ভিন্নমত-বেশি কষ্টে আছেন অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা by আবু আহমেদ

জিজ সাহেব অবসরে গেছেন তিন বছর আগে। অবসরে যাওয়া পেনশনের টাকাগুলো একত্রে তুলে কিনেছিলেন অবসরভোগীদের জন্য সরকারি সঞ্চয়পত্র্র। সাত লাখ টাকা দিয়ে একটা পুরনো গাড়িও কিনেছিলেন। সরকারি চাকরিতে থাকাকালে গাড়ি চড়েছেন, অবসরে অন্য যানবাহন ব্যবহার করতে মন সায় দিত না। সারা জীবন যে সঞ্চয় করেছেন তা তাঁর দুই মেয়ের লেখাপড়া করাতে শেষ হয়েছে। ওরা থাকে এখন যুক্তরাষ্ট্রে। আজিজ সাহেব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায়ই


পড়ে আছেন এবং থাকবেন। ঘরে একজন কাজের বুয়া এবং গাড়ির জন্য একজন পার্টটাইম ড্রাইভার আছে। প্রথম প্রথম তিনি হিসাব করে দেখতেন, অবসর থেকে যে ভাতা পাবেন, তা যদি সরকারি সঞ্চয়পত্রে খাটান, তাহলে মাসের খরচটা চলে যাবে। আর মেয়েরা সাহায্য করলে তো সেটা হবে বাড়তি সুবিধা। কিন্তু আজকাল আজিজ সাহেবের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তিন বছরের মাথায় যেন সব হিসাব উল্টে গেছে। এখন সংসার তাঁর আর চলে না। মূল কারণ হলো, আজিজ সাহেবের পরিবার যে পণ্যসেবা ভোগ করে সেসবের দামের ঊর্ধ্বগতি। এখন আজিজ সাহেবকে চাল কিনতে হয় ৫০ শতাংশ বেশি মূল্যে। বিদ্যুতের বিলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গ্যাস দিয়ে গাড়ি চালানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে অসুখ-বিসুখ ভর করেছে। আগে ডাক্তার-ওষুধে মাসে গড়ে খরচ হতো ৫০০ টাকা। এখন খরচ হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। আয় নেই, ব্যয় বেড়েছে। তিনি এখন ভাবছেন, গাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। সমাজে এদিক-সেদিক যাওয়ার পরিমাণটাও কমিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের দাওয়াত পান অনেক। কিন্তু মন ভালো নেই বলে এবং বিয়েতে কিছু উপহার দিতে হবে বলে পারতপক্ষে বিয়ের দাওয়াতেও যান না। যাওয়ার মধ্যে ঘর আর মসজিদ এবং মাঝেমধ্যে বাজার ও ওষুধের দোকান পর্যন্ত।
আজিজ সাহেব এই আর্থিক কষ্টে পড়লেন কেন? কারণ একটাই, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। গত তিন বছরে তাঁর আয়ের এক-তৃতীয়াংশই মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলেছে। এখন বাড়তি কাজ করে অতিরিক্ত আয় করারও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে ব্যয়ের বাজেট কমাতে হচ্ছে। তিনি তাঁর গাড়ি বেচা এবং ড্রাইভারকে বিদায় দেওয়ার কথা ভাবছেন। আজিজ সাহেব ভাবতেও পারেননি, তাঁর আয় মূল্যবৃদ্ধি এত তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলবে। আজিজ সাহেব নিজের সোনালি অতীতের জন্য চিন্তা করে আফসোস করেন। ছিলেন অনেক কিছু। কিন্তু অবসরে যাওয়ার তিন বছরের মাথায় তিনি এখন বুড়ো মানুষ, যার খবর নেওয়ার বেশি কেউ নেই, তিনি বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটাবেন, তা নিয়ে শঙ্কিত। আজিজ সাহেবের মতো অনেক লোক আছেন, যাঁদের আয়-রোজগার অতিসীমিত। মূল্যস্ফীতি তাঁদেরই বেশি আঘাত করছে। একদিকে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে আয় কমেছে। তাই অতীতের ভালো জীবনযাত্রার কথা চিন্তা করে তাঁরা দুঃখ পান। ভুলতে চেষ্টা করেন সেই সোনালি অতীতকে। বর্তমানে অল্পেই তুষ্ট থাকতে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই নাম করা ব্যক্তিরা অতি তাড়াতাড়ি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রভাব নেই বলে খবরও কেউ রাখে না। পোস্ট অফিসগুলোতে সঞ্চয়পত্রের কাউন্টারে বুড়ো লোকগুলোর ভিড়। কেউ এসেছেন একা, কেউ ছেলে-নাতিকে নিয়ে, আবার কেউ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে পোস্ট অফিস কর্তৃক দেয় একটি কথিত সঞ্চয় বই। সরকার বলে আসছিল, এসব সঞ্চয়পত্র অধিক লাভজনক, নিরাপদ ইত্যাদি। লাভ হলো সুদ ১০ থেকে ১২ শতাংশ আর নিরাপদ মানে সরকারের গ্যারান্টি, মার যাবে না। মেয়াদ শেষে সুদ-আসলে বিনিয়োগকৃত অর্থ পাওয়া যাবে। কিন্তু আসল নিরাপত্তার কথা সরকার তাঁদের বলেনি। সেটা হলো, আপনাদের অর্থ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষয়ও হয়ে যেতে পারে। আজকে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কত? সরকার নিজেই তো বলছে, এই বৃদ্ধি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। তার মানে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বা এমন একটা হবে। তা হলে এই সঞ্চয়কারীরা তো অনবরত আয় হারাচ্ছেন। তাঁদের দেওয়া হচ্ছে ১১ শতাংশ; আর মূল্যস্ফীতি তাঁদের বিনিয়োগকে ক্ষয় করে ফেলছে ১৪ শতাংশ হারে। তাহলে ১০ বছর পর তাঁদের সঞ্চয়ের প্রকৃত অর্থে আজকের মূল্য কত দাঁড়াবে? এই হিসাবও অতি সহজ। ১০ লাখ টাকা বেড়ে যে টাকা হবে, সে টাকা দিয়ে ভবিষ্যতে আজকের ১০ লাখ টাকার পণ্য কেনা যাবে না। মূল্যস্ফীতি হলো এমন একটা বিপদ, যা শুধু সমাজের গরিবদের ও আজিজ সাহেবদের মতো অবসরপ্রাপ্তদের আরো জোরে আঘাত হানতে থাকে।
অন্য দেশে বয়স্ক লোকদের রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক দায়িত্ব নেওয়া সোশ্যাল সিকিউরিটি স্কিম বা সরকারি নিরাপত্তা স্কিম আছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এটা কল্পনা মাত্র। এখানে যে নিরাপত্তার কথা ভাবা যেতে পারত, সেটা হলো মূল্যবৃদ্ধিকে সহনীয় স্তরে রাখা। কিন্তু গত তিন বছরে সরকার ভর্তুকি কমানোর নামে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেসব পদক্ষেপ মূল্যবৃদ্ধিকেই শুধু উস্কে দিচ্ছে। তিন বছরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পেট্রলের মূল্য শতকরা কত বেড়েছে? সেই হিসাবে আজিজ সাহেবদের অবসরভাতা বেড়েছে কি? তাহলে এই লোকগুলো কিভাবে চলবেন? আজিজ সাহেব তো অবসরে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা টের পেয়েছেন। কিন্তু যেসব সৎ কর্মকর্তা এখনো সরকারি চাকরি করছেন তাঁরা-ই বা তাদের পরিবারের বাজেট কিভাবে মেলাচ্ছেন? অনেকে বলছেন, তাঁদের তো অনেক মিটিং, অনেক ভাতা। এবং তাঁরা তো সরকারি অর্থে পাজেরো-প্রাডোতে চড়েন। তবে সেসবের সংখ্যা কত? আর সবাই কি সৎভাবে ওসব সুবিধা নিচ্ছেন?
অসৎ লোকের জন্য তো অনেক দরজা খোলা। কিন্তু যাঁরা অসততাকে পাপ মনে করেন, তাঁদের অবস্থা কী?
তাহলে এই সমাজ কি সৎ লোকদের শাস্তি দিচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রের তো সৎ লোকদের পক্ষে থাকার কথা ছিল। আজ সৎ লোকদের প্রমোশন হয় না। তাঁরা ভালো পোস্টিং পান না, তাঁদের অযোগ্য বলে ব্রাকেটেডে করা হয়। এভাবেই বুঝি আমরা ভবিষ্যতের সমাজ গঠন করছি!
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.