চরম পানি সংকটের মুখে বাংলাদেশ-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশ এখন বহুমুখী বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এসব বিপর্যয়ের মধ্যে সব থেকে মারাত্মক ও বিপজ্জনক হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। বিষয়টি যে এ দেশের লোকদের অজানা এমন নয়। কিন্তু তা হলেও এ জানার মধ্যে কোনো গভীরতা নেই। এ কারণে বিষয়টি সম্পর্কে অস্বচ্ছভাবে কিছু জানা থাকলেও এ নিয়ে কোনো আতঙ্ক তো দূরের কথা, উদ্বেগও সাধারণভাবে নেই। হাতেগোনা কয়েকজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ছাড়া এ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা নড়াচড়া কোনো মহলে নেই।
এ ক্ষেত্রে যাদের করণীয় সব থেকে বেশি এবং যারা এ বিষয়টি হাতে না নিলে কিছুই হওয়ার নয়, সেই সরকার ও শাসকশ্রেণীর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা কী করে ক্ষমতায় টিকে থাকবে এবং ক্ষমতার বাইরে থাকলে কী করে ক্ষমতা আবার দখল করবে, এই চিন্তাই তাদের সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন ও গ্রাস করে রাখে। কাজেই এর বাইরে দেশের বহুবিধ গুরুতর সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা, কর্তব্য নির্ধারণ ও কর্তব্য পালন ক্ষেত্রে এরা বাস্তবত কিছুই করে না। খুব জোর তারা যা করে সেটা বাগাড়ম্বর সৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
পরিবেশ বিপর্যয় শুধু এক প্রকার নয়। এরও নানা প্রকার আছে। তবে এই নানা প্রকার বিপর্যয়ের মধ্যে সব থেকে গুরুতর হলো পানির সমস্যা। খাওয়ার পানি এবং কৃষি কাজ থেকে নিয়ে অন্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত পানির পরিমাণ বাংলাদেশে আতঙ্কজনকভাবে কমে আসছে। এটা হচ্ছে একদিকে সরবরাহ ও লভ্যতার ক্ষেত্রে ঘাটতি এবং অন্যদিকে পানি দূষিতকরণের কারণে। বাংলাদেশ চিরকাল নদীমাতৃক দেশ, নদীনালা, খালবিলের দেশ হিসেবে পরিচিত। এ দেশে পানির অভাবের কথা আগে কেউ কোনোদিন চিন্তাও করত না। কিন্তু এখন সেই নদীমাতৃক দেশে পানির অভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে সব থেকে বড় প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সমস্যা।
বাংলাদেশে ছোট-বড় নদীর সংখ্যা শতাধিক। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থল ভারতে। পদ্মা (গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র, যমুনার মতো প্রধান ও বিশাল নদীর উৎপত্তিস্থল তিব্বতে হলেও এগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে ভারতের মধ্য দিয়ে। এই নদীগুলোতে আগে যে জলপ্রবাহ ছিল এখন আর তা নেই। শুধু তাই নয়, এই নদীগুলো শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে এত শীর্ণ হয় ও মাঝে মধ্যে এত শুকিয়ে যায় যে তার ওপর দিয়ে মানুষ, জীবজন্তু, এমনকি যানবাহন পর্যন্ত চলাচল করে! এ দৃশ্য আগে কল্পনাতীত ছিল। বড় নদীগুলোর এই অবস্থার কারণে ছোট নদীগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। দিন দিন এ অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। চালই এখানকার প্রধান খাদ্য। আজকাল কিছু গম ও ভুট্টার চাষ হলেও ধানই প্রধান শস্য। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকার ফলে এখানে খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন বাড়ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় এখানে জনসংখ্যা ছিল সাত কোটির মতো। এখন এই সংখ্যা দ্বিগুণের থেকে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটির মতো। এই দ্বিগুণ লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য এখন খাদ্য উৎপাদনও সেই অনুপাতে বাড়াতে হয়েছে। এ জন্য কিছু অনাবাদি জমি নতুন করে আবাদযোগ্য করা হলেও অধিকাংশ জমিতে আগে যেখানে এক ফসল হতো, এখন সেখানে ফসল হচ্ছে বছরে দু'তিনটি। এর জন্য আগের তুলনায় কৃষি কাজের পানির প্রয়োজনও বেড়েছে দ্বিগুণের থেকে বেশি। নদীর পানি কমে আসতে থাকা এবং অনেক নদী মৃত নদীতে পরিণত হওয়ার কারণে ভূমির উপরিভাগ থেকে লভ্য পানির পরিমাণ ভয়ানক কমে এসেছে এবং ক্রমেই আরও কমে আসার পথে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি কাজের জন্য পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে মাটির নিচ থেকে পানি টেনে ওপরে নিয়ে এসে। এর জন্য বাংলাদেশে এখন গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ পাওয়ার পাম্প বসানো হয়েছে। এগুলো উপরিভাগের পানি সরবরাহ ঘাটতি পূরণ করছে। আগে সেচ ব্যবস্থায় ক্যানাল, ছোট ছোট খাল ও নালার মাধ্যমে যে পানি সরবরাহ হতো সেটা আসত সবটাই উপরিভাগের পানি থেকে অর্থাৎ প্রধানত নদী থেকে। কারণ নিচের পানি টেনে ওপরে তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় গভীর কুয়া থেকে পানি তুলে যেভাবে কৃষি জমিতে সরবরাহ করা হতো এবং এখনও করা হয়ে থাকে সেটা এই অঞ্চলে ছিল না। যদিও সামান্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোটখাটো কুয়া বা নলকূপের ব্যবহার দেখা যেত। কাজেই মাটির নিচের পানি কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন ব্যাপার।
কৃষি কাজের জন্যই শুধু নয়। ঢাকাসহ অন্য অনেক শহরে অকৃষি কাজে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য এখন ভূগর্ভের বা মাটির নিচের পানি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় ঢাকায় সরবরাহকৃত পানির তিন-চতুর্থাংশই এখন মাটির নিচ থেকে টেনে আনা হয়। এ জন্য ওয়াসা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাম্প বসিয়ে এই সরবরাহের কাজ করছে। কাজেই শুধু গ্রামাঞ্চলে কৃষি কাজের জন্যই নয়, অন্য কাজের জন্যও উপরিভাগের পানির পরিবর্তে নিচের পানিই ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, ওপরের পানি যতটা ব্যবহার করা সম্ভব তার কোনো চেষ্টাই এখন শাসন কর্তৃপক্ষ করছে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার মতো নদী থাকলেও এগুলোর পানি শুদ্ধ করে ঢাকায় সরবরাহের দিকে এদের কোনো প্রকৃত দৃষ্টি নেই, এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে দখলকারী থেকে নিয়ে দূষিতকরণ এবং অন্যান্য কারণে নদীগুলোতে পানির সরবরাহ কম ও পানি অব্যবহার্য হতে থাকার কারণে উপরিভাগের পানির সরবরাহ শহরে কমে আসছে। এই পরিস্থিতির চাপে নিচের পানি বর্ধিত পরিমাণে ওপরে টেনে তুলে ঢাকা শহরে পানির বিশাল চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এ কাজ যে শুধু সরকারি কর্তৃপক্ষই করছে তাই নয়, ঢাকার অনেক বহুতল ভবনের পানি সরবরাহও এভাবেই হচ্ছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য এগুলোতে যেমন জেনারেটর বসানো থাকে, তেমনি পানির ঘাটতি এবং সরবরাহের অনিয়মের কারণে পানির পাম্পও থাকে।
এভাবে ভূগর্ভের পানি ওপরে তুলে আনার কারণে পানির স্তর নিচে নামছে। সব থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার এই যে, পানির স্তর এভাবে ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। বর্ষার সময় বৃষ্টি হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে তা যে পরিমাণ ঢুকত বা রিচার্জ হতো তাতে আগে কোনো অসুবিধা হতো না। যেটুকু পানি কুয়া বা নলকূপের মাধ্যমে ওপরে তোলা হতো তা এর ফলে পূরণ হতো। কোনো সংকট তৈরি হতো না। কিন্তু এভাবে পানি তোলার ফলে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে এখন এক মহাসংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতেই এই সংকট পরিণত হবে এক প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয়ে এবং এটা যখন ঘটবে তখন করার মতো বিশেষ কিছুই থাকবে না।
পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যেতে থাকার ফলে ইতিমধ্যেই ঢাকা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পানি ওপরে টেনে তোলা কষ্টসাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া পানির স্তর একটা বিশেষ পর্যায়ে নেমে গেলে পানি তোলা আর সম্ভব হবে না, এই বিপদও বাংলাদেশের ঘাড়ের ওপর খড়্গের মতো ঝুলছে। এ ছাড়া অন্য ব্যাপারও আছে। পানি ওপরে তোলার ফলে ভূগর্ভে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, এই ফাঁকা জায়গা অল্পদিনের মধ্যেই লবণাক্ত পানিতে ভরে যাবে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বঙ্গোপসাগরের পানির গড় উচ্চতার তুলনায় ইতিমধ্যে দেড়শ' ফুট নিচে নেমে গেছে। এর ফলে সমুদ্রের লোনা পানি দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা শহরের ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশের শর্ত তৈরি হয়েছে। এর আগে ঢাকার উত্তরাসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে পানি নেমে এসে ঢাকার ভূ-অভ্যন্তরের ফাঁকা স্থান পূরণ করত। কিন্তু এখন লবণ পানি দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এর পরিণামে সারাদেশে কোনো অঞ্চলই লবণ পানির এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে না। ইতিমধ্যেই বিএডিসির ৪ হাজার পর্যবেক্ষণ নলকূপের মধ্যে ২ হাজার ৩০০টিতে সমুদ্রের লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে (সকালের খবর, ১৭.১০.২০১১)। এই প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই যে সমগ্র বাংলাদেশে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এর সংকেত এর মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে যে শুধু খাওয়ার পানির সংকট সৃষ্টি হবে তাই নয়, লবণাক্ত পানির কারণে কৃষিতেও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে এবং তার ফলে সৃষ্টি হবে ভয়াবহ খাদ্য সংকট।
এসব কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়। এ হলো বাস্তব সম্ভাবনা। কিন্তু এই বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে যেখানে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে চিন্তা, উদ্বেগ এবং আলাপ-আলোচনা হওয়ার কথা তার কিছুই হচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, যাদের এ বিষয় নিয়ে তোলপাড় করার কথা তারা বেশ নিশ্চিন্তেই আছে!
১৭.১০.২০১১
পরিবেশ বিপর্যয় শুধু এক প্রকার নয়। এরও নানা প্রকার আছে। তবে এই নানা প্রকার বিপর্যয়ের মধ্যে সব থেকে গুরুতর হলো পানির সমস্যা। খাওয়ার পানি এবং কৃষি কাজ থেকে নিয়ে অন্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত পানির পরিমাণ বাংলাদেশে আতঙ্কজনকভাবে কমে আসছে। এটা হচ্ছে একদিকে সরবরাহ ও লভ্যতার ক্ষেত্রে ঘাটতি এবং অন্যদিকে পানি দূষিতকরণের কারণে। বাংলাদেশ চিরকাল নদীমাতৃক দেশ, নদীনালা, খালবিলের দেশ হিসেবে পরিচিত। এ দেশে পানির অভাবের কথা আগে কেউ কোনোদিন চিন্তাও করত না। কিন্তু এখন সেই নদীমাতৃক দেশে পানির অভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে সব থেকে বড় প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সমস্যা।
বাংলাদেশে ছোট-বড় নদীর সংখ্যা শতাধিক। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থল ভারতে। পদ্মা (গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র, যমুনার মতো প্রধান ও বিশাল নদীর উৎপত্তিস্থল তিব্বতে হলেও এগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে ভারতের মধ্য দিয়ে। এই নদীগুলোতে আগে যে জলপ্রবাহ ছিল এখন আর তা নেই। শুধু তাই নয়, এই নদীগুলো শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে এত শীর্ণ হয় ও মাঝে মধ্যে এত শুকিয়ে যায় যে তার ওপর দিয়ে মানুষ, জীবজন্তু, এমনকি যানবাহন পর্যন্ত চলাচল করে! এ দৃশ্য আগে কল্পনাতীত ছিল। বড় নদীগুলোর এই অবস্থার কারণে ছোট নদীগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। দিন দিন এ অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। চালই এখানকার প্রধান খাদ্য। আজকাল কিছু গম ও ভুট্টার চাষ হলেও ধানই প্রধান শস্য। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকার ফলে এখানে খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন বাড়ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় এখানে জনসংখ্যা ছিল সাত কোটির মতো। এখন এই সংখ্যা দ্বিগুণের থেকে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটির মতো। এই দ্বিগুণ লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য এখন খাদ্য উৎপাদনও সেই অনুপাতে বাড়াতে হয়েছে। এ জন্য কিছু অনাবাদি জমি নতুন করে আবাদযোগ্য করা হলেও অধিকাংশ জমিতে আগে যেখানে এক ফসল হতো, এখন সেখানে ফসল হচ্ছে বছরে দু'তিনটি। এর জন্য আগের তুলনায় কৃষি কাজের পানির প্রয়োজনও বেড়েছে দ্বিগুণের থেকে বেশি। নদীর পানি কমে আসতে থাকা এবং অনেক নদী মৃত নদীতে পরিণত হওয়ার কারণে ভূমির উপরিভাগ থেকে লভ্য পানির পরিমাণ ভয়ানক কমে এসেছে এবং ক্রমেই আরও কমে আসার পথে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি কাজের জন্য পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে মাটির নিচ থেকে পানি টেনে ওপরে নিয়ে এসে। এর জন্য বাংলাদেশে এখন গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ পাওয়ার পাম্প বসানো হয়েছে। এগুলো উপরিভাগের পানি সরবরাহ ঘাটতি পূরণ করছে। আগে সেচ ব্যবস্থায় ক্যানাল, ছোট ছোট খাল ও নালার মাধ্যমে যে পানি সরবরাহ হতো সেটা আসত সবটাই উপরিভাগের পানি থেকে অর্থাৎ প্রধানত নদী থেকে। কারণ নিচের পানি টেনে ওপরে তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় গভীর কুয়া থেকে পানি তুলে যেভাবে কৃষি জমিতে সরবরাহ করা হতো এবং এখনও করা হয়ে থাকে সেটা এই অঞ্চলে ছিল না। যদিও সামান্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোটখাটো কুয়া বা নলকূপের ব্যবহার দেখা যেত। কাজেই মাটির নিচের পানি কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন ব্যাপার।
কৃষি কাজের জন্যই শুধু নয়। ঢাকাসহ অন্য অনেক শহরে অকৃষি কাজে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য এখন ভূগর্ভের বা মাটির নিচের পানি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় ঢাকায় সরবরাহকৃত পানির তিন-চতুর্থাংশই এখন মাটির নিচ থেকে টেনে আনা হয়। এ জন্য ওয়াসা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাম্প বসিয়ে এই সরবরাহের কাজ করছে। কাজেই শুধু গ্রামাঞ্চলে কৃষি কাজের জন্যই নয়, অন্য কাজের জন্যও উপরিভাগের পানির পরিবর্তে নিচের পানিই ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, ওপরের পানি যতটা ব্যবহার করা সম্ভব তার কোনো চেষ্টাই এখন শাসন কর্তৃপক্ষ করছে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার মতো নদী থাকলেও এগুলোর পানি শুদ্ধ করে ঢাকায় সরবরাহের দিকে এদের কোনো প্রকৃত দৃষ্টি নেই, এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে দখলকারী থেকে নিয়ে দূষিতকরণ এবং অন্যান্য কারণে নদীগুলোতে পানির সরবরাহ কম ও পানি অব্যবহার্য হতে থাকার কারণে উপরিভাগের পানির সরবরাহ শহরে কমে আসছে। এই পরিস্থিতির চাপে নিচের পানি বর্ধিত পরিমাণে ওপরে টেনে তুলে ঢাকা শহরে পানির বিশাল চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এ কাজ যে শুধু সরকারি কর্তৃপক্ষই করছে তাই নয়, ঢাকার অনেক বহুতল ভবনের পানি সরবরাহও এভাবেই হচ্ছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য এগুলোতে যেমন জেনারেটর বসানো থাকে, তেমনি পানির ঘাটতি এবং সরবরাহের অনিয়মের কারণে পানির পাম্পও থাকে।
