মহাজোট সরকারের ৩ বছর-স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই আছে by ডা. এম এ করীম
একটি রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি জনগণ। প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক_সব ধরনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর মুক্তি দিতে হলে এই জনগণকে, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন সবার জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ভালো স্বাস্থ্যসেবা। আমরা সবাই জানি, মানব উন্নয়নে স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। স্বাস্থ্য শুধু শরীরের রোগব্যাধি-দুর্বলতা বোঝায় না। এটা পরিপূর্ণভাবে মানসিক ও
সামাজিক সুস্থতাকে বোঝায়। স্বাস্থ্য প্রতিটি দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার। এই মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি বাহাত্তরের সংবিধানে দেওয়া আছে। সংবিধানের ১৫ (ক) এবং ১৮ (১)-এ তা সুস্পষ্ট। ১৫ (ক)-তে আছে, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব এবং ১৮ (১)-তে আছে, জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আতার ঘোষণা, 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' এবং বেইজিং নারী সম্মেলনের ঘোষণা 'শিশুদের জন্য বিশ্বনেতৃত্বের সম্মেলন', জনসংখ্যা ও উন্নয়নের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণার সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু সেই সব অঙ্গীকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার (যে যখন ক্ষমতায় ছিল) সাথি হিসেবে ছিল। আমাদের সমস্যা অনেক, কিন্তু ক্ষমতা সীমিত। এ দেশের জনগণের বিশাল অংশ গরিব। প্রায় ৬০ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর যদি মানব উন্নয়নের কথা বিবেচনায় আনি, তাহলে এ দেশকে সম্ভবত মাঝারি মানব উন্নয়নকারী দেশ হিসেবে ধরা যেতে পারে। স্বাস্থ্য ও মানব উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কারণেই রুগ্ণ স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য ও নিরক্ষতার জন্য দায়ী। তাই স্বাস্থ্যের সঙ্গে এখানেই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত। জনগণের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে এবং তার যদি উন্নতি ঘটে, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃত্তির হার বাড়বে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকবে। এ কারণেই জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ছিল অপরিহার্য। মহাজোটের ব্যর্থতা হলো, গত তিন বছরে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি জনগণকে উপহার দিতে পারল না। অথচ নির্বাচনী ওয়াদায় ছিল (১১.১), সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন করে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নবায়ন করা হবে। এই নীতির আলোকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত ১৮ হাজার ক্লিনিক চালু, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃসদন নিশ্চিত করা হবে।
জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। (১১.২) আর্সেনিক সমস্যা সামাধান করে ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি এবং ২০১০ সালের মধ্যে প্রতি বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হবে। (১১.৩) মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ও রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওষুধনীতি যুগোপযোগী করা হবে। হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদসহ দেশজ চিকিৎসা শিক্ষা এবং ভেষজ ওষুধের মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (১১.৮) এইচআইভি/এইডস, কুষ্ঠ, যক্ষ্মাসহ সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধব্যবস্থা এবং রোগ নিরাময়ে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি জনগণের কাছে উপহার দেওয়ার কথা বলেও তিন বছরে স্বাস্থ্যনীতি আলোর মুখ দেখছে না। এটা মহাজোট সরকারের ব্যর্থতা (আগেই বলেছি)। কিন্তু এর পেছনে রহস্য কী? এখনো এ দেশের জনগণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। যদিও বেসরকারি উচ্চমূল্যভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা যথেষ্ট বিস্তার লাভ করেছে। যাঁদের অর্থ আছে তাঁরা ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন। তাঁরা বিদেশে চিকিৎসার জন্যও যান। দেশে উন্নতমানের অনেক হাসপাতালও রয়েছে। দামি দামি ওষুধ পাওয়া যায়। এ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সামর্থ্য দরিদ্রদের নেই। দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খুবই অপ্রতুল এবং যা আছে তাও নিম্নমানের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেশে কমিউনিটি হাসপাতাল চালু করে। এটা ছিল দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবাদানের একটি মহৎ উদ্যোগ। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি হাসপাতাল চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যেই ১১ হাজার কমিউনিটি সেন্টার কাজ করছে। দুই হাজার ক্লিনিকে ইন্টারনেট ব্যবস্থাসহ ল্যাপটপ দিয়েছে। যার ফলে ছয় কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে। এ খাতে সরকার তিন বছরে সাফল্যের মুখ দেখাতে পেরেছে। কমিউনিটি হাসপাতাল যদি সঠিকভাবে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দরিদ্রের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তিতে উন্নতি ঘটবে। তবে শর্ত হলো, হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মহাজোট সরকার কিছুটা সফল হচ্ছে, তবে আশানুরূপ নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি জনবহুল দেশ। মোট জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ গ্রামে ও ২৪ শতাংশ শহরে বসবাস করে। ৪০ শতাংশ জনগণের বয়স ১৫ বছরের নিচে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ২০ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। ফলে জনসংখ্যার চাপও বেড়ে যাচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫০-এ নেমে এসেছে, যা ২০০৭ সালে ছিল ৬৫। মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ সালে (প্রতি লাখে জীবিত জন্মে) ৩২০ ছিল। ২০১০ সালে তা ১৯৪-তে নেমে এসেছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার মোটামুটি সজাগ। বিশেষ করে বিগত জোট সরকারের আমলে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে জনসংখ্যার হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জনবল ও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিতরণে ভালো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির ক্ষেত্রে সফলতার কারণে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) বাংলাদেশকে পুরস্কার প্রদান করে ২০১০ সালে। স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডারসহ গত তিন বছরে প্রায় ৪৫ হাজার জনবল নিয়োগ করেছে। তবে সরকার এই নিয়োগে বিগত জোট সরকারের পথই অনুসরণ করেছে। দলীয়করণের অভিযোগ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে এমবিবিএস। বিডিএস আসনসংখ্যা দুই হাজার ৩৭০ থেকে বাড়িয়ে বর্তমানে তিন হাজার ৩৪০-এ উন্নীত করেছে। চারটি নতুন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও চারটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু বিএমডিসি আইন করতে মহাজোট সরকার ব্যর্থ হয়েছে গত তিন বছরে। (জানা গেছে আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে প্রেরণ করেছে)। এই আইনের অভাবে দেশে ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মহাজোট সরকার। বর্তমানকালের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে যে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা ও খরা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার মৌলিক চাহিদার অন্যতম, যেমন_সুপেয় পানি, খাদ্য ও বাসস্থানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কলেরার জীবাণু আরো সক্রিয় হয়ে এসব রোগ বিস্তারে সহায়তা করে। সবার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা তিন বছরেও সরকার করতে পারেনি_এটা ব্যর্থতা। রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার ঘটার আগেই প্রতিরোধব্যবস্থাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিই উত্তম। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের সঙ্গে যেসব উপাদান সম্পৃক্ত সেগুলোর দিকে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়; যেমন_পুষ্টি, সুপেয় পানি ও সঠিক পয়োনিষ্কাশন, মুক্ত বায়ু, শিল্পের বর্জ্য এবং আর্সেনিকের মতো প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এসব বিষয়ে সরকার খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি। এ দেশে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা একেবারে অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় হয় বছরে মাত্র ১৩ মার্কিন ডলার। যার মধ্যে সরকারি ব্যয় চার থেকে পাঁচ মার্কিন ডলার। বাকি ব্যয় জনগণ বহন করে। সেই বেড়াজাল থেকে মহাজোট সরকার জনগণকে মুক্তি দিতে পারেনি। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ সেই আগের মতোই।
চিকিৎসা শিক্ষায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ালেও তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে-সেখানে মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠেছে। যেমন গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এগুলোর মান এবং রোগীর কাছ থেকে ফি আদায় নিয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। গত তিন বছরে সরকার তাদের একটা নীতিমালায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। চিকিৎসকরা গ্রামে যেতেই চান না। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো দেওয়ার পরও যদি কোনো চিকিৎসক গ্রামে যেতে না চান, তখন কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তাও সরকার তিন বছরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দলীয় চিকিৎসক হলে তো তাঁদের বেলায় কোনো আইনই প্রযোজ্য হয় না। বিগত তিন বছরে সাফল্য অনেক থাকলেও প্রান্তিক জনগণের কাছে এখনো স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছাতে পারেনি। পাঁচ বছর যদিও যথেষ্ট সময় নয়, তবু সমূহ করণীয়গুলো সঠিক সময়ে করা প্রয়োজন। তাই সবার আগে মহাজোট সরকারের উচিত হবে, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি জনগণকে উপহার দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। বাকি দুই বছর এখন মহজোট সরকারের সময়। মাঝি সাবধান না হলে তরী ডোবার আশঙ্কা।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসা
বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা
জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। (১১.২) আর্সেনিক সমস্যা সামাধান করে ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি এবং ২০১০ সালের মধ্যে প্রতি বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হবে। (১১.৩) মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ও রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওষুধনীতি যুগোপযোগী করা হবে। হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদসহ দেশজ চিকিৎসা শিক্ষা এবং ভেষজ ওষুধের মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (১১.৮) এইচআইভি/এইডস, কুষ্ঠ, যক্ষ্মাসহ সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধব্যবস্থা এবং রোগ নিরাময়ে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি জনগণের কাছে উপহার দেওয়ার কথা বলেও তিন বছরে স্বাস্থ্যনীতি আলোর মুখ দেখছে না। এটা মহাজোট সরকারের ব্যর্থতা (আগেই বলেছি)। কিন্তু এর পেছনে রহস্য কী? এখনো এ দেশের জনগণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। যদিও বেসরকারি উচ্চমূল্যভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা যথেষ্ট বিস্তার লাভ করেছে। যাঁদের অর্থ আছে তাঁরা ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন। তাঁরা বিদেশে চিকিৎসার জন্যও যান। দেশে উন্নতমানের অনেক হাসপাতালও রয়েছে। দামি দামি ওষুধ পাওয়া যায়। এ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সামর্থ্য দরিদ্রদের নেই। দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খুবই অপ্রতুল এবং যা আছে তাও নিম্নমানের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেশে কমিউনিটি হাসপাতাল চালু করে। এটা ছিল দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবাদানের একটি মহৎ উদ্যোগ। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি হাসপাতাল চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যেই ১১ হাজার কমিউনিটি সেন্টার কাজ করছে। দুই হাজার ক্লিনিকে ইন্টারনেট ব্যবস্থাসহ ল্যাপটপ দিয়েছে। যার ফলে ছয় কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে। এ খাতে সরকার তিন বছরে সাফল্যের মুখ দেখাতে পেরেছে। কমিউনিটি হাসপাতাল যদি সঠিকভাবে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দরিদ্রের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তিতে উন্নতি ঘটবে। তবে শর্ত হলো, হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মহাজোট সরকার কিছুটা সফল হচ্ছে, তবে আশানুরূপ নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি জনবহুল দেশ। মোট জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ গ্রামে ও ২৪ শতাংশ শহরে বসবাস করে। ৪০ শতাংশ জনগণের বয়স ১৫ বছরের নিচে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ২০ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। ফলে জনসংখ্যার চাপও বেড়ে যাচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫০-এ নেমে এসেছে, যা ২০০৭ সালে ছিল ৬৫। মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ সালে (প্রতি লাখে জীবিত জন্মে) ৩২০ ছিল। ২০১০ সালে তা ১৯৪-তে নেমে এসেছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার মোটামুটি সজাগ। বিশেষ করে বিগত জোট সরকারের আমলে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে জনসংখ্যার হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জনবল ও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিতরণে ভালো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির ক্ষেত্রে সফলতার কারণে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) বাংলাদেশকে পুরস্কার প্রদান করে ২০১০ সালে। স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডারসহ গত তিন বছরে প্রায় ৪৫ হাজার জনবল নিয়োগ করেছে। তবে সরকার এই নিয়োগে বিগত জোট সরকারের পথই অনুসরণ করেছে। দলীয়করণের অভিযোগ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে এমবিবিএস। বিডিএস আসনসংখ্যা দুই হাজার ৩৭০ থেকে বাড়িয়ে বর্তমানে তিন হাজার ৩৪০-এ উন্নীত করেছে। চারটি নতুন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও চারটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু বিএমডিসি আইন করতে মহাজোট সরকার ব্যর্থ হয়েছে গত তিন বছরে। (জানা গেছে আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে প্রেরণ করেছে)। এই আইনের অভাবে দেশে ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মহাজোট সরকার। বর্তমানকালের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে যে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা ও খরা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার মৌলিক চাহিদার অন্যতম, যেমন_সুপেয় পানি, খাদ্য ও বাসস্থানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কলেরার জীবাণু আরো সক্রিয় হয়ে এসব রোগ বিস্তারে সহায়তা করে। সবার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা তিন বছরেও সরকার করতে পারেনি_এটা ব্যর্থতা। রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার ঘটার আগেই প্রতিরোধব্যবস্থাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিই উত্তম। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের সঙ্গে যেসব উপাদান সম্পৃক্ত সেগুলোর দিকে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়; যেমন_পুষ্টি, সুপেয় পানি ও সঠিক পয়োনিষ্কাশন, মুক্ত বায়ু, শিল্পের বর্জ্য এবং আর্সেনিকের মতো প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এসব বিষয়ে সরকার খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি। এ দেশে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা একেবারে অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় হয় বছরে মাত্র ১৩ মার্কিন ডলার। যার মধ্যে সরকারি ব্যয় চার থেকে পাঁচ মার্কিন ডলার। বাকি ব্যয় জনগণ বহন করে। সেই বেড়াজাল থেকে মহাজোট সরকার জনগণকে মুক্তি দিতে পারেনি। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ সেই আগের মতোই।
চিকিৎসা শিক্ষায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ালেও তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে-সেখানে মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠেছে। যেমন গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এগুলোর মান এবং রোগীর কাছ থেকে ফি আদায় নিয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। গত তিন বছরে সরকার তাদের একটা নীতিমালায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। চিকিৎসকরা গ্রামে যেতেই চান না। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো দেওয়ার পরও যদি কোনো চিকিৎসক গ্রামে যেতে না চান, তখন কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তাও সরকার তিন বছরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দলীয় চিকিৎসক হলে তো তাঁদের বেলায় কোনো আইনই প্রযোজ্য হয় না। বিগত তিন বছরে সাফল্য অনেক থাকলেও প্রান্তিক জনগণের কাছে এখনো স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছাতে পারেনি। পাঁচ বছর যদিও যথেষ্ট সময় নয়, তবু সমূহ করণীয়গুলো সঠিক সময়ে করা প্রয়োজন। তাই সবার আগে মহাজোট সরকারের উচিত হবে, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি জনগণকে উপহার দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। বাকি দুই বছর এখন মহজোট সরকারের সময়। মাঝি সাবধান না হলে তরী ডোবার আশঙ্কা।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসা
বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments