প্রতিশোধ নয়, ন্যায়ের জন্য-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by তারিক আলী
একটি জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ প্রতিদিন ঘটে না। আজ থেকে চলি্লশ বছর আগে দেশের যত কামার-কুমার, মাঝি আর কৃষকের সন্তান_ রবীন্দ্রনাথ যাদের আদর করে ডাকতেন 'জন্মলক্ষ্মীছাড়ার দল' নয় মাস রক্ত আর আগুনে সাঁতার কেটে জন্ম দিয়েছিল একটি স্বাধীন দেশের। অসম্ভবকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে আনতে চাওয়ার মধ্যে উদ্ধত ভাবটি, বাঙালির চরিত্রে আরও দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের সূত্রে। নয়তো 'অন্নপায়ী বঙ্গবাসী'
হয়েই তাকে থাকতে হতো আরও পাঁচশ' বছর। বাঙালি চরিত্রে পৃথিবীর সবকিছুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার এই যে মানসিকতা, পশ্চিমা বিশ্বের চোখে ত্রুটিযুক্ত এবং কিছুটা ঠাট্টার বস্তু হিসেবেও পরিগণিত হয়ে থাকে, সেটিই হচ্ছে তার চরিত্রের সুদৃঢ়তম পাটাতন, যা তাকে বিভিন্ন আপাতবিরোধিতার মধ্য থেকে খানিকটা হতবুদ্ধি এবং বেসামাল অবস্থায় হলেও উঠে আসতে সাহায্য করেছে।
এই পাটাতনটি ভারতবর্ষের নেই, পাকিস্তানের তো নয়ই। তাই আমরা যতই নিজেদের কশাঘাত করে জর্জরিত করি না কেন যে দেশের জনগণকে রাজনীতিকরা কতটা হতাশ করেছেন, অথবা দেশ দুর্নীতিতে কতটা ছেয়ে গেছে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি কতটা দূরে পেঁৗছে গেছে, দেশের মানুষের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর যে শক্তি মাঝে মধ্যেই দৃষ্ট হয়, সে জন্য নিজেদের আমরা ভাগ্যবানই ভাবব। দেশের যুব সমাজও মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ জীবনের আকাশচুম্বী মূল্যের অমর্যাদা ঘটায়নি। গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তাদের দ্ব্যর্থহীন রায় জানিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে।
বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনালের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে প্রথমবারের মতো ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা পরের সব বিদেশের ট্রাইব্যুনালগুলোতে অনুসৃত হয়েছে। এই বিচারকার্য আমরা যদি সুসম্পন্ন করতে পারি তবে আইন আদালতের বিশ্বে এই অর্জন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল সম্মান বয়ে আনবে। এছাড়া এই বিচারকার্য প্রায়শই নৈরাজ্য দংশিত এই উপমহাদেশে আপদকালীন অবস্থায় অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে কতগুলো আদর্শভিত্তিক নীতিও সুদৃঢ় করতে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনাল বিশ্বসমাজে ইতিমধ্যে এমন আস্থার জন্ম দিতে পেরেছে যে নিছক প্রতিশোধ-বশবর্তী বিচার এটি নয়, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত যারা, তাদের জীবনে সমাপনজনিত একটি স্বস্তির ধারণা এনে দেওয়ার জন্যই এই বিচারের আয়োজন। বিচার সুসম্পন্ন করার জন্য সুশীল সমাজেরও বিরাট ভূমিকা আছে। টোকিও ট্রায়ালের পরের সব বিচারেই সুশীল সমাজ দায়িত্ব পালন করেছে এবং বাংলাদেশে এর ব্যত্যয় সমীচীন হবে না।
১. জেনোসাইডের স্বীকৃতি : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, সেই সময়কার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে সেটি জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। যেখানে হাইতি এবং সিয়েরা লিয়নে সংঘটিত সহিংসতাকে গণহত্যার পর্যায়ে দেখা হয়, বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ মানুষ আজও সেই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। যদি সুশীল সমাজ এই বিচারকার্যে যথাযোগ্য উদ্যোগ নিতে পারে, তবে বিচারের সঙ্গে '৭১-এর হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা হিসেবে মূল্যায়িত হবে।
২. আত্মসমালোচনা : এতদিন পরে হলেও একটি জাতি হিসেবে আমাদের বয়োপ্রাপ্তি তখনই ঘটবে, যখন আমরা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা করব না যে সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুদের এবং সমষ্টিগতভাবে আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্ন লোকদের বেছে বেছে হত্যা এবং তারা লুটপাটের শিকার হয়েছিল। ১৯৭১ সালে যখন আমাদের প্রতিবেশী খুন বা ধর্ষিত হয় বা তার বাড়িঘর লুট হয়ে যায়, তখন অনেকেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সেই লুট করা সম্পদ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য সবটাই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। আমাদের আজ সেই সৎসাহস থাকা উচিত লুটের মালের সন্ধানে আমরা নিজেদের বাড়ির দিকেও যেন তাকাই, সেখানে কিছু আছে কি-না।
৩. ১৯৭১ সালের জন্মবৃত্তান্তের সঠিক মূল্যায়নও এই বিচারকার্য আরও সুষ্ঠুভাবে উন্মোচিত করতে পারে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সেই রাষ্ট্রের এলিট শ্রেণীর ভুল পরিচালনার ফলে পূর্ববাংলায় মানবাধিকারের প্রায় সব ধারাই লঙ্ঘিত হতে থাকে, যার চরম প্রয়োগ ঘটে ১৯৭১-এ। বাংলাদেশের কিছু মানুষের মনে আজও সেই পাকিস্তানি চিন্তাধারা বিদ্যমান। জাতিগত এবং ধর্মগত শ্রেষ্ঠত্ববোধের কিছু পশ্চাদ্মুখী এবং সংস্কারবিরোধী চিন্তা এখনও অনেকের মধ্যে কাজ করে। বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সেই পদক্ষেপ নিতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে এসব পশ্চাদ্মুখী ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং অন্যের ধর্ম বর্জনবাদের ধারা বাংলাদেশে শিকড় গাড়তে না পারে। ভবিষ্যতের বিশ্বে বাস করতে হলে এটির একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।
৪. সাক্ষীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা : দেশের সুশীল সমাজকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে পুলিশের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। সাক্ষীরা যেন নিজেদের নিরাপদ মনে করে এ জন্য পুলিশের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়াও সমাজের নানা মানুষ তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কাজ করবেন। আপদকালীন যোগাযোগের পরম্পরা, প্রক্রিয়া, ভলান্টিয়ার নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে পালনীয়গুলো লিখিতভাবে থাকতে হবে। যেখানে ক্ষমতার অন্যায় প্রয়োগের কারণে, বিশেষ করে লিঙ্গঘটিত অপরাধের শতকরা ৫০টি বিচারকার্যই সাক্ষীর অভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না, সেখানে সাক্ষীদের নিরাপত্তা একমাত্র দেশের সামাজিক শক্তিগুলোই প্রতিরোধের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারে।
৫.বধ্যভূমি সংরক্ষণ : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যদিও দেশের প্রায় ৭০০টি বধ্যভূমির ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে এবং মাত্রায় তথ্য সংরক্ষিত আছে, দেশে আরও কয়েক হাজার বধ্যভূমি থাকার সম্ভাবনাই বেশি। যুব সম্প্রদায় এই তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা বধ্যভূমি এবং পীড়িত মানুষের নামধামসহ হত্যাকারীদের সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করে সংরক্ষণ করতে পারে। আমরা আশায় বুক বাঁধি যখন দেখি লক্ষ্মীপুরের নন্দীগ্রামে স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের চাপে যে বধ্যভূমিটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, সেই বধ্যভূমি সেখানকার যুব সম্প্রদায় পুনরুদ্ধারই শুধু করেনি, সেটাকে চিহ্নিত করেছে এবং বার্ষিক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানে শহীদদের স্মরণও করা হচ্ছে। আর একটি উপ-উদ্যোগ হিসেবে তারা দেশের সব বধ্যভূমি স্যাটেলাইট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে স্থাপন করতে পারে। ঢাকা শহরে যত বধ্যভূমি আছে সেখানে সহজে যাওয়ার জন্য একটি মানচিত্রও প্রকাশ করা যেতে পারে, যাতে ট্যুরিস্টরা সহজেই ঢাকার বধ্যভূমিগুলোতে পেঁৗছতে পারে।