এভাবে ভূগর্ভের পানি ওপরে তুলে আনার কারণে পানির স্তর নিচে নামছে। সব থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার এই যে, পানির স্তর এভাবে ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। বর্ষার সময় বৃষ্টি হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে তা যে পরিমাণ ঢুকত বা রিচার্জ হতো তাতে আগে কোনো অসুবিধা হতো না। যেটুকু পানি কুয়া বা নলকূপের মাধ্যমে ওপরে তোলা হতো তা এর ফলে পূরণ হতো। কোনো সংকট তৈরি হতো না। কিন্তু এভাবে পানি তোলার ফলে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে এখন এক মহাসংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতেই এই সংকট পরিণত হবে এক প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয়ে এবং এটা যখন ঘটবে তখন করার মতো বিশেষ কিছুই থাকবে না।
পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যেতে থাকার ফলে ইতিমধ্যেই ঢাকা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পানি ওপরে টেনে তোলা কষ্টসাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া পানির স্তর একটা বিশেষ পর্যায়ে নেমে গেলে পানি তোলা আর সম্ভব হবে না, এই বিপদও বাংলাদেশের ঘাড়ের ওপর খড়্গের মতো ঝুলছে। এ ছাড়া অন্য ব্যাপারও আছে। পানি ওপরে তোলার ফলে ভূগর্ভে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, এই ফাঁকা জায়গা অল্পদিনের মধ্যেই লবণাক্ত পানিতে ভরে যাবে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বঙ্গোপসাগরের পানির গড় উচ্চতার তুলনায় ইতিমধ্যে দেড়শ' ফুট নিচে নেমে গেছে। এর ফলে সমুদ্রের লোনা পানি দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা শহরের ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশের শর্ত তৈরি হয়েছে। এর আগে ঢাকার উত্তরাসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে পানি নেমে এসে ঢাকার ভূ-অভ্যন্তরের ফাঁকা স্থান পূরণ করত। কিন্তু এখন লবণ পানি দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এর পরিণামে সারাদেশে কোনো অঞ্চলই লবণ পানির এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে না। ইতিমধ্যেই বিএডিসির ৪ হাজার পর্যবেক্ষণ নলকূপের মধ্যে ২ হাজার ৩০০টিতে সমুদ্রের লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে (সকালের খবর, ১৭.১০.২০১১)। এই প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই যে সমগ্র বাংলাদেশে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এর সংকেত এর মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে যে শুধু খাওয়ার পানির সংকট সৃষ্টি হবে তাই নয়, লবণাক্ত পানির কারণে কৃষিতেও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে এবং তার ফলে সৃষ্টি হবে ভয়াবহ খাদ্য সংকট।
এসব কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়। এ হলো বাস্তব সম্ভাবনা। কিন্তু এই বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে যেখানে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে চিন্তা, উদ্বেগ এবং আলাপ-আলোচনা হওয়ার কথা তার কিছুই হচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, যাদের এ বিষয় নিয়ে তোলপাড় করার কথা তারা বেশ নিশ্চিন্তেই আছে!
১৭.১০.২০১১
No comments