বাসচাপায় সাংবাদিক নিহত
তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী অন্বেষা অথৈ বসে আছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) হলঘরে। তাঁর মা পলি দাস বুক চাপড়ে কাঁদছেন। সাংবাদিক বাবা দীনেশ দাসের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াতের পথে এখানে আগেও এসেছে অথৈ। তবে এবার সে বাবাকে নিয়ে এসেছে শেষবারের মতো। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর কাকরাইলে বাসের চাপায় নিহত হন সাংবাদিক দীনেশ দাস (৪৭)। সকালে মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ডিআরইউতে যাওয়ার পথে এ
দুর্ঘটনা ঘটে। ক্ষুব্ধ সাংবাদিকেরা এ ঘটনায় গতকাল দুপুর দেড়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক অবরোধ করে রাখেন। কয়েকটি যানবাহনও ভাঙচুর করা হয়। তবে ১১ দিন আগে বাসচাপায় পা হারিয়েছেন আরেক সাংবাদিক নিখিল ভদ্র।
দীনেশ দাস সর্বশেষ দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ছিলেন। দেড় মাস আগে তাঁর চাকরি চলে যায়। এর আগে তিনি দৈনিকসংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন।
পুলিশ ও নিহতের স্বজনেরা জানান, সকাল আটটার দিকে রামপুরার বাসা থেকে একমাত্র সন্তান অথৈকে নিয়ে বের হন দীনেশ। অথৈকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে মোটরসাইকেলে ডিআরইউতে যাচ্ছিলেন তিনি। সকাল পৌনে নয়টার দিকে কাকরাইল ক্যাথলিক চার্চের সামনে একটি বাস তাঁকে ধাক্কা দিলে মোটরসাইকেলসহ পড়ে যান তিনি। মোটরসাইকেলটি বাসের সামনে আটকে যায়, আর তাঁর মাথাটি পড়ে পেছনের চাকার নিচে। এই অবস্থায় বাসটি এগিয়ে গেলে বাসের চাকা থেঁতলে দেয় দীনেশের মাথা, থেমে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দীনেশ দাস আধা ঘণ্টার মতো ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিলেন। পরে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর পুলিশ গাড়িসহ চালক বাদশা মিয়া ও সহকারী কিশোর হাসান মাহমুদকে আটক করে। কিন্তু বাদশা নিজেকে চালক পরিচয় গোপন করে পথচারী হিসেবে দাবি করেন। তবে পুলিশ চালক নিশ্চিত হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বাদশার কাছে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। ওসি বলেন, বাসটি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) একটি ভাড়া করা স্টাফ বাস। এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে টিসিবির কর্মীদের নিয়ে কারওয়ান বাজারের উদ্দেশে যাচ্ছিল।
রমনা থানা হেফাজতে চালক বাদশা মিয়া বলেন, ১০-১২ দিন আগে গাড়ির বাঁ পাশের আয়না না থাকায় জুরাইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন ট্রাফিক সার্জেন্ট। সেই মামলায় তাঁর চালকের লাইসেন্স জব্দ করা হয়েছে। মামলার কাগজ তিনি পুলিশকে দিয়েছেন।
এই লাশ দেখব কীভাবে: সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে দীনেশ দাসের মরদেহ ডিআরইউতে আনা হয়। সেখানে সহকর্মীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাংবাদিকেরা। কাঠের বাক্সের ঢাকনা খুলে দেওয়ার পর দীনেশের থেঁতলানো মুখমণ্ডল দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সহকর্মীরা। সাংবাদিকেরা বলতে থাকেন, ‘এই লাশ আমরা দেখব কীভাবে’।
ডিআরইউতে বসে কাঁদছিলেন দীনেশের স্ত্রী পলি দাস। আর মেয়ে অথৈ বসে ছিল একদম চুপ হয়ে। দীনেশের ভগ্নিপতি বাবলু চন্দ্র দাস বলেন, দীনেশের বাবার নাম সহদেব চন্দ্র দাস। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দীনেশ তৃতীয়। তাঁর একমাত্র মেয়ে অথৈর ভবিষ্যৎ নিয়েই সবাই এখন চিন্তিত।
পলি দাস বলেন, দেড় মাস আগে চাকরি চলে যাওয়ার পর প্রকট অর্থকষ্টে পড়েন তাঁরা। সর্বশেষ গতকাল জমানো টাকা থেকে ১০০ টাকা তিনি দীনেশকে দিয়েছিলেন মোটরসাইকেলের জ্বালানি কেনার জন্য।
ডিআরইউ থেকে পরে দীনেশ দাসের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসক্লাবে। সেখানে কিছুক্ষণ রাখার পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি নওগাঁর রানীনগরের বানিয়াপাড়ার উদ্দেশে।
বিক্ষোভ: দীনেশের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকেরা জড়ো হতে শুরু করেন সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ ও প্রেসক্লাব এলাকায়। দুপুর দেড়টার দিকে সাংবাদিকেরা প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সাংবাদিকদের খণ্ড খণ্ড মিছিল প্রেসক্লাব ও হাইকোর্ট এলাকায় ঘুরতে থাকে। বেলা দুইটার পর তাঁরা হাইকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারার ক্রসিংয়ে রাস্তার ওপর শুয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এখানেও কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সাংবাদিকেরা পরিবহন শ্রমিকনেতা ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে সাংবাদিকেরা বলেন, ‘শাজাহান খান সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিলেন পরিবহনশ্রমিকদের। তাঁর শ্রমিকেরা এখন একের পর এক সাংবাদিকের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিচ্ছে। কেউ হারাচ্ছে পা, কারও বা যাচ্ছে জীবন।’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ডিআরইউর সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন প্রেসক্লাবের সামনে এসে বিক্ষোভরত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা আগামীকাল (সোমবার) বেলা ১১টা পর্যন্ত সরকারকে সময় দিতে চাই। এর মধ্যে আমাদের দাবি মানা না হলে আমরা আবার অবস্থান নেব। এখনকার মতো অবরোধ প্রত্যাহার করা হলো।’
তবে এর পরও বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন সাংবাদিকেরা। তাঁরা সরকারের কাউকে এসে দীনেশ দাসের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিক্ষোভ চলে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন এসে যোগ দেন ওই বিক্ষোভ সমাবেশে। ঘটনার বিচার চেয়ে সাংবাদিকেরা প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধনও করেন। এ সময় ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘প্রতিদিন এভাবে কেউ না কেউ চলে যাবেন, এটি মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের এখানেই অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ করা উচিত।’ অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের জন্য আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া উচিত।’
বিভিন্ন সংগঠনের শোক: দীনেশ দাসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, ডিআরইউ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি, সিটিজেনস রাইটস মুভমেন্ট, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, প্রগতিশীল শিল্পী ও গণমাধ্যমকর্মী ফোরাম, গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী জনতা, সমাজচিন্তা ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন।
আজ মানববন্ধন: দীনেশ দাসের মৃত্যুর প্রতিবাদ, তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে আজ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবে ডিআরইউ, বিএফইউজে, ডিইউজে। সংগঠন তিনটির পক্ষ থেকে মানববন্ধনে সাংবাদিকদের অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
No comments