আইনের ফাঁকফোকরে স্কুলে আদায় হচ্ছে অতিরিক্ত ফি by সাবি্বর নেওয়াজ

রকারের জারি করা ভর্তি নীতিমালা কিংবা কোনো আইনই অভিভাবকদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই রাজধানীর নামিদামি স্কুলগুলোতে আদায় করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বহু গুণ বাড়তি অর্থ। বছরের শুরুতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এ ধরনের আচরণকে নৈরাজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন অভিভাবকরা।
মিরপুরের মনিপুর স্কুলের ঘটনা নিয়ে অভিভাবকরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলেও বাড়তি অর্থ আদায় থেমে নেই।


সরেজমিনে দেখা গেছে, মূল শাখাসহ মনিপুর স্কুলের চারটি ক্যাম্পাসেই মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হচ্ছে অভিভাবকদের। কেবল মনিপুর স্কুল নয়, ঢাকার অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। পরিচালনা কমিটির সদস্যরা স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, আর অভিভাবকরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েই সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব খুব সীমিত। আইনে পরিচালনা কমিটিকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি কত হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়ার এখতিয়ার কার সে সম্পর্কে আইনের বিধান অস্পষ্ট। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি সাধারণত পরিচালনা কমিটি নির্ধারণ করে। 'বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রবিধানমালা-১৯৭৭'-এর বলে বেসরকারি স্কুলগুলো পরিচালিত হয়। এ প্রবিধানমালাটি তৈরি হয়েছে ১৯৬১ সালের
'অনুমোদিত ম্যানেজিং কমিটি আইন'-এর ৩৯ ধারা এবং 'মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা-১৯৭৩'-এর ক্ষমতাবলে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের 'আয়ের উৎস' অনুচ্ছেদে প্রথমেই বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা হবে প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি থেকে। এর হার কী হবে তা নিয়ে অবশ্য আইনে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। আইনজ্ঞরা বলছেন, মূল আইন ও প্রবিধানমালার মাধ্যমে অভিভাবকদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা পরিচালনা কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা রোধ সম্ভব নয়। এটির সংশোধন ও যুগোপযোগী করার প্রয়োজন।
উপেক্ষিত ভর্তি নীতিমালা : গত ১৫ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অনুসরণীয় নীতিমালা জারি করে। এতে বলা হয়, ভর্তির আবেদন ফরমের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ টাকা গ্রহণ করা যাবে। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০, পৌর ও উপজেলা সদর এলাকায় ১০০০ এবং জেলা সদর এলাকায় ২০০০, ঢাকা ছাড়া অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩০০০, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫০০০ টাকার বেশি হবে না। সে হিসাবে ঢাকায় কোনো স্কুলেরই ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকা নেওয়া হলেও বেশি টাকা আদায়ের 'কৌশল' হিসেবে 'উন্নয়ন ফি' নাম দিয়ে অতিরিক্ত ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা দাবি করছেন, তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ভঙ্গ করেননি। ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকা আদায় করছেন। আবার কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকার বেশি নিচ্ছে। উপরন্তু মোটা অঙ্কের উন্নয়ন ফিও আদায় করছে। মনিপুর স্কুল কর্তৃপক্ষ এ বছর প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কেবল ভর্তি ফি আদায় করছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর ভর্তি ফি নিচ্ছে ৬ হাজার ৭৫০ টাকা। এছাড়া স্কুল থেকে খাতা সরবরাহ করার নামে প্রাথমিক স্তরে ৩০০ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৪০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তিতে মনিপুর স্কুল ২০ হাজার টাকা করে ডোনেশন নিচ্ছে 'উন্নয়ন ফি'র নাম করে। এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তিতে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৭ হাজার ৫শ', মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১৩ হাজার ৭শ', একই স্কুলের মুগদা শাখায় ১৩ হাজার ৭শ' টাকার সঙ্গে উন্নয়ন ফি বাবদ আরও ২০ হাজার টাকা, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ শ্রেণী ভেদে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা আদায় করছে। রাজধানীর সেন্ট যোসেফ, ওয়াইডবি্লউসিএ ও উদয়ন স্কুলসহ বেশিরভাগ স্কুলই সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেবল সতর্ক করে দেওয়ার মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে।
'অভিভাবক ঐক্য ফোরাম' সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সমকালকে বলেন, 'আইনের সীমাবদ্ধতা থাকলে আইন সংশোধন করতে হবে। তবুও বছর বছর ফি বৃদ্ধির নামে জিম্মি করে অভিভাবকদের কাছ থেকে ডাকাতি করার মতো অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যাবে না।' তিনি বলেন, 'রাজধানীর কোন কোন প্রতিষ্ঠান ডোনেশনের নামে অভিভাবকদের গলা কাটছে, তার তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফোরামের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হয়েছে। এবার আমরা কার্যকর ব্যবস্থা দেখতে চাই।'
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.