ইতিহাসের বিস্ময়কর পুনরাবৃত্তি-রাজনীতি byএম আবদুল হাফিজ
ক্ষমতা তার ধারককে অনেক কিছুই দেয়। দেয় প্রভাব, প্রতিপত্তি, মর্যাদা এবং আধিপত্য। এর অনেকটাই অধিবাস্তব (ঝঁৎৎবধষ) মার্গের চলমান ক্ষমতার দুর্গে বসে তা বোঝার সুযোগ থাকে না। আজকের প্রসঙ্গমূলে ক'বছর আগে খালেদা জিয়ার সে সুযোগ ছিল না। ইতিহাসের অমোঘ পুনরাবৃত্তিতে সে সুযোগ আজ শেখ হাসিনারও নেই। তিনিও আজ এক ধরনের মেগালো ম্যানিয়ার অসহায় শিকার ১৯৯৬ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন অনেক
হোঁচট খাওয়ার পর একটি পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল এবং উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। ষষ্ঠ সংসদের বিরোধী দলবর্জিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হঠাৎই হয়ে ওঠে বিস্ফোরণোন্মুখ। আন্দোলনের গতিবেগ ধরে রাখতে আওয়ামী লীগ যখন মরিয়া হয়ে লড়ছে, পুরো সময়জুড়ে তাদের ওপর নেমে এসেছে ব্যাপক নিপীড়ন ও পুলিশি নির্যাতন। সে দিনগুলোতে সে সময়কার সংসদে আওয়ামী লীগের এক অনুজপ্রতিম সদস্যের সঙ্গে আমার প্রচুর মতবিনিময় হতো। দলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে রাজপথে সক্রিয় এ রাজনীতিক অকপটে স্বীকার করত, পুলিশি অ্যাকশনের মুখে তার দলের (আওয়ামী লীগ) অসহায়ত্বের কথা। বিএনপি ও ছাত্রদল ক্যাডারদের হাতে পর্যুদস্ত আওয়ামী অ্যাক্টিভিস্টদের দলীয় ভবিষ্যৎ সম্পর্কের কথা সে সরলচিত্তে ব্যক্ত করত।
আওয়ামী লীগের তখন নিতান্তই দুর্দিন। দুই যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকার পর তার প্রাণশক্তি প্রায় নিঃশেষিত। হাজারও অপবাদের কলঙ্ক-কালিমা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে দলটি তখন প্রায় অপাঙ্ক্তেয়। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পর্যন্ত তখন রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সামাজিকভাবেও দূষণীয়। তদুপরি এককালের বিশাল আওয়ামী লীগ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মকলহে দলটি ক্ষতবিক্ষত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনোত্তর আওয়ামী লীগের জমজমাট অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে ১৯৯৬ সালে শুধু তার কঙ্কালই অবশিষ্ট ছিল।
এটি সত্ত্বেও এ দুর্দিনেও আওয়ামী লীগ ছিল আমার ফেভারিট। মনে করতাম স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দলটি যা নাকি অর্ধশতাব্দীর মতো প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এবং তারপরও নির্যাতিত হয়েছে_ সেই দলটির ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। দলটির দীর্ঘদিনের লব্ধ অভিজ্ঞতা জাতির স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ ছিল অসংখ্য স্খলন ও বিচ্যুতির দায়ে অভিযুক্ত এবং তার দুঃশাসনে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ। তবু তাদের সরকারের যখন '৭৫ সালে একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয়, মনে হয়েছিল অপরাধের গুরুভার সত্ত্বেও এ নির্মম পরিণতি তাদের প্রাপ্য ছিল না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মতো এক ঐতিহ্যমণ্ডিত দলের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনার স্ফুরণের জন্য তিন বা চার বছর কোনো সময়ই নয়, বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য। তাও আবার আন্তর্জাতিকভাবে বৈরী একটি সময়ে।
আওয়ামী লীগের জন্য এ দুর্বলতার পেছনে আরও ছিল ২০ বছরের 'জাতীয়তাবাদী' শাসনের রহপঁসনবহপু ঋধপঃড়ৎ. 'জাতীয়তাবাদে'র মন্ত্রে দীক্ষিত সরকার বিভিন্ন হলেও এবং শাসনশৈলী ও পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটি অরাজনৈতিক সরকারের সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। স্বভাবতই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনিবার্যভাবে একটি অচলাবস্থা শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
পাকিস্তান আমলের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল। তার পুনরাবৃত্তি ও প্রলম্বন জনগণের কাছে আবারও শাসরুদ্ধকর মনে হতে লাগল। তারা আবার গণতন্ত্রের ্তুহড়রংব ধহফ পযধড়ং্থ-এ ফিরে যেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক উত্তরণে গণতন্ত্রের স্থান কিছুটা থাকলেও 'জাতীয়তাবাদী' রাজনীতির তিক্ততা রয়েই গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করা এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে মাখামাখির প্রবণতা অপরিবর্তিতই রয়ে গিয়েছিল। একইভাবে অব্যাহত ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের মনগড়া ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা। এ ছাড়াও যে অরাজকতা, অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা নিয়ে বাংলাদেশের শুরু হয়েছিল, তা থেকে রেহাই পাওয়া তো দূরের কথা, ২০ বছরের জাতীয়তাবাদী শাসনামলে তা শুধু ঘনীভূতই হয়েছিল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য আকাঙ্ক্ষা সারাদেশে দানা বেঁধে উঠেছিল।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলের সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে 'জাতীয়তাবাদী' দলই স্বাচ্ছন্দ্যে জয়ী হলে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর শক্ত হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব করার পর খালেদা জিয়া তখন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং আন্দোলনকেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখেছেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানরত খালেদা জিয়া তখন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে তার পরবর্তী মেয়াদের হিসাব-নিকাশ কষছেন। কিন্তু এরই মধ্যে যে বাস্তবতা অনেকটা বদলে গেছে_ একগুঁয়েমির কারণে ধস নেমেছে তার জনপ্রিয়তার, গভীর আত্মতৃপ্তির নির্জন বাস থেকে তিনি তা বুঝতে পারছিলেন না। তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিচ থেকে মাটি স্থানচ্যুত হয়েছে তা তিনি স্বীকার করতে রাজি নন। এক ধরনের ঔদ্ধত্য ও বেপরোয়া মনোভাব ক্রমেই তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, তিনি তা বুঝতে অক্ষম।
বস্তুত স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবসানে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার সরকার জনমনে হতাশা সৃষ্টি না করে পারেনি। কেননা তার সমগ্র শাসনশৈলীই ছিল স্বৈরতান্ত্রিক মেজাজের। প্রবল চাপের মুখে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে নিলেও তিনি সংসদকে কার্যত অকার্যকর রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নির্বাহী শাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তিনি নিজে কালেভদ্রে সংসদীয় বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। আন্দোলনকালে প্রদত্ত অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে তিনি প্রচারমাধ্যম, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনকে দলীয়করণের শিকারে পরিণত করেন। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীকেও তিনি দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের আওতায় নিয়ে আসেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোনো কালো আইনই তিনি বাতিল করেননি। মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনে তার ও তার দলের ভূমিকা নির্বাচনী-নিরপেক্ষতার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সংবেদনশীলতার অভাব ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে থাকে।
