ওয়ালস্ট্রিটেই পুঁজিবাদবিরোধী লড়াই-আন্তর্জাতিক by ডেভিড ব্রুকস

তাহিরির স্কয়ার, পুয়েতা ডেল সোল, এথেন্স কিংবা চিলির সান্তিয়াগোর মতোই জ্বলে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জনগণ অর্থনৈতিক সংকট, বহুজাতিকদের লালসা, উঁচুমাত্রার অসাম্য এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। ওয়ালস্ট্রিট এক অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দিয়েছে। ইন্টারনেটের সামাজিক সংযোগের মাধ্যমে স্বাধীন অধিকারকর্মীরা গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০ হাজার জনগণকে ওয়ালস্ট্রিট দখল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা অসাম্য, ধনীদের লালসা এবং


রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভের আয়োজন করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল নিউইয়র্ক সিটির অর্থনৈতিক কেন্দ্রকে তাহিরির স্কয়ারে রূপান্তরিত করা। তারা আরব আন্দোলন, স্পেনের 'ক্ষুব্ধ জনতা'দের লড়াই, চিলির ছাত্রদের বিক্ষোভের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
১৭ সেপ্টেম্বর চার থেকে পাঁচশ' জনতা এটির আয়োজন করেছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কিছু প্রগতিশীল গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ালস্ট্রিটের আশপাশে হাজার হাজার লোকের জমায়েত হয়েছে।
এ তথ্যটি সম্পর্ণ ভুল নয়। তবে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথমে যারা ওয়ালস্ট্রিট দখল করে তারা হলো পুলিশ। তারা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়, এমনকি পর্যটকদের ঢুকতে বাধা দেয়। তারপরও হাজার হাজার জনতা ওয়ালস্ট্রিটের চারপাশ ঘিরে তাদের স্বাধীন মত ব্যক্ত করে চলেছে।
ওয়ালস্ট্রিটের ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশ। ওয়ালস্ট্রিটের সামনে একটি ষাঁড়ের ভাস্কর্য রয়েছে, যা তার ক্ষমতার প্রতীক। সেই ভাস্কর্যের সামনে পুলিশ অবস্থান নিয়ে লৌহপ্রাচীর গড়ে তুলেছে অর্থাৎ রাষ্ট্র পুুঁজিকে পাহারা দিচ্ছে।
প্রথম দিকে প্রতিবাদ শেষে বিক্ষোভকারীরা যাদের অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী, তারা নির্ধারণ করল ওয়ালস্ট্রিটের কাছে যে জুকোতি পার্ক রয়েছে সেখানে অবস্থান নেবে। তারা এর নাম বদলে রেখেছে 'মুক্তির পার্ক'। আস্তে আস্তে সেখানে জনসমাগম ঘটতে থাকে। পরের শনিবার ৮০ জনের বেশি জনতাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কেননা তারা ইউনিয়ন স্কয়ারের দিকে পদযাত্রা শুরু করেছিল। পুলিশ যখন অতিরিক্তি সদস্য মোতায়েন করল তখন গণমাধ্যমের মনোযোগ সৃষ্টি হলো।
বিক্ষোভকারীরা বলেছে, তারা ওই স্থান ত্যাগ করবে না। তারা একটি সাধারণ পরিষদ সৃষ্টি করে তাতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করছে এবং রাজপথে গণতন্ত্র চর্চা করছে। তাদের বিক্ষোভ মূলত দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যারা ৯৯ শতাংশ জনগণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে।
একজন অংশগ্রহণকারী জানালেন, 'এই ওয়ালস্ট্রিটের জনতা আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে।' ওয়ালস্ট্রিটে প্রকৃত গণতন্ত্রের লড়াই চলছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের বেকারত্ব, ঋণ এবং বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই সুশিক্ষা পেয়েছে কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন, বর্তমানে তারা বেকার। সরকারি লোক গণনা অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে কমে গিয়ে ঠেকেছে (মাত্র ৫৫.৩ শতাংশের চাকরি হয়েছে)। কিছু বিশেল্গষক বলছেন, 'হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম।'
অনেকেরই রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটেছে। একজন বলছেন, 'আমি ওবামার নির্বাচনের জন্য এক মাস কাজ করেছিলাম, কিন্তু পরেরবার আর করব না।' এ অবস্থা পুয়েতা ডেল সোল অথবা কায়রোর সঙ্গে ব্যাপক সাদৃশ্যপূর্ণ।
এখানে কেউ কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করছে না। সামাজিক স্তর যেমন শ্রমিক ইউনিয়ন, নাগরিক সংগঠন, অভিবাসী এবং ছাত্রদের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ আছে। সবাই বিস্মিত হচ্ছেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে লাখ লাখ জনগণ তাদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অংশগ্রহণের। প্রথমদিককার ছোট সমাবেশই গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল; আর এখন তা গণমাধ্যমের শীর্ষ খবরে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যেমন মাইকেল মুর, কমেডিয়ান রোজেন বার এবং অভিনেতা স্টিফেন ফলকটি ওই সমাবেশে সংহতি জানিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং এ প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছেন। ১০০-এর বেশি লেখক যার মধ্যে সালমান রুশদি, পুলিৎজার বিজয়ী ঔপন্যাসিক মাইকেল কানিং হামের মতো লেখক রয়েছেন। তারা এ বিক্ষোভের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন।
মূলত এটি লগি্ন পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ। নিউইয়র্কের মেয়র মাইকেল বল্গুমবার্গ যিনি শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, গণমাধ্যমে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন 'আপনাদের সন্তানরা আজ কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে চাকরি পাচ্ছে না। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিল কায়রোতে, মাদ্রিদে। আপনি নিশ্চয়ই এখানে সে রকম সংঘাত চান না।'
এখন অনেক বহুজাতিক প্রচারমাধ্যম তাদের প্রতিবেদক পাঠাচ্ছে অথচ অতীতে এ রকম আরও লাখ লাখ জনতার সমাবেশকে তারা উপেক্ষা করেছে। কিন্তু আর সে সুযোগ নেই। যদি অধিকারকর্মীদের সঙ্গে প্রচারমাধ্যম থাকে তাহলে এখানেও একটি তাহিরির স্কয়ার তৈরি হবে। মাইকেল মুর সাম্প্রতিক একটি টেলিভিশন প্রোগ্রামে বলেছেন, 'ধনীরা শুধু উঁচু প্রাচীর তৈরি করতে পারে; কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে যখন জনতা ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তা ভাঙতে বেশি সময় লাগে না।' তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি শহরের জনতাকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' বা 'ওয়ালস্ট্রিট দখল করো।' তার মতে, 'অতীতে জনগণের অনেক বিদ্রোহকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এবারও সে চেষ্টা চলবে... ওইসব জনগণ আমাদের ভবিষ্যৎকে লুণ্ঠন করেছে।'
এখানে প্রধান প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আরব দেশগুলো, মাদ্রিদ বা বার্সেলোনা এবং চিলির সান্তিয়াগোর বিক্ষোভ কি সত্যিকারের পরিবর্তন বয়ে আনতে পারবে? তবে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে ধনী, অভিজাতরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের দ্বারা নিন্দিত হচ্ছেন এবং প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন। পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে আফ্রিকা, এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। বিক্ষোভের আয়োজকরা বলছেন, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে এ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে ইতালিতে। সেখানে দুই লাখের বেশি মানুষ সমবেত হয়েছিল। এছাড়া লন্ডন, মাদ্রিদ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, হংকং, টোকিও, সিডনি, অকল্যান্ড, জোহানেসবার্গ ইত্যাদি শহরেও পুঁজিবাদবিরোধী সমাবেশ হয়েছে। ওয়ালস্ট্রিটের অনুপ্রেরণায় মূলত এই বিক্ষোভগুলো সংঘটিত হয়েছে।
সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ক্ষমতার সঙ্গে লড়াইয়ে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা আছে। বিগত প্রজন্মের জনপ্রিয় লড়াইগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। জনগণকে সে সমাজের গায়ে আঁচড় কাটতে হবে, যে সমাজ অর্থের ওপর নির্মিত। কিন্তু এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সুযোগ রয়েছে এ আন্দোলনের মাধ্যমে সারাবিশ্বকে প্রভাবিত করা, সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং প্রতিবাদকে শক্তিশালী করা। সবচেয়ে আশান্বিত হওয়ার বিষয় যে, বার্সেলোনার আন্দোলনকারীরা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করছে এই বলে, 'বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দখল করো আন্দোলন শুরু হয়েছে। এবার মনে হয় দুনিয়াজুড়ে হঠাৎ কিছু ঘটবে।'

ডেভিড ব্রুকস : কিউবান সাংবাদিক
গ্রানমা থেকে ভাষান্তর অনিন্দ্য আরিফ
 

No comments

Powered by Blogger.