বাংলা-উড়িষ্যার মিলনমেলায় একদিন by গৌতম লাহিড়ী
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে উড়িষ্যার শিল্পনগরী রাউরকেল্লায় অনুষ্ঠিত হলো 'নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের' ৮৪তম অধিবেশন। ১৯২৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারানসিতে বহির্বঙ্গের সাহিত্যপ্রেমী বাঙালিদের নিয়ে এ সংগঠনের গোড়াপত্তন করেছিলেন। কবিগুরুর পর এ সংগঠনে সভাপতিত্ব করেছেন বহু বাঙালি মনীষী, যাদের মধ্যে ছিলেন সরলাদেবী চৌধুরানী, অতুলপ্রসাদ সেন, যদুনাথ সরকার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশংকর রায়, বনফুল, প্রেমেন্দ্র
মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, হুমায়ুন কবির প্রমুখ। ১৯৮০ সাল থেকে এ সংগঠনের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করছেন ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভারতের এ ব্যস্ততম রাজনীতিবিদ প্রতি বছর এ সাহিত্য সংগঠনের সম্মেলনের সময় বের করে রাখেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তারই সঙ্গে ভারতের পূর্বপ্রান্তের উড়িষ্যার শহরে ৪ দিনব্যাপী সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বাংলার বাইরে বাঙালির বাংলাচর্চার এক ঝলক উপলব্ধি করলাম। বলতে দ্বিধা নেই যে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাংলা ভাষার প্রসারে এ সংগঠনের ভূমিকা প্রশংসনীয় হলেও ভাষার ব্যাপ্তিতে জড়তা এসেছে। কর্মসূত্রে বাঙালিকে ভিনরাজ্যে প্রবাস করতে হয়েছে। কিন্তু ভিনরাজ্যের প্রবাসী বাঙালিদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাংলাচর্চার প্রভাব কমছে। এ উদ্বেগ এবার সম্মেলনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। কার্যত একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন বক্তার মুখে। খোদ রাজধানী দিলি্লর বাংলা স্কুলগুলো ধুঁকছে। অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর প্রণব বাবু দিলি্লর বাংলা স্কুলগুলোর জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন। তাতে কিছুটা কাজ হয়।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাহিত্যপ্রেমী প্রায় ১৬ হাজার বাঙালি এ সংগঠনের আজীবন সদস্য। এদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রতিনিধি এবার রাউরকেল্লায় উপস্থিত ছিলেন। উড়িষ্যা ভাষা প্রধান এ শহরে প্রভাতফেরি এবং অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে 'মোদের গরব মোদের আশা, আ-ম-রি বাংলা ভাষার' সমবেত সঙ্গীতে পৌষের সকাল পবিত্র হয়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালে হুমায়ুন কবীর যখন এ সংগঠনের পৌরোহিত্য করেন তখন এ প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবী উপলব্ধি করেছিলেন দেশভাগের পর ভারতে যখন হিন্দিকেই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তখন বাংলা ভাষার প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথকেই হাতিয়ার করে বহু ভাষাভাষী ভারতের বাংলাচর্চার অভিযান চালানো যায়। তাই তিনি আগ্রার সম্মেলন থেকে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রতি রাজ্যে অন্তত একটি করে রবীন্দ্র ভবন গড়ে তোলার। সুখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী নেহরু ওই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। এবার সম্মেলনে সভাপতি তথা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব রাখলেন প্রতি জেলায় রবীন্দ্র ভবন গড়ে তোলার। বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য এক গণআন্দোলনের স্বীকৃতি মিলল সভায়। ভারতের কবিগুরুর সার্ধজন্মশতবার্ষিকী পালনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পৌরোহিত্যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে আগেই। ওই কমিটির সিদ্ধান্ত রূপায়ণের জন্য যে জাতীয় কমিটি রয়েছে তার চেয়ারম্যান প্রণব বাবু। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই কমিটির অন্যতম সদস্য। ফলে এ সিদ্ধান্ত রূপায়ণে কোনো আর্থিক প্রতিবন্ধকতা হবে না, সেটা সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা সম্যক উপলব্ধি করেছেন।
সম্মেলনের মূল সুর বেঁধে দিয়েছিলেন সংগঠনের সভাপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার দীক্ষান্ত ভাষণে বলেন, 'একালের বহির্বঙ্গের স্কুলগুলো থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষা যেমন উঠে গেছে, তেমনি ভাষা শিক্ষার পুনর্বাসনের চেষ্টাও করে গেছে। এটা বাঙালির জীবনের দুর্লক্ষণ। বাংলা সংবাদপত্র, বাংলা বই পড়ার চলও ক্রমহ্রাসমান। অনেক বাংলা লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো আছে সেগুলোর পাঠক সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি। এর পরিবর্তন চাই। বাঙালিকে তার জাতিসত্তা নিয়ে অস্তিত্বশীল থাকতে হলে তাকে মাতৃভাষা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে চলবে না। সেটা হবে কম অবলুপ্তির কারণ। বহির্বঙ্গের বাঙালিদের এখন একথা ভাবার সময় এসেছে।'
কোয়েল নদীর জলধারাপুষ্ট এ লালমাটির শহর রাউরকেল্লা সম্মেলনের জন্য বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রিয় স্থান এ রাজ্য। নিকটবর্তী জগৎসিংপুর জেলার অধীনে রয়েছে পাণ্ডুয়া গ্রাম। পূর্বতন নাম কুজঙ্গ এস্টেট। এখনও এখানে রয়েছে রবীন্দ্র কাছারি, রবীন্দ্র সরণি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর বর্ধমানের রাজা বনবিহারি চাদের থেকে কুজঙ্গ এস্টেটের কিছু অংশ কিনে নিয়েছিলেন। এখানেই এসে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন 'চিত্রাঙ্গদা' গীতিনাট্য। একবার তালদণ্ডা ক্যানাল দিয়ে কুজঙ্গে পালতোলা নৌকা নিয়ে আসার সময় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি লিখেছিলেন নৌকাডুবি উপন্যাস। কটক থেকে পুরী যাওয়ার পথে তিনি কালিদাস রচিত মেঘদূত কাব্যের বর্ণিত প্রকৃতির সাযুজ্য পেতেন। বলা ভালো, ভিনভাষী হওয়া সত্ত্বেও উড়িষ্যা সরকার যেভাবে এ সম্মেলনের জন্য সাহায্য করেছে তা ভারতের বিভিন্নতার মধ্যে একতার পরিচায়ক হয়ে ওঠে এ মিলনমেলা। সম্মেলনের সভাপতি বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড. উজ্জ্বল কুমার মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষের সঙ্গে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন উড়িষ্যার নগর উন্নয়নমন্ত্রী শারদাপ্রসাদ নায়ক, উপদেষ্টামণ্ডলীতে উড়িষ্যার সাংসদ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমানন্দা বিসওয়াল, বিধায়ক সুব্রত তরাই। বাংলা-উড়িষ্যার এ মিলনমেলা এক অনবদ্য ভবিষ্যতের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাহিত্যপ্রেমী প্রায় ১৬ হাজার বাঙালি এ সংগঠনের আজীবন সদস্য। এদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রতিনিধি এবার রাউরকেল্লায় উপস্থিত ছিলেন। উড়িষ্যা ভাষা প্রধান এ শহরে প্রভাতফেরি এবং অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে 'মোদের গরব মোদের আশা, আ-ম-রি বাংলা ভাষার' সমবেত সঙ্গীতে পৌষের সকাল পবিত্র হয়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালে হুমায়ুন কবীর যখন এ সংগঠনের পৌরোহিত্য করেন তখন এ প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবী উপলব্ধি করেছিলেন দেশভাগের পর ভারতে যখন হিন্দিকেই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তখন বাংলা ভাষার প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথকেই হাতিয়ার করে বহু ভাষাভাষী ভারতের বাংলাচর্চার অভিযান চালানো যায়। তাই তিনি আগ্রার সম্মেলন থেকে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রতি রাজ্যে অন্তত একটি করে রবীন্দ্র ভবন গড়ে তোলার। সুখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী নেহরু ওই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। এবার সম্মেলনে সভাপতি তথা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব রাখলেন প্রতি জেলায় রবীন্দ্র ভবন গড়ে তোলার। বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য এক গণআন্দোলনের স্বীকৃতি মিলল সভায়। ভারতের কবিগুরুর সার্ধজন্মশতবার্ষিকী পালনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পৌরোহিত্যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে আগেই। ওই কমিটির সিদ্ধান্ত রূপায়ণের জন্য যে জাতীয় কমিটি রয়েছে তার চেয়ারম্যান প্রণব বাবু। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই কমিটির অন্যতম সদস্য। ফলে এ সিদ্ধান্ত রূপায়ণে কোনো আর্থিক প্রতিবন্ধকতা হবে না, সেটা সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা সম্যক উপলব্ধি করেছেন।
সম্মেলনের মূল সুর বেঁধে দিয়েছিলেন সংগঠনের সভাপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার দীক্ষান্ত ভাষণে বলেন, 'একালের বহির্বঙ্গের স্কুলগুলো থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষা যেমন উঠে গেছে, তেমনি ভাষা শিক্ষার পুনর্বাসনের চেষ্টাও করে গেছে। এটা বাঙালির জীবনের দুর্লক্ষণ। বাংলা সংবাদপত্র, বাংলা বই পড়ার চলও ক্রমহ্রাসমান। অনেক বাংলা লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো আছে সেগুলোর পাঠক সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি। এর পরিবর্তন চাই। বাঙালিকে তার জাতিসত্তা নিয়ে অস্তিত্বশীল থাকতে হলে তাকে মাতৃভাষা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে চলবে না। সেটা হবে কম অবলুপ্তির কারণ। বহির্বঙ্গের বাঙালিদের এখন একথা ভাবার সময় এসেছে।'
কোয়েল নদীর জলধারাপুষ্ট এ লালমাটির শহর রাউরকেল্লা সম্মেলনের জন্য বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রিয় স্থান এ রাজ্য। নিকটবর্তী জগৎসিংপুর জেলার অধীনে রয়েছে পাণ্ডুয়া গ্রাম। পূর্বতন নাম কুজঙ্গ এস্টেট। এখনও এখানে রয়েছে রবীন্দ্র কাছারি, রবীন্দ্র সরণি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর বর্ধমানের রাজা বনবিহারি চাদের থেকে কুজঙ্গ এস্টেটের কিছু অংশ কিনে নিয়েছিলেন। এখানেই এসে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন 'চিত্রাঙ্গদা' গীতিনাট্য। একবার তালদণ্ডা ক্যানাল দিয়ে কুজঙ্গে পালতোলা নৌকা নিয়ে আসার সময় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি লিখেছিলেন নৌকাডুবি উপন্যাস। কটক থেকে পুরী যাওয়ার পথে তিনি কালিদাস রচিত মেঘদূত কাব্যের বর্ণিত প্রকৃতির সাযুজ্য পেতেন। বলা ভালো, ভিনভাষী হওয়া সত্ত্বেও উড়িষ্যা সরকার যেভাবে এ সম্মেলনের জন্য সাহায্য করেছে তা ভারতের বিভিন্নতার মধ্যে একতার পরিচায়ক হয়ে ওঠে এ মিলনমেলা। সম্মেলনের সভাপতি বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড. উজ্জ্বল কুমার মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষের সঙ্গে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন উড়িষ্যার নগর উন্নয়নমন্ত্রী শারদাপ্রসাদ নায়ক, উপদেষ্টামণ্ডলীতে উড়িষ্যার সাংসদ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমানন্দা বিসওয়াল, বিধায়ক সুব্রত তরাই। বাংলা-উড়িষ্যার এ মিলনমেলা এক অনবদ্য ভবিষ্যতের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে।
No comments