অগত্যা জনগণ একটি বিকল্পের কথা ভাবতে শুরু করে। সেই বিকল্পটাই ছিল এতদিনের উপেক্ষিত আওয়ামী লীগ। খুব একটা বিচার-বিবেচনা করে নয়, বরং বিএনপির একগুঁয়েমি ও স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদে এবং প্রশাসনের ব্যর্থতায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে ছেচলি্লশ সালেই বিশ বছরে 'সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা' প্রথমবারের মতো দৃষ্টি ফেরায় আওয়ামী লীগের প্রতি। এমনই এক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সবিনয় ভোট প্রার্থনা, অতীত বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা ভিক্ষা ও প্রচারণায় অতীতের উগ্রতা পরিহার ভোটদাতাদের অন্তর ছুঁয়েছিল বৈকি। পরিণামে ভোটারদের সহানুভূতি ও অনুকম্পাই ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগের একটি ধিভবৎ ঃযরহ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয়কে কোনোমতে সম্ভব করেছিল।
নির্বাচনী জোয়ার সৃষ্টি করে নয়, বরং কঠিন হিসাব-নিকাশের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি তৃতীয় দলের সমর্থন নিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তবু আওয়ামী লীগ 'জাতীয়তাবাদী' রাজনীতি থেকে একটি ভিন্নধারার রাজনৈতিক সরকার গঠন করতে যাচ্ছে_ এতেই খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। আর খুশি হয়েছিলাম এই জন্য যে, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার হাতবদল হতে যাচ্ছে যা গণতন্ত্রের একটি বড় শর্ত। দীর্ঘ একুশ বছর পর হলেও স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি আবার ক্ষমতায় আসছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ীদের হৃদয়ে দলটির যে ভাবমূর্তি বিমূর্ত ছিল তার সঙ্গে নতুন করে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের মিল খুঁজে পাওয়া ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠতে লাগল। তারা অবাক হয়ে দেখল, চাটুকার পরিবৃত এ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সেই পরিচিত মুখগুলোর ভিড় বিতর্কিত আওয়ামী লীগার, দলছুট রাজনীতিক, জিয়া ও এরশাদ আমলের সুবিধাভোগীরা, সুযোগ সন্ধানী নব্য ধনিক এবং হাজারো প্রকারের মতলববাজ, যারা ইতিপূর্বে জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় পার্টির ক্ষমতার করিডোরে ভিড় জমিয়েছে। শোনা যেত যে, আওয়ামী লীগ নিম্নবিত্তদের দল, সামাজিক ন্যায়নীতির দল বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী দল। কিন্তু দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এখন ক্ষুণ্নচিত্তে দেখল যে, আওয়ামী লীগের আর ভোটের সময় ছাড়া নিম্নবিত্তদের প্রয়োজন নেই এবং দলের অভ্যন্তরেই যারা নিম্নবিত্ত ছিল তারা এখন বিত্তবান। খদ্দরের মুজিব কোট ছেড়ে এখন দামি সুট-সাফারি পরে। দেশে সংক্রমণের মতো দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। এ সরকারের আমলেই দুর্নীতিতে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়।
অবিশ্বাস্য সম্পদের মালিক যেমন বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হতদরিদ্রের সংখ্যাও। আমরা ইতিপূর্বে উচ্চবিত্তদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী দলের শাসনাধীন ছিলাম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় তার মধ্যে আমরা যে আশার আলোকবর্তিকা দেখতাম সরকারি দলে পরিণত হওয়ার পর তাও নির্বাসিত।
পাঁচ বছরের আওয়ামী শাসনান্তে ২০০৭ সালে আমরা দলটির যে উদ্ধত চেহারা দেখেছি তা এর আগেকার বিএনপি সরকার থেকে ভিন্ন নয়। আওয়ামীদের সে সময়কার অহমিকা তারা নাকি স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম সরকার। অথচ সে সরকারের সময়ই বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। সে সময়ই এ দেশে সন্ত্রাসের উদ্ভব ঘটে। অবশ্য পরবর্তী নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার সেই দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় এবং তা ডালপালা ছড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করে ক্ষমতার দম্ভ, অপব্যবহার ও বিকারগ্রস্ততা এ দেশে সম্ভবত এভাবে চলতেই থাকবে। সব ঠিক আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। নতুন দেশ পারফেকশন হাসিলে কিছু সময় লেগেই থাকে_ এমন ভণ্ড আশাবাদে ক্ষমতার ধারকরা আশকারাই পেয়ে থাকে। ফলে আমরা একই ধারার সরকার ও শাসনের পুনরাবৃত্তি দেখতে থাকি।
ক্ষমতা তার ধারককে অনেক কিছুই দেয়। দেয় প্রভাব, প্রতিপত্তি, মর্যাদা এবং আধিপত্য। এর অনেকটাই অধিবাস্তব (ঝঁৎৎবধষ) মার্গের চলমান ক্ষমতার দুর্গে বসে তা বোঝার সুযোগ থাকে না। আজকের প্রসঙ্গমূলে ক'বছর আগে খালেদা জিয়ার সে সুযোগ ছিল না। ইতিহাসের অমোঘ পুনরাবৃত্তিতে সে সুযোগ আজ শেখ হাসিনারও নেই। তিনিও আজ এক ধরনের মেগালো ম্যানিয়ার অসহায় শিকার।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস এবং
কলাম লেখক
আওয়ামী লীগের তখন নিতান্তই দুর্দিন। দুই যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকার পর তার প্রাণশক্তি প্রায় নিঃশেষিত। হাজারও অপবাদের কলঙ্ক-কালিমা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে দলটি তখন প্রায় অপাঙ্ক্তেয়। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পর্যন্ত তখন রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সামাজিকভাবেও দূষণীয়। তদুপরি এককালের বিশাল আওয়ামী লীগ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মকলহে দলটি ক্ষতবিক্ষত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনোত্তর আওয়ামী লীগের জমজমাট অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে ১৯৯৬ সালে শুধু তার কঙ্কালই অবশিষ্ট ছিল।
এটি সত্ত্বেও এ দুর্দিনেও আওয়ামী লীগ ছিল আমার ফেভারিট। মনে করতাম স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দলটি যা নাকি অর্ধশতাব্দীর মতো প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এবং তারপরও নির্যাতিত হয়েছে_ সেই দলটির ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। দলটির দীর্ঘদিনের লব্ধ অভিজ্ঞতা জাতির স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ ছিল অসংখ্য স্খলন ও বিচ্যুতির দায়ে অভিযুক্ত এবং তার দুঃশাসনে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ। তবু তাদের সরকারের যখন '৭৫ সালে একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয়, মনে হয়েছিল অপরাধের গুরুভার সত্ত্বেও এ নির্মম পরিণতি তাদের প্রাপ্য ছিল না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মতো এক ঐতিহ্যমণ্ডিত দলের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনার স্ফুরণের জন্য তিন বা চার বছর কোনো সময়ই নয়, বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য। তাও আবার আন্তর্জাতিকভাবে বৈরী একটি সময়ে।
আওয়ামী লীগের জন্য এ দুর্বলতার পেছনে আরও ছিল ২০ বছরের 'জাতীয়তাবাদী' শাসনের রহপঁসনবহপু ঋধপঃড়ৎ. 'জাতীয়তাবাদে'র মন্ত্রে দীক্ষিত সরকার বিভিন্ন হলেও এবং শাসনশৈলী ও পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটি অরাজনৈতিক সরকারের সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। স্বভাবতই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনিবার্যভাবে একটি অচলাবস্থা শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
পাকিস্তান আমলের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল। তার পুনরাবৃত্তি ও প্রলম্বন জনগণের কাছে আবারও শাসরুদ্ধকর মনে হতে লাগল। তারা আবার গণতন্ত্রের ্তুহড়রংব ধহফ পযধড়ং্থ-এ ফিরে যেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক উত্তরণে গণতন্ত্রের স্থান কিছুটা থাকলেও 'জাতীয়তাবাদী' রাজনীতির তিক্ততা রয়েই গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করা এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে মাখামাখির প্রবণতা অপরিবর্তিতই রয়ে গিয়েছিল। একইভাবে অব্যাহত ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের মনগড়া ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা। এ ছাড়াও যে অরাজকতা, অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা নিয়ে বাংলাদেশের শুরু হয়েছিল, তা থেকে রেহাই পাওয়া তো দূরের কথা, ২০ বছরের জাতীয়তাবাদী শাসনামলে তা শুধু ঘনীভূতই হয়েছিল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য আকাঙ্ক্ষা সারাদেশে দানা বেঁধে উঠেছিল।