বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
২৭৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ রমিজ উদ্দীন, বীর বিক্রম যুদ্ধক্ষেত্রে অবিচল এক মুক্তিসংগ্রামী মুক্ত এলাকার সীমান্তে টহল দিচ্ছেন রমিজ উদ্দীনসহ তিন মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ তাঁদের আক্রমণ করল একদল পাকিস্তানি সেনা। মুক্তিযোদ্ধারা দেখলেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের চারদিক থেকে ঘেরাও করছে। রমিজ উদ্দীন বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করতে থাকলেন।
তাঁর মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা, সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে হবে। কিন্তু বেশিক্ষণ লড়াই করতে পারলেন না। শত শত গুলি ছুটে আসছে তাঁর দিকে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তাঁর শরীর। রক্তে ভেজা মাটিতে পড়ে থাকল তাঁর নিথর দেহ। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৬ মে। বালুমারা ফরেস্ট এলাকায়।
বালুমারা ফরেস্ট অফিস হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হবিগঞ্জ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ১ বা ২ মে শায়েস্তাগঞ্জের খোয়াই নদীর তীরে রেললাইনের পাশে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করলেও বালুমারা ফরেস্ট অফিসসহ আশপাশের কিছু এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। ফরেস্ট অফিসে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির। মুক্ত এলাকায় ছিলেন রমিজ উদ্দীনসহ ২২ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে মুক্ত এলাকার সীমান্তে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে থাকতেন।
এদিকে পাকিস্তানি সেনারা বালুমারা এলাকায় তখনো আক্রমণ না চালালেও মুক্ত এলাকার তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। মুক্ত এলাকায় নিয়মিত চর পাঠাতে থাকে। পাকিস্তানিদের এক সহযোগীর নাম ছিল তমাই মহালদার। সে মুক্ত এলাকায় গোপনে এসে তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে দিত। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে একদিন আটক করে এবং প্রাণদণ্ড দেয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা ১৬ মে আকস্মিকভাবে মুক্ত এলাকায় আক্রমণ করে।
সেদিন রমিজ উদ্দীন দুজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে মুক্ত এলাকার যে স্থানে টহলে ছিলেন, সেই স্থান দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে তাঁদের ঘেরাও করে। আকস্মিক অ্যামবুশে পড়ে রমিজ উদ্দীনের দুই সহযোদ্ধা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাঁরা পশ্চাদপসরণের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু রমিজ উদ্দীন বিচলিত না হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। তিনি একাই লড়াই করে দুই সহযোদ্ধা ও পেছনে মূল শিবিরে থাকা সহযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করার সুযোগ করে দেন। তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বে রক্ষা পায় ২১ জন সহযোদ্ধার প্রাণ। কিন্তু তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন।
রমিজ উদ্দীন ১৯৭১ সালে কৃষিকাজ করতেন। তবে তাঁর মুজাহিদ ট্রেনিং নেওয়া ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তখন তাঁর স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর খানেক আগে তিনি বিয়ে করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ রমিজ উদ্দীনকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৮৮।
শহীদ রমিজ উদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম পানাউল্যাহ, মা হাজেরা খাতুন। স্ত্রী জোবেদা খাতুন। তাঁর এক ছেলে। রমিজ উদ্দীনের স্ত্রী ১৯৭২ সালে মারা যান। তাঁর ছেলে বজলু মিয়াকে লালন-পালন করেন দাদি। তাঁর মৃত্যুর পর বজলু মিয়া পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে সেদ্ধ ডিম ফেরি করে বিক্রি করেন। বজলু মিয়া লেখাপড়া করতে পারেননি। তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে রাজু মিয়া পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে লেখাপড়ার ইতি টানে। এখন রাস্তায় চানাচুর বিক্রি করে। মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়শোনা করছে। ছোট ছেলে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছে।
রমিজ উদ্দীনের একমাত্র সন্তান বজলু মিয়াকে তাঁর বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘আপনারা যে কী কন! আমি তো কিছুই বুঝি না।’ শহীদ রমিজ উদ্দীনের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: কেয়া চৌধুরী, সদস্যসচিব, চেতনায় ’৭১ হবিগঞ্জ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
বালুমারা ফরেস্ট অফিস হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হবিগঞ্জ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ১ বা ২ মে শায়েস্তাগঞ্জের খোয়াই নদীর তীরে রেললাইনের পাশে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করলেও বালুমারা ফরেস্ট অফিসসহ আশপাশের কিছু এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। ফরেস্ট অফিসে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির। মুক্ত এলাকায় ছিলেন রমিজ উদ্দীনসহ ২২ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে মুক্ত এলাকার সীমান্তে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে থাকতেন।
এদিকে পাকিস্তানি সেনারা বালুমারা এলাকায় তখনো আক্রমণ না চালালেও মুক্ত এলাকার তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। মুক্ত এলাকায় নিয়মিত চর পাঠাতে থাকে। পাকিস্তানিদের এক সহযোগীর নাম ছিল তমাই মহালদার। সে মুক্ত এলাকায় গোপনে এসে তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে দিত। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে একদিন আটক করে এবং প্রাণদণ্ড দেয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা ১৬ মে আকস্মিকভাবে মুক্ত এলাকায় আক্রমণ করে।
সেদিন রমিজ উদ্দীন দুজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে মুক্ত এলাকার যে স্থানে টহলে ছিলেন, সেই স্থান দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে তাঁদের ঘেরাও করে। আকস্মিক অ্যামবুশে পড়ে রমিজ উদ্দীনের দুই সহযোদ্ধা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাঁরা পশ্চাদপসরণের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু রমিজ উদ্দীন বিচলিত না হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। তিনি একাই লড়াই করে দুই সহযোