যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালন উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। এদিন প্রত্যুষে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, কারারক্ষী এবং ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে সালাম গ্রহণ করবেন এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। এ সময় বিমানবাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সংবর্ধনায় মিলিত হবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সকাল ৬টা ৩৯টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের কার্যালয়গুলোতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, একই সময়ে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ, সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিজয় শোভাযাত্রা। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তন থেকে বিজয় শোভাযাত্রা শুরু হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে সমাপ্ত হবে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে ৫টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টায় দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাভারের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ৭টায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। সন্ধ্যায় নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে জাসাসের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৭ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় র্যালি। ১৮ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা।
এছাড়া ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের আয়োজনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ১৯ ডিসেম্বর কৃষকদল ও ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ২০ ডিসেম্বর যুবদল, ২১ ডিসেম্বর মহিলা দল, ২২ ডিসেম্বর মত্স্যজীবী দল, ২৩ ডিসেম্বর ছাত্রদল, ২৪ ডিসেম্বর স্বেচ্ছাসেবক দল ও ২৫ ডিসেম্বর জিয়া পরিষদের উদ্যোগে আলোচনা সভা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিজয় শোভাযাত্রা বের করবে। বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রবীন্দ্র সরোবরে একযোগে রাজধানীর ৮টি স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। এছাড়া জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারা, এলডিপি, জেএসডি, গণফোরাম, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (জিকু), গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, ঢাকা ক্লাব, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র, শ্রমিক ফ্রন্ট, যুবলীগ, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমুক্তি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, অরকা, নজরুল একাডেমী, বিজয় দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
দেশের বিশিষ্টজনরা বিগত ৪০ বছরে নানা বিষয়ে আমাদের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। তারা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি এবং অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষা, কৃষি উত্পাদন, প্রবাসে শ্রমশক্তি বিনিয়োগ ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি এবং অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এসব উন্নতি এবং অগ্রগতির অন্তরালে একটি নির্মম সত্য আছে—যে আশা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই আশা এখনও পূরণ করতে পারিনি। মানুষের মৌলিক অধিকার অর্থাত্ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। একটি সুস্থ, সবল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি। গত ৪০ বছরে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। আমরা একত্রিতভাবে ’৭১-এ যুদ্ধ করেছি। পুরো দেশ ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারপর গত ৪০ বছরে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা হলো বিদ্বেষ, বিভক্তি ও দলাদলির ঘটনা। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশীরা। জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে আসছে অঢেল বৈদেশিক মুদ্রা। এ কৃতিত্ব প্রবাসী শ্রমজীবীদের। কিন্তু দেশের দলাদলি, কোন্দল বিদেশেও বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বিভেদ সৃষ্টি করায় দেখা দিয়েছে ইমেজ সঙ্কট। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমরা এগোচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সমাজকে গণতান্ত্রিক করা। এর জন্য দরকার ছিল মৌলিক সামাজিক রূপান্তর—কিন্তু সেই সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। ফলে নানা ক্ষেত্রে যে উন্নতি ঘটেছে তার মাধ্যমে নানাভাবে সামাজিক বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে।
অন্যদিকে এ বছর এমন একটি সময় আমরা বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদযাপন করছি যখন দেশি-বিদেশি চিহ্নিত অপশক্তির গভীর ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। সীমান্তে প্রতিদিনই চলছে গুলি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখছে কাঁটাতারের বেড়ায়। রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে বিদেশিদের হাতে। ট্রানজিট দেয়ার নামে বিপন্ন করা হচ্ছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এ দেশের মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীরা ভারত সরকারের সুরে কথা বলছেন। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে দেশের আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে। সত্য বলার অপরাধে টুটি চেপে ধরা হচ্ছে গণমাধ্যমের। শেয়ারবাজারকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ দিশেহারা। নিরন্তর পরিশ্রম করেও মানুষ দু’বেলা আহার জোগাড় করতে পারছে না। সারাদেশে চলছে লাগামহীন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রায়ই ঘটছে খুন এবং গুমের ঘটনা। সবমিলিয়ে এ রাষ্ট্রে সবচেয়ে সস্তা মানুষের জীবন। তবুও প্রতিবছর বিজয় দিবস আমাদের জীবনে আসে নতুন প্রেরণা নিয়ে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভোরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণীতে আত্মত্যাগকারী শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং দেশবাসী, প্রবাসী বাংলাদেশী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিদেশেও বাংলাদেশী মিশনগুলোয় বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটির দিন। ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোও আজ বিজয় দিবসে বন্ধ থাকবে। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ভবনে উত্তোলন করা হয়েছে জাতীয় পতাকা। সংবাদপত্রগুলোও এ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতারসহ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। সারাদেশে চলবে আনন্দ অনুষ্ঠান। বিজয় দিবস উপলক্ষে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। এদিকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ বিজয় দিবসের সব অনুষ্ঠান ঘিরেই গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তাবলয়।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১৯৭১ সালের এদিনে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির দেশপ্রেম, ঐক্য ও শৌর্যবীর্যের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তি আর মিত্রবাহিনীর সামনে অস্ত্র ফেলে দিয়ে হানাদাররা অবনত মস্তকে দাঁড়ায়। একই বছর ২৬ মার্চ বিজয় অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে অকুতোভয় বাঙালি জাতি যে যুদ্ধ শুরু করে তার সমাপ্তি হয় ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এক আনন্দ-বেদনার সম্মিলনে।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস শুধু একাত্তরেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে স্ফুরিত জাতীয় চেতনার পথ ধরে ধারাবাহিক সংগ্রামে ১৯৬৯ সালে ঘটে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার আদায়ের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তত্কালীন পাকিস্তানে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে রক্তস্রোতে ভাসিয়ে দিতে চায়, শুরু করে গণহত্যা। সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
আজ রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত উদযাপিত হচ্ছে বিজয় দিবস।
সশস্ত্রবাহিনী সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় ৩১ বার তোপধ্বনি করে দিবসের অনুষ্ঠানমালা শুরু করবে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বাদক দল রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে সকালে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতারা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারসহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, কূটনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
একাত্তরের সেই আনন্দময় দিনটি : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছেন সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে। সেখানে নিয়াজি নেই, ফরমান আলিকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। ফরমান আলি জানান, আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত মিত্রবাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেই সংবাদ জানাতে পারছেন না। প্রস্তাব দেয়া হলো জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহারের। আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেয়া সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে আরও ৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল ৯টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়র সরণি) একটি দোতলা বাড়িতে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সকাল। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোন বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারে না। কী কথা হলো জানা না গেলেও তার চোখ-মুখে আনন্দের ছাপ বোঝা গেল। ফোন রেখেই প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘সবাইকে জানিয়ে দিও আজ আমরা স্বাধীন। বিকাল ৪টায় আত্মসমর্পণ।
এদিকে কিছুক্ষণ আগে ঢাকায় খবর এসে পৌঁছেছে—বিকাল সাড়ে ৪টায় আত্মসমর্পণ হবে। ঢাকাবাসী কি করবে আর কি করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করল। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েছেন কাদের সিদ্দিকী।
পৌষের সেই পড়ন্ত বিকালে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন ‘বি’ এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ হানাদার সেনা। মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণের দলিলে বিকালে সই করলেন হানাদার বাহিনী লে. জেনারেল নিয়াজি ও মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এসময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। ৯ মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে জন্ম নিল একটি নতুন দেশ—বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তার বাণীতে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করে বলেন, বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসে মহান বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম।
বর্তমান সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে ‘ভিশন-২০২১’ ঘোষণা করেছে। আমাদের বিপুল মানবসম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তির সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এ ‘ভিশন’ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সেখানে ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ থাকবে না এবং সবার জন্য সম্ভাবনার দুয়ার থাকবে অবারিত। তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের তিরিশ লাখ শহীদ এবং দু’লাখ মা-বোনকে, যাদের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে। এ সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে দল-মত নির্বিশেষে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি সুখী, সুন্দর, শান্তিময় ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য; যেখানে প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য অধিকার যথাযথ সংরক্ষিত থাকবে।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের বাণী : বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিজয় দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণ করে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি দেশবাসীর অব্যাহত সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধ ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হয়। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গর্বিত বিজয় দিবস। এদেশের দামাল ছেলেরা হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হলেও দুশমনদের শ্যেন দৃষ্টি আজও বিদ্যমান। আধিপত্যবাদী শক্তি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে গ্রাস করে আমাদের একটি পদানত জাতিতে পরিণত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত। ওই অপশক্তির নীলনকশা বাস্তবায়নে এদেশেরই কিছু চিহ্নিত মহল মদত জুগিয়ে চলেছে। তাদের হাত থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
দিনব্যাপী কর্মসূচি : যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালন উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। এদিন প্রত্যুষে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, কারারক্ষী এবং ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এতে সালাম গ্রহণ করবেন এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। এ সময় বিমানবাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সংবর্ধনায় মিলিত হবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সকাল ৬টা ৩৯টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের কার্যালয়গুলোতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, একই সময়ে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ, সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিজয় শোভাযাত্রা। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তন থেকে বিজয় শোভাযাত্রা শুরু হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে সমাপ্ত হবে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে ৫টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টায় দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাভারের স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ৭টায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। সন্ধ্যায় নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে জাসাসের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৭ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় র্যালি। ১৮ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা।
এছাড়া ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের আয়োজনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ১৯ ডিসেম্বর কৃষকদল ও ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ২০ ডিসেম্বর যুবদল, ২১ ডিসেম্বর মহিলা দল, ২২ ডিসেম্বর মত্স্যজীবী দল, ২৩ ডিসেম্বর ছাত্রদল, ২৪ ডিসেম্বর স্বেচ্ছাসেবক দল ও ২৫ ডিসেম্বর জিয়া পরিষদের উদ্যোগে আলোচনা সভা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিজয় শোভাযাত্রা বের করবে। বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রবীন্দ্র সরোবরে একযোগে রাজধানীর ৮টি স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। এছাড়া জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারা, এলডিপি, জেএসডি, গণফোরাম, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (জিকু), গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, ঢাকা ক্লাব, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র, শ্রমিক ফ্রন্ট, যুবলীগ, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমুক্তি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, অরকা, নজরুল একাডেমী, বিজয় দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
No comments