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলের সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে 'জাতীয়তাবাদী' দলই স্বাচ্ছন্দ্যে জয়ী হলে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর শক্ত হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব করার পর খালেদা জিয়া তখন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং আন্দোলনকেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখেছেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানরত খালেদা জিয়া তখন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে তার পরবর্তী মেয়াদের হিসাব-নিকাশ কষছেন। কিন্তু এরই মধ্যে যে বাস্তবতা অনেকটা বদলে গেছে_ একগুঁয়েমির কারণে ধস নেমেছে তার জনপ্রিয়তার, গভীর আত্মতৃপ্তির নির্জন বাস থেকে তিনি তা বুঝতে পারছিলেন না। তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিচ থেকে মাটি স্থানচ্যুত হয়েছে তা তিনি স্বীকার করতে রাজি নন। এক ধরনের ঔদ্ধত্য ও বেপরোয়া মনোভাব ক্রমেই তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, তিনি তা বুঝতে অক্ষম।
বস্তুত স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবসানে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার সরকার জনমনে হতাশা সৃষ্টি না করে পারেনি। কেননা তার সমগ্র শাসনশৈলীই ছিল স্বৈরতান্ত্রিক মেজাজের। প্রবল চাপের মুখে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে নিলেও তিনি সংসদকে কার্যত অকার্যকর রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নির্বাহী শাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তিনি নিজে কালেভদ্রে সংসদীয় বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। আন্দোলনকালে প্রদত্ত অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে তিনি প্রচারমাধ্যম, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনকে দলীয়করণের শিকারে পরিণত করেন। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীকেও তিনি দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের আওতায় নিয়ে আসেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোনো কালো আইনই তিনি বাতিল করেননি। মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনে তার ও তার দলের ভূমিকা নির্বাচনী-নিরপেক্ষতার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সংবেদনশীলতার অভাব ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে থাকে।
অগত্যা জনগণ একটি বিকল্পের কথা ভাবতে শুরু করে। সেই বিকল্পটাই ছিল এতদিনের উপেক্ষিত আওয়ামী লীগ। খুব একটা বিচার-বিবেচনা করে নয়, বরং বিএনপির একগুঁয়েমি ও স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদে এবং প্রশাসনের ব্যর্থতায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে ছেচলি্লশ সালেই বিশ বছরে 'সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা' প্রথমবারের মতো দৃষ্টি ফেরায় আওয়ামী লীগের প্রতি। এমনই এক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সবিনয় ভোট প্রার্থনা, অতীত বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা ভিক্ষা ও প্রচারণায় অতীতের উগ্রতা পরিহার ভোটদাতাদের অন্তর ছুঁয়েছিল বৈকি। পরিণামে ভোটারদের সহানুভূতি ও অনুকম্পাই ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগের একটি ধিভবৎ ঃযরহ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয়কে কোনোমতে সম্ভব করেছিল।
নির্বাচনী জোয়ার সৃষ্টি করে নয়, বরং কঠিন হিসাব-নিকাশের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি তৃতীয় দলের সমর্থন নিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তবু আওয়ামী লীগ 'জাতীয়তাবাদী' রাজনীতি থেকে একটি ভিন্নধারার রাজনৈতিক সরকার গঠন করতে যাচ্ছে_ এতেই খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। আর খুশি হয়েছিলাম এই জন্য যে, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার হাতবদল হতে যাচ্ছে যা গণতন্ত্রের একটি বড় শর্ত। দীর্ঘ একুশ বছর পর হলেও স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি আবার ক্ষমতায় আসছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ীদের হৃদয়ে দলটির যে ভাবমূর্তি বিমূর্ত ছিল তার সঙ্গে নতুন করে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের মিল খুঁজে পাওয়া ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠতে লাগল। তারা অবাক হয়ে দেখল, চাটুকার পরিবৃত এ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সেই পরিচিত মুখগুলোর ভিড় বিতর্কিত আওয়ামী লীগার, দলছুট রাজনীতিক, জিয়া ও এরশাদ আমলের সুবিধাভোগীরা, সুযোগ সন্ধানী নব্য ধনিক এবং হাজারো প্রকারের মতলববাজ, যারা ইতিপূর্বে জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় পার্টির ক্ষমতার করিডোরে ভিড় জমিয়েছে। শোনা যেত যে, আওয়ামী লীগ নিম্নবিত্তদের দল, সামাজিক ন্যায়নীতির দল বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী দল। কিন্তু দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এখন ক্ষুণ্নচিত্তে দেখল যে, আওয়ামী লীগের আর ভোটের সময় ছাড়া নিম্নবিত্তদের প্রয়োজন নেই এবং দলের অভ্যন্তরেই যারা নিম্নবিত্ত ছিল তারা এখন বিত্তবান। খদ্দরের মুজিব কোট ছেড়ে এখন দামি সুট-সাফারি পরে। দেশে সংক্রমণের মতো দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। এ সরকারের আমলেই দুর্নীতিতে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়।
অবিশ্বাস্য সম্পদের মালিক যেমন বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হতদরিদ্রের সংখ্যাও। আমরা ইতিপূর্বে উচ্চবিত্তদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী দলের শাসনাধীন ছিলাম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় তার মধ্যে আমরা যে আশার আলোকবর্তিকা দেখতাম সরকারি দলে পরিণত হওয়ার পর তাও নির্বাসিত।
পাঁচ বছরের আওয়ামী শাসনান্তে ২০০৭ সালে আমরা দলটির যে উদ্ধত চেহারা দেখেছি তা এর আগেকার বিএনপি সরকার থেকে ভিন্ন নয়। আওয়ামীদের সে সময়কার অহমিকা তারা নাকি স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম সরকার। অথচ সে সরকারের সময়ই বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। সে সময়ই এ দেশে সন্ত্রাসের উদ্ভব ঘটে। অবশ্য পরবর্তী নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার সেই দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় এবং তা ডালপালা ছড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করে ক্ষমতার দম্ভ, অপব্যবহার ও বিকারগ্রস্ততা এ দেশে সম্ভবত এভাবে চলতেই থাকবে। সব ঠিক আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। নতুন দেশ পারফেকশন হাসিলে কিছু সময় লেগেই থাকে_ এমন ভণ্ড আশাবাদে ক্ষমতার ধারকরা আশকারাই পেয়ে থাকে। ফলে আমরা একই ধারার সরকার ও শাসনের পুনরাবৃত্তি দেখতে থাকি।
ক্ষমতা তার ধারককে অনেক কিছুই দেয়। দেয় প্রভাব, প্রতিপত্তি, মর্যাদা এবং আধিপত্য। এর অনেকটাই অধিবাস্তব (ঝঁৎৎবধষ) মার্গের চলমান ক্ষমতার দুর্গে বসে তা বোঝার সুযোগ থাকে না। আজকের প্রসঙ্গমূলে ক'বছর আগে খালেদা জিয়ার সে সুযোগ ছিল না। ইতিহাসের অমোঘ পুনরাবৃত্তিতে সে সুযোগ আজ শেখ হাসিনারও নেই। তিনিও আজ এক ধরনের মেগালো ম্যানিয়ার অসহায় শিকার।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস এবং
কলাম লেখক
No comments