মানবতাবাদী মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজি by সুবল চন্দ্র সাহা
ফরিদপুর শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন। প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের আদি লীলাভূমি। প্রভু সুন্দরের আদরের দুলাল আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণপুরুষ ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী। তার দিব্যজীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এ পবিত্র প্রতিষ্ঠানে। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৯০৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। দিব্যলীলা সংবরণ করে তিনি ১৯৯৯ সালের ১৮ অক্টোবর মহাপ্রয়াণে গমন করেন। আজ ড. ব্রহ্মচারীজির সেই মহাপ্রয়াণ দিবস। ড. ব্রহ্মচারীজির পৈতৃক নিবাস বরিশাল জেলার খালিশাকোটা
গ্রামে। বাবা কালিদাস দাসগুপ্ত। মা কামিনী সুন্দরী দেবী। শৈশবকালে বাবা-মা তাকে আদর করে 'কান্ত' বলে ডাকতেন। পরে তার নাম রাখা হয় 'বঙ্কিম চন্দ্র'। মহানামব্রত ব্রহ্মচারী তার গুরুদেব মহেন্দ্রজির প্রদত্ত নাম।
ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে দর্শন ও সংস্কৃত শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সংস্কৃত বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৩৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে ভারতের বৃন্দাবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি-লিট উপাধি পান। ভারত সরকার তাকে মহামহোপাধ্যায় ও ভারত শিরোমণি উপাধিতে ভূষিত করে।
ছোটবেলা থেকেই বঙ্কিম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। খালিশাকোটা হাইস্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। এ সময় বরিশালে জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় দেশবরেণ্য নেতা মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এ অধিবেশনে যোগদান করেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি ও ব্রিটিশবিরোধিতার ঢেউ বঙ্কিম চন্দ্রের কচিমনে রেখাপাত করে। তার মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত হয়। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় খদ্দরের পোশাক ব্যবহার করতে শুরু করেন। এভাবেই কিশোর বঙ্কিমের মনে যে সেবাধর্মের বীজ অঙ্কুরিত হয়, যা পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিকতার জগতে মহীরুহ হিসেবে দেখা দেয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ড. ব্রহ্মচারীজি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অসুস্থতার কারণে সাময়িকভাবে তিনি কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। ফরিদপুরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশের সময় প্রথম টার্গেট করে শ্রীঅঙ্গনকে। পাষণ্ড পাকসেনারা শ্রীঅঙ্গনের কীর্তনরত আট সন্ন্যাসীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। শ্রীঅঙ্গনের মূল মন্দিরটির চূড়া ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। এ সংবাদ শুনে ড. ব্রহ্মচারীজি গভীর শোকাতিভূত হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, 'যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি অন্ন গ্রহণ করবেন না।' তিনি অবিরত দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রার্থনায় রত থাকেন। উপবাসক্লিষ্ট ড. ব্রহ্মচারীজি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফলমূল খেয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। শরণার্থীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফরিদপুর ফিরে আসেন। প্রয়াত সন্ন্যাসীদের উদ্দেশে প্রভু সুন্দরের চরণে ভোগরাগ উৎসর্গ করে অন্ন গ্রহণ করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এ অবদান চির অম্লান ও চির অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী একাধারে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সর্বধর্ম সমন্বয়ে মূর্ত প্রতীক। এ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সবাইকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, মানুষ জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হয় না, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মুনষ্যত্বের বেদিমূলে দেশ ও জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জীব ও জগতের অশেষ কল্যাণ হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ১৯৩৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। ৪০ বছর আগে ১৮৯৩ সালে বীরসন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীকে সনাতন ধর্মের মর্মবাণী শুনিয়েছিলেন, সেই একই স্থানে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারত তথা এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী।
ড. ব্রহ্মচারীজির কাছে ঈশ্বরপ্রেম ও মানবতাবোধ একই সুরে গ্রথিত। মানবকল্যাণই হচ্ছে ধর্মাচরণের মূল ভিত্তি। তাই তিনি সারাজীবন মানুষকে মনুষ্যত্ব লাভে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ড. ব্রহ্মচারীজি মহাবতরী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের মানবধর্মের বিশ্বজনীন উদারতা প্রচার করেছিলেন। প্রেমের শাশ্বতবাণী শুনিয়ে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছিলেন। তিনি মূলত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে চারটি ভাষণ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা তার ভাষণের মর্মবাণী ও তাৎপর্য ফলাও করে প্রকাশ করে।
ড. ব্রহ্মচারীজি ধর্মকে নিছক আচার-অনুষ্ঠানের বেড়াজালে আবদ্ধ করতে চাননি। ধর্মচর্চা ছিল তার কাছে মানবকল্যাণ সাধনের একটি পথ মাত্র। তার মতে, যিনি সৎ, নিষ্ঠাবান, ভদ্র, বিনয়ী এবং অসাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী, তিনিই তো পরম ধার্মিক। তিনিই তো প্রকৃত মানুষ। মনুষ্যত্ব অর্জনই হলো ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্যে। মানুষের ধর্ম মানবধর্ম। সাধনা তার মানবকল্যাণ। ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজি শুধু পারলৌকিক ধর্মীয় চিন্তাতেই মগ্ন থাকতেন না। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও আর্তমানবতার সেবা এবং সমাজের কল্যাণই ছিল তার মূল লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক। তিনি বলতেন, 'একটি বৃক্ষের ফুলে গন্ধ, পাতায় তিক্ততা, কিন্তু বৃক্ষ একটাই।' সুতরাং বিশ্বের বিভিন্নতার মধ্যে তিনি বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই মনুষ্যত্বের অধিকারী 'একজন উত্তম খ্রিস্টান, উত্তম মুসলমান, উত্তম হিন্দু, উত্তম বৌদ্ধ এবং উত্তম ইহুদির মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। কেননা যা দ্বারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব গঠিত হয়, তা পৃথিবীজুড়ে এক এবং অভিন্ন।' ড. ব্রহ্মচারীজি আমেরিকায় দীর্ঘদিন অবস্থান করে খুব কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজচিত্র প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমেরিকার প্রাচুর্যের সমারোহ যত বেশিই হোক না কেন, তাদের চিত্তের দৈন্যদশাও ব্যাপক। ফলে প্রতিনিয়ত সেখানে 'অর্থের প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষের বেদনা, আর্তি ও হাহাকার দেখা দিয়েছে।' আজকের গ্গ্নোবালাইজেশনের যুগেও এ অশান্তির ঢেউ উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। আজকের এ বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর দৃশ্যমান অনেক উন্নতি ঘটেছে বটে; তবে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সংঘাত, সন্ত্রাস ও অপরাধপ্রবণতাও বেড়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। মানুষ পার্থিক সুখ ভোগের জন্য টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত। সততা, ন্যায়নীতি, মানবতা যেন আজ তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষে-মানুষে জাতিতে-জাতিতে হিংসা-বিদ্বেষ, বিরোধ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আজ প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই আজ দরকার, লোভ ও নির্লজ্জ ভোগবাদিতা পরিহার করে মহামানব্রত ব্রহ্মচারীজির প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করা। কল্যাণকর সমাজ, দেশ ও পৃথিবী গড়ে তুলতে সবাইকে সচেষ্ট হওয়া_ যেখানে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলিত হবে এক প্রীতির বন্ধনে। সেখানে সবাই 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে।' পরমারাধ্য গুরুদেবের এ মহাপ্রয়াণ দিবসে তাকে জানাই অসংখ্য প্রণতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
adv.scsaha@rediffmail.com
ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে দর্শন ও সংস্কৃত শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সংস্কৃত বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৩৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে ভারতের বৃন্দাবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি-লিট উপাধি পান। ভারত সরকার তাকে মহামহোপাধ্যায় ও ভারত শিরোমণি উপাধিতে ভূষিত করে।
ছোটবেলা থেকেই বঙ্কিম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। খালিশাকোটা হাইস্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। এ সময় বরিশালে জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় দেশবরেণ্য নেতা মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এ অধিবেশনে যোগদান করেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি ও ব্রিটিশবিরোধিতার ঢেউ বঙ্কিম চন্দ্রের কচিমনে রেখাপাত করে। তার মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত হয়। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় খদ্দরের পোশাক ব্যবহার করতে শুরু করেন। এভাবেই কিশোর বঙ্কিমের মনে যে সেবাধর্মের বীজ অঙ্কুরিত হয়, যা পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিকতার জগতে মহীরুহ হিসেবে দেখা দেয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ড. ব্রহ্মচারীজি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অসুস্থতার কারণে সাময়িকভাবে তিনি কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। ফরিদপুরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশের সময় প্রথম টার্গেট করে শ্রীঅঙ্গনকে। পাষণ্ড পাকসেনারা শ্রীঅঙ্গনের কীর্তনরত আট সন্ন্যাসীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। শ্রীঅঙ্গনের মূল মন্দিরটির চূড়া ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। এ সংবাদ শুনে ড. ব্রহ্মচারীজি গভীর শোকাতিভূত হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, 'যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি অন্ন গ্রহণ করবেন না।' তিনি অবিরত দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রার্থনায় রত থাকেন। উপবাসক্লিষ্ট ড. ব্রহ্মচারীজি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফলমূল খেয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। শরণার্থীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফরিদপুর ফিরে আসেন। প্রয়াত সন্ন্যাসীদের উদ্দেশে প্রভু সুন্দরের চরণে ভোগরাগ উৎসর্গ করে অন্ন গ্রহণ করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এ অবদান চির অম্লান ও চির অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী একাধারে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সর্বধর্ম সমন্বয়ে মূর্ত প্রতীক। এ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সবাইকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, মানুষ জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হয় না, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মুনষ্যত্বের বেদিমূলে দেশ ও জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জীব ও জগতের অশেষ কল্যাণ হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ১৯৩৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। ৪০ বছর আগে ১৮৯৩ সালে বীরসন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীকে সনাতন ধর্মের মর্মবাণী শুনিয়েছিলেন, সেই একই স্থানে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারত তথা এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী।
ড. ব্রহ্মচারীজির কাছে ঈশ্বরপ্রেম ও মানবতাবোধ একই সুরে গ্রথিত। মানবকল্যাণই হচ্ছে ধর্মাচরণের মূল ভিত্তি। তাই তিনি সারাজীবন মানুষকে মনুষ্যত্ব লাভে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ড. ব্রহ্মচারীজি মহাবতরী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের মানবধর্মের বিশ্বজনীন উদারতা প্রচার করেছিলেন। প্রেমের শাশ্বতবাণী শুনিয়ে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছিলেন। তিনি মূলত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে চারটি ভাষণ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা তার ভাষণের মর্মবাণী ও তাৎপর্য ফলাও করে প্রকাশ করে।
ড. ব্রহ্মচারীজি ধর্মকে নিছক আচার-অনুষ্ঠানের বেড়াজালে আবদ্ধ করতে চাননি। ধর্মচর্চা ছিল তার কাছে মানবকল্যাণ সাধনের একটি পথ মাত্র। তার মতে, যিনি সৎ, নিষ্ঠাবান, ভদ্র, বিনয়ী এবং অসাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী, তিনিই তো পরম ধার্মিক। তিনিই তো প্রকৃত মানুষ। মনুষ্যত্ব অর্জনই হলো ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্যে। মানুষের ধর্ম মানবধর্ম। সাধনা তার মানবকল্যাণ। ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজি শুধু পারলৌকিক ধর্মীয় চিন্তাতেই মগ্ন থাকতেন না। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও আর্তমানবতার সেবা এবং সমাজের কল্যাণই ছিল তার মূল লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক। তিনি বলতেন, 'একটি বৃক্ষের ফুলে গন্ধ, পাতায় তিক্ততা, কিন্তু বৃক্ষ একটাই।' সুতরাং বিশ্বের বিভিন্নতার মধ্যে তিনি বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই মনুষ্যত্বের অধিকারী 'একজন উত্তম খ্রিস্টান, উত্তম মুসলমান, উত্তম হিন্দু, উত্তম বৌদ্ধ এবং উত্তম ইহুদির মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। কেননা যা দ্বারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব গঠিত হয়, তা পৃথিবীজুড়ে এক এবং অভিন্ন।' ড. ব্রহ্মচারীজি আমেরিকায় দীর্ঘদিন অবস্থান করে খুব কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজচিত্র প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমেরিকার প্রাচুর্যের সমারোহ যত বেশিই হোক না কেন, তাদের চিত্তের দৈন্যদশাও ব্যাপক। ফলে প্রতিনিয়ত সেখানে 'অর্থের প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষের বেদনা, আর্তি ও হাহাকার দেখা দিয়েছে।' আজকের গ্গ্নোবালাইজেশনের যুগেও এ অশান্তির ঢেউ উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। আজকের এ বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর দৃশ্যমান অনেক উন্নতি ঘটেছে বটে; তবে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সংঘাত, সন্ত্রাস ও অপরাধপ্রবণতাও বেড়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। মানুষ পার্থিক সুখ ভোগের জন্য টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত। সততা, ন্যায়নীতি, মানবতা যেন আজ তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষে-মানুষে জাতিতে-জাতিতে হিংসা-বিদ্বেষ, বিরোধ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আজ প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই আজ দরকার, লোভ ও নির্লজ্জ ভোগবাদিতা পরিহার করে মহামানব্রত ব্রহ্মচারীজির প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করা। কল্যাণকর সমাজ, দেশ ও পৃথিবী গড়ে তুলতে সবাইকে সচেষ্ট হওয়া_ যেখানে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলিত হবে এক প্রীতির বন্ধনে। সেখানে সবাই 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে।' পরমারাধ্য গুরুদেবের এ মহাপ্রয়াণ দিবসে তাকে জানাই অসংখ্য প্রণতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
adv.scsaha@rediffmail.com
No comments