৬. বিচারের সময় রাজাকাররা শুধু আদেশ পালন করেছে, আদালতে এমন বক্তব্য জোরালোভাবে প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে দেশের সুশীল সমাজ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। পৃথিবীর কোথাও কোনো যুদ্ধাপরাধীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি এ কারণে যে, সে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এ জন্য বিচার সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে ট্রাইব্যুনালের কাছে যে ওয়েবসাইটটি আছে, তার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যুব সমাজ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী দেশ-বিদেশের আইনজ্ঞদের ডাটা ব্যাংক তৈরি করতে পারে।
৭. তথ্য ব্যাংক : বর্তমান ট্রাইব্যুনালে মাত্র গুটি কয়েক যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক যুদ্ধাপরাধী এবং সাক্ষী মারা গেছে এবং এর সঙ্গে সেই অপরাধের সব তথ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে যুব সম্প্রদায়ের উচিত হবে আপন আপন এলাকার যুদ্ধাপরাধী এবং এর সাক্ষীদের দেওয়া তথ্য সংরক্ষণ করা। একটি কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইট স্থাপন করে সেখানে একটি যাচাই কমিটির মাধ্যমে তা স্থাপন করা। কয়েক বছর আগে বজলুর রহমান স্মৃতি পদকের প্রবর্তন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সেটি সঠিক তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণমূলক গোটা কয়েক কর্মশিবির পরিচালনা করেছে। সেই শিবিরে আলোচিত বিষয় নিয়ে যে বুকলেট আছে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮. প্রথম কয়েকটি যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের যুব সমাজ টু্রথ এবং রিকনসিলিয়েশনের একটি উদ্যোগ নিতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্য যে প্রতিশোধ নয় সেটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং সমাজে সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্যই এই বিচারের দরকার, যাতে আমরা একটি সহিষ্ণু, সম্প্রীতির সমাজের মধ্যে বাস করতে পারি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজে আরও অনেক পৃথকতার জন্ম হবে, সে সব পৃথকতার মধ্যেও সহিষ্ণুতার সঙ্গে বাস করাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ বিশ্বে বাংলাদেশের পাথেয়।
তারিক আলী : ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং যুগ্ম সমন্বয়ক, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চ
এই পাটাতনটি ভারতবর্ষের নেই, পাকিস্তানের তো নয়ই। তাই আমরা যতই নিজেদের কশাঘাত করে জর্জরিত করি না কেন যে দেশের জনগণকে রাজনীতিকরা কতটা হতাশ করেছেন, অথবা দেশ দুর্নীতিতে কতটা ছেয়ে গেছে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি কতটা দূরে পেঁৗছে গেছে, দেশের মানুষের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর যে শক্তি মাঝে মধ্যেই দৃষ্ট হয়, সে জন্য নিজেদের আমরা ভাগ্যবানই ভাবব। দেশের যুব সমাজও মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ জীবনের আকাশচুম্বী মূল্যের অমর্যাদা ঘটায়নি। গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তাদের দ্ব্যর্থহীন রায় জানিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে।
বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনালের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে প্রথমবারের মতো ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা পরের সব বিদেশের ট্রাইব্যুনালগুলোতে অনুসৃত হয়েছে। এই বিচারকার্য আমরা যদি সুসম্পন্ন করতে পারি তবে আইন আদালতের বিশ্বে এই অর্জন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল সম্মান বয়ে আনবে। এছাড়া এই বিচারকার্য প্রায়শই নৈরাজ্য দংশিত এই উপমহাদেশে আপদকালীন অবস্থায় অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে কতগুলো আদর্শভিত্তিক নীতিও সুদৃঢ় করতে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনাল বিশ্বসমাজে ইতিমধ্যে এমন আস্থার জন্ম দিতে পেরেছে যে নিছক প্রতিশোধ-বশবর্তী বিচার এটি নয়, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত যারা, তাদের জীবনে সমাপনজনিত একটি স্বস্তির ধারণা এনে দেওয়ার জন্যই এই বিচারের আয়োজন। বিচার সুসম্পন্ন করার জন্য সুশীল সমাজেরও বিরাট ভূমিকা আছে। টোকিও ট্রায়ালের পরের সব বিচারেই সুশীল সমাজ দায়িত্ব পালন করেছে এবং বাংলাদেশে এর ব্যত্যয় সমীচীন হবে না।
১. জেনোসাইডের স্বীকৃতি : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, সেই সময়কার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে সেটি জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। যেখানে হাইতি এবং সিয়েরা লিয়নে সংঘটিত সহিংসতাকে গণহত্যার পর্যায়ে দেখা হয়, বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ মানুষ আজও সেই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। যদি সুশীল সমাজ এই বিচারকার্যে যথাযোগ্য উদ্যোগ নিতে পারে, তবে বিচারের সঙ্গে '৭১-এর হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা হিসেবে মূল্যায়িত হবে।
২. আত্মসমালোচনা : এতদিন পরে হলেও একটি জাতি হিসেবে আমাদের বয়োপ্রাপ্তি তখনই ঘটবে, যখন আমরা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা করব না যে সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুদের এবং সমষ্টিগতভাবে আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্ন লোকদের বেছে বেছে হত্যা এবং তারা লুটপাটের শিকার হয়েছিল। ১৯৭১ সালে যখন আমাদের প্রতিবেশী খুন বা ধর্ষিত হয় বা তার বাড়িঘর লুট হয়ে যায়, তখন অনেকেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সেই লুট করা সম্পদ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য সবটাই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। আমাদের আজ সেই সৎসাহস থাকা উচিত লুটের মালের সন্ধানে আমরা নিজেদের বাড়ির দিকেও যেন তাকাই, সেখানে কিছু আছে কি-না।
৩. ১৯৭১ সালের জন্মবৃত্তান্তের সঠিক মূল্যায়নও এই বিচারকার্য আরও সুষ্ঠুভাবে উন্মোচিত করতে পারে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সেই রাষ্ট্রের এলিট শ্রেণীর ভুল পরিচালনার ফলে পূর্ববাংলায় মানবাধিকারের প্রায় সব ধারাই লঙ্ঘিত হতে থাকে, যার চরম প্রয়োগ ঘটে ১৯৭১-এ। বাংলাদেশের কিছু মানুষের মনে আজও সেই পাকিস্তানি চিন্তাধারা বিদ্যমান। জাতিগত এবং ধর্মগত শ্রেষ্ঠত্ববোধের কিছু পশ্চাদ্মুখী এবং সংস্কারবিরোধী চিন্তা এখনও অনেকের মধ্যে কাজ করে। বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সেই পদক্ষেপ নিতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে এসব পশ্চাদ্মুখী ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং অন্যের ধর্ম বর্জনবাদের ধারা বাংলাদেশে শিকড় গাড়তে না পারে। ভবিষ্যতের বিশ্বে বাস করতে হলে এটির একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।
৪. সাক্ষীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা : দেশের সুশীল সমাজকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে পুলিশের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। সাক্ষীরা যেন নিজেদের নিরাপদ মনে করে এ জন্য পুলিশের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়াও সমাজের নানা মানুষ তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কাজ করবেন। আপদকালীন যোগাযোগের পরম্পরা, প্রক্রিয়া, ভলান্টিয়ার নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে পালনীয়গুলো লিখিতভাবে থাকতে হবে। যেখানে ক্ষমতার অন্যায় প্রয়োগের কারণে, বিশেষ করে লিঙ্গঘটিত অপরাধের শতকরা ৫০টি বিচারকার্যই সাক্ষীর অভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না, সেখানে সাক্ষীদের নিরাপত্তা একমাত্র দেশের সামাজিক শক্তিগুলোই প্রতিরোধের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারে।
