হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তামাদি হয় না by এস এম আব্রাহাম লিংকন

প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ অধিবেশনে গিয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় পরিকল্পিতভাবে দেশে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক সভায় তিনি বলেছেন, সরকার বিচারের জন্য বদ্ধপরিকর, অপরাধীরা পার পাবে না। তিনি এও পরিষ্কার করে বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী সিলেটের জনসভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন তা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বিএনপি জোটের অবস্থানকেই পরিষ্কার করেছে।
আমরা আমজনতা বিরোধীদলীয় নেত্রীর এই অবস্থানকে যেমন প্রত্যাশা করি না; বরং মনে করি বিচারের চূড়ান্ত পর্বে তার এ রকম বক্তব্য অনেকটা বাড়া ভাতে ছাই ছিটানোর মতো। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভুলে গেলে চলবে না বিগত নির্বাচনে তাঁর দলের বিপর্যয়ের পেছনে শুধু নেতাদের দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতিই কারণ ছিল না, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে অতিমাত্রিক গাঁটছড়া পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। বিএনপির যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন মানুষ কিন্তু সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক মনে করছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখাকেই সমীচীন মনে করি; কিন্তু পারছি না যখন দেখি তাঁর সরকারেরই পরিকল্পনা মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকেই বিচারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ দানা বাঁধছে সরকার যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিকে সময়ক্ষেপণের নামে কৌশল করে এড়িয়ে যাচ্ছেন কি না? অভিযোগটি অফিশিয়ালি দৃশ্যমান হয়েছে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখের সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্সে উত্থাপিত অভিযোগ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার পরও বিচারপ্রক্রিয়ার শ্লথগতি সন্দিহান করতে সহায়ক হচ্ছে। কারণ দায়িত্বশীলদের কর্ম ও বক্তব্য এক ধরনের নয়। বিজয়ের ৪০ বছর পরও আজ যেসব বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক চলে এবং যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলেন তাঁদের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। তাঁদের ব্যাপারে প্রজন্মের অবস্থানও নির্ণয় করতে হবে।
যত বিরোধিতাই থাকুক মানুষ কিন্তু সরকারের কাছে জাতির এই কলঙ্কতিলক মোচন চায়। আর চায় বলেই নির্বাচনে জাতি বর্তমান সরকারকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভাবনায় ভোট দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সরকারের পরিচ্ছন্ন ভূমিকা রাখার সুযোগ দিয়েছিল। সরকার সে লক্ষ্যে কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ প্রসিকিউশন ও তদন্ত সেল গঠনের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাধা করেছে। সরকার অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ রেজাউর রহমান, আবদুল কাহার আকন্দ ও মেজর (অব.) শামসুল আরেফিনসহ যোগ্যতম কিছু মানুষকে প্রসিকিউশনসহ বিভিন্ন স্তরে নিয়োগ দিয়েছে। আমরা বেশ আশাবাদী, এখনো আশাহত নই। যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন তাঁদের যোগ্যতা বা নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ না থাকলেও সামগ্রিকভাবে বিচারের অগ্রগতি দেশবাসীর প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আমাদের দেশের বিচারাঙ্গনে বিচার বিলম্বিত হওয়ার যে রেওয়াজ আছে তার গতি-প্রকৃতি থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের পৃথক অবস্থান প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবতা একই বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। যাঁরা বিচারের মুখোমুখি তাঁরা এবং তাঁদের দল দেশে যেমন যুদ্ধাপরাধবিরোধী আইনি ও সামাজিক আন্দোলন গড়তে চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে তাঁদের সফলতা আছে খালেদা জিয়া তাঁদের দাবির প্রতি একাত্মতাই শুধু নয়; বরং অনেকটা জামায়াতের দলীয় আদর্শিক কর্মীর ন্যায় ভূমিকা রাখছেন। জামায়াত যখন নিজে মাঠে নামতে পারছে না তখন জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে খালেদা এগিয়েছেন, এটি বড় প্রাপ্তি জামায়াতের। জামায়াত বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সভা-সেমিনার করছে, এখানে দলীয় নেতা ও আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক অগ্রণী অবস্থান রাখছেন। আবার দেশে আদালতে তাদের আইনজীবীরা বেশ শক্ত অবস্থানে আছেন_যেমন উপস্থিতিতে, তেমনি কৌশলে। অপরাধীদের এখন মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিচারকে বিলম্বিত করা। বিলম্বে যদি সরকারের বদল হয় তাতে অপরাধীদের পরিত্রাণ লাভ সহজ হবে। আসামিপক্ষ চেষ্টা করছে আদালতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় প্রার্থনা, লক্ষণীয় আসামির পরিবার যাকে বলছে সুস্থ সেই আসামিকে পরদিন জেলখানা থেকে বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণ করা হচ্ছে না। কারণ জেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তিনি অসুস্থ (সরিষার মধ্যে ভূত)। এখন মামলার দিনান্তর অপরাধীদের জন্য মঙ্গলময়। জামায়াত মনে করে এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধ মামলার দ্রুত বিচার ঠেকানোই মূল কাজ হবে। বিচারের বিলম্ব সাধনই যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির ভিত্তি হবে। এই সরকারের আগামী সময়গুলোতে অপরাধীদের পক্ষ থেকে ছুতো আর অজুহাতকেন্দ্রিক সময় প্রার্থনা (Time prayer) আদালতে প্রার্থিত হবে। সাক্ষীরা যেন সাক্ষী দিতে না পারে তার জন্য আর্থিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক সব বাধাই আরোপিত হবে। প্রয়োজন '৭১-এর পরাজিত শক্তি বিচারের সঙ্গে যুক্ত সব প্রাসঙ্গিক শক্তিকে অপসারিত করবে। প্রয়োজনে খুনখারাবি ওই অপশক্তির কাছে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই শক্তি ইতিমধ্যে যেসব স্পর্শকাতর বিষয় একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে সেসব ক্ষেত্র এবং যা আগামী সরকার গঠনে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর জন্য অন্তরায় হবে সেসব কাজ করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কুশলী ভূমিকায় অগ্রসর না হলে বিচার চিরকালের জন্য অধরাই থেকে যাবে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুধুই ভোট আদায়ের কৌশলী দাবি ছিল না? এটি নীতির দাবি, নৈতিকতার কথা, পাপ মোচনের কথা। উত্তরাধিকারের বিচার পাওয়ার অধিকার কোনো অজুহাতেই রুদ্ধ হতে পারে না। হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি কখনো তামাদি হয় না।
মনে রাখতে হবে, ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরু করেছিল তখন দু-চারজন প্রশ্ন তুলেছিল জনগণ এ জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পাঠায়নি। আমাদের নিজেদের মধ্যেও দু-চারজনের এ বিভ্রান্তি ছিল_বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে গেলে সেনাবাহিনী বিগড়ে যাবে, সেনাবাহিনীকে এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত করছে। তারা প্রতিশোধ নিচ্ছে রক্ষীবাহিনীর, দেশে গোলযোগ হবে। এর ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সরকারের পতন হতে পারে, আর সরকারের পতন হলে আওয়ামী লীগ আগামী এক শ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এ ধরনের অনেক নেতিবাচক কথা আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারকালে শুনেছি। বিচার হয়েছে, পরবর্তী সময়ে ফাঁসি হয়েছে; কিন্তু সরকারের পতন হয়নি, আওয়ামী লীগ নিঃশেষ হয়নি। জাতি বিভক্ত হয়নি বরং ওই বিচার বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল করেছে। জনগণ উৎসাহী হয়েছে, তৃপ্তিবোধ করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ফলে সেনাবাহিনী বিতর্কিত হয়নি বরং সেনাবাহিনী সম্পর্কিত অনেক বিভ্রান্তির অবসান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দাবি আইনি বা রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাজিত হতে পারে না। বিচারে প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত বিলম্ব জনগণ হয়তো মানবে, প্রয়োজনে আরো বছরের পর বছর অপেক্ষা করবে; কিন্তু পদ্ধতির নামে বিচার এড়িয়ে যাওয়া জনগণ গ্রহণ করবে না। বিচার এড়িয়ে যাওয়া শুধু বর্তমান সরকারের জন্য নয়; বরং সমগ্র বাংলাদেশের আদর্শ ও জনগণের জন্য বিপজ্জনক হবে। মাটির পাতিলে বন্দি বিষধর সাপ ছেড়ে দিলে কী পরিণতি হতে পারে, '৭৫ পরবর্তী দৃশ্যপট বিবেচনায় নিলেই বোঝা যাবে।
লেখক : আইনজীবী ও সাবেক রাকসু নেতা
abrahamlincoln66@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.