সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র-প্রকল্প সাংসদের লোকের হাতে by উজ্জ্বল মেহেদী ও সালেহ আহমদ
১০ ফুট প্রস্থের পুরোনো সড়ক ১২ ফুট হবে। হাতেগোনা কয়েকজন শ্রমিক সড়কের নিচ থেকে মাটি কেটে এনে ফেলছিলেন বর্ধিতকরণ অংশে। মাটির ওপর বালু ফেলে চলছে ইটের সোলিং। এভাবে সদ্য সংস্কার করা সড়কের এক কিলোমিটার যেতেই দেখা গেল রাস্তার একাংশের মাটি দেবে গেছে। নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জ জেলার উপকণ্ঠে নতুন আবিষ্কৃত সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্পের সংযোগ সড়ক সংস্কার চলছে এভাবেই। অথচ ওই রাস্তা দিয়ে
গ্যাসক্ষেত্রে নিতে হবে কয়েক শ টন ওজনের রিগ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সুনামগঞ্জের ধরমপাশার সেলবরষ ইউনিয়নের গাবী গ্রামের পাঁচ একর জায়গাজুড়ে সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান কূপ খননের মূল প্রকল্প। পাশে আরও পাঁচ একর জায়গা প্রকল্পের আবাসনের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গ্যাসকূপ খনন, আবাসন এলাকায় মাটি ভরাট ও যোগযোগব্যবস্থার জন্য সেলবরষ ও নেত্রকোনার বারহাট্টা সড়কের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশ সংযোগ সড়ক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
গত মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া ওই দুটি প্রকল্পের কাজ ছয় মাসের মধ্যে, অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ২৯ ডিসেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচ কিলোমিটার সড়কের মাত্র দুই কিলোমিটারের কাজ শেষ রয়েছে। ওই দুই কিলোমিটারের অনেক অংশ এমনিই দেবে গেছে।
বাপেক্সের অর্থায়নে প্রায় দেড় কোটি টাকার সড়ক সংস্কার ও মাটি ভরাটকাজের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘পায়েল ট্রেডিং করপোরেশন’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই কাজের গতি ও মান নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
যোগাযোগ করলে সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পকাজ উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমেই হচ্ছে। আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কেউ সংশ্লিষ্ট আছেন, এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ কাজ শেষ হবে।’
তবে পায়েল ট্রেডিং করপোরেশনের নিয়োজিত তদারককারী কামরুল মিয়া নিজেকে ‘সাব-ঠিকাদার’ পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘যা হচ্ছে এমপি সাহেবের নির্দেশমতো হচ্ছে। তিনি (সাংসদ) বলেছেন সড়কটা আপাতত ১৮ চাকার গাড়ি চলাচল উপযোগী করতে। পরে আবার পুনর্নির্মাণ করা হবে।’
সুনেত্র প্রকল্পের পরিচালক, বাপেক্সের মো. নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ যেহেতু শেষ হয়নি, তাই এ ব্যাপারে আমাদের মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে সংস্কার করা সড়ক ভারী যান চলাচলের উপযোগী এখনো হয়নি। বিষয়টি জানালে ইউএনও আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে যথাযথভাবে কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন।’
সড়কের কাজ বিলম্বিত হওয়ায় কূপ খনন এলাকার সীমানাপ্রাচীর, রিগ স্থাপন ও আবাসন গড়ার কাজও এগোচ্ছে না। মালামাল পরিবহনে অসুবিধার কারণে তাদের কাজও বিলম্বিত হচ্ছে। সময় গড়িয়ে যাওয়ায় প্রতিটি কাজের ব্যয়সীমা বেড়ে যাচ্ছে।
ধরমপাশা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপসহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম মুন্সী সড়ক সংস্কার প্রকল্পের সভাপতি। তিনি বলেন, বাপেক্সের অর্থায়নে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজন কাজ করছেন। এই স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সাংসদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কেউ আছেন কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’
তবে একাধিক সূত্র জানায়, দুটি প্রকল্পের কমিটিতে স্থানীয় সাংসদ মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে পায়েল ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপক বাবুল মিয়া রয়েছেন। তিনি উপ-ঠিকাদার হিসেবে সড়ক সংস্কারকাজ সরাসরি তদারক করছেন। বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অন্য সাধারণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করছে।’
প্রশাসন জানে না, সাংসদ জানেন: কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে ধরমপাশার ইউএনও মোহাম্মদ কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দুটি প্রকল্পকাজ শুরুর পর এখানে এসেছি। বিস্তারিত কিছু জানি না। বাপেক্সের অর্থায়নে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দুটি প্রকল্প কমিটি গঠন করে কাজ চলছে বলে জানি।’
মাঠের কাজ সাংসদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তদারক করছে এবং কাজ যথাযথ হচ্ছে না বলে তাঁকে জানালে ইউএনও বলেন, ‘আমি জানি না।’
তবে সাংসদ বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। ইউএনওর না জানার তো কথা নয়। তবে বিষয়টি আমার জানার মধ্যেই আছে। বাপেক্সের টাকায় উপজেলা প্রশাসন প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে কাজ করাচ্ছে। ’
কাজ যথাযথ হচ্ছে না বলে সাংসদকে জানালে তিনি বলেন, ‘এখন তো মান দেখার সুযোগ নেই। রিগ পরিবহনের জন্য সড়ক সংস্কার করা হচ্ছে। রিগ পরিবহনের পরই এ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। তখন পুনর্নির্মাণ করা হবে। তখন কাজের গুণগত মান দেখা হবে।’
উপজেলা প্রশাসনের কাজ বাস্তবে তাঁরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন করছে বলে জানালে সাংসদ বলেন, ‘এ কথা সত্য নয়। কেউ কোনো প্রমাণও দিতে পারবে না। কাজ উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে।’
এদিকে, ঢাকায় বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, ওই প্রকল্পের কাজের জন্য সাংসদ নিজে বিভিন্ন সময় তাঁদের কার্যালয়েও গেছেন। প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর জন্যও তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
No comments