৫.বধ্যভূমি সংরক্ষণ : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যদিও দেশের প্রায় ৭০০টি বধ্যভূমির ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে এবং মাত্রায় তথ্য সংরক্ষিত আছে, দেশে আরও কয়েক হাজার বধ্যভূমি থাকার সম্ভাবনাই বেশি। যুব সম্প্রদায় এই তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা বধ্যভূমি এবং পীড়িত মানুষের নামধামসহ হত্যাকারীদের সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করে সংরক্ষণ করতে পারে। আমরা আশায় বুক বাঁধি যখন দেখি লক্ষ্মীপুরের নন্দীগ্রামে স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের চাপে যে বধ্যভূমিটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, সেই বধ্যভূমি সেখানকার যুব সম্প্রদায় পুনরুদ্ধারই শুধু করেনি, সেটাকে চিহ্নিত করেছে এবং বার্ষিক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানে শহীদদের স্মরণও করা হচ্ছে। আর একটি উপ-উদ্যোগ হিসেবে তারা দেশের সব বধ্যভূমি স্যাটেলাইট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে স্থাপন করতে পারে। ঢাকা শহরে যত বধ্যভূমি আছে সেখানে সহজে যাওয়ার জন্য একটি মানচিত্রও প্রকাশ করা যেতে পারে, যাতে ট্যুরিস্টরা সহজেই ঢাকার বধ্যভূমিগুলোতে পেঁৗছতে পারে।
৬. বিচারের সময় রাজাকাররা শুধু আদেশ পালন করেছে, আদালতে এমন বক্তব্য জোরালোভাবে প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে দেশের সুশীল সমাজ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। পৃথিবীর কোথাও কোনো যুদ্ধাপরাধীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি এ কারণে যে, সে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এ জন্য বিচার সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে ট্রাইব্যুনালের কাছে যে ওয়েবসাইটটি আছে, তার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যুব সমাজ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী দেশ-বিদেশের আইনজ্ঞদের ডাটা ব্যাংক তৈরি করতে পারে।
৭. তথ্য ব্যাংক : বর্তমান ট্রাইব্যুনালে মাত্র গুটি কয়েক যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক যুদ্ধাপরাধী এবং সাক্ষী মারা গেছে এবং এর সঙ্গে সেই অপরাধের সব তথ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে যুব সম্প্রদায়ের উচিত হবে আপন আপন এলাকার যুদ্ধাপরাধী এবং এর সাক্ষীদের দেওয়া তথ্য সংরক্ষণ করা। একটি কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইট স্থাপন করে সেখানে একটি যাচাই কমিটির মাধ্যমে তা স্থাপন করা। কয়েক বছর আগে বজলুর রহমান স্মৃতি পদকের প্রবর্তন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সেটি সঠিক তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণমূলক গোটা কয়েক কর্মশিবির পরিচালনা করেছে। সেই শিবিরে আলোচিত বিষয় নিয়ে যে বুকলেট আছে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮. প্রথম কয়েকটি যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের যুব সমাজ টু্রথ এবং রিকনসিলিয়েশনের একটি উদ্যোগ নিতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্য যে প্রতিশোধ নয় সেটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং সমাজে সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্যই এই বিচারের দরকার, যাতে আমরা একটি সহিষ্ণু, সম্প্রীতির সমাজের মধ্যে বাস করতে পারি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজে আরও অনেক পৃথকতার জন্ম হবে, সে সব পৃথকতার মধ্যেও সহিষ্ণুতার সঙ্গে বাস করাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ বিশ্বে বাংলাদেশের পাথেয়।
তারিক আলী : ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং যুগ্ম সমন্বয়ক, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চ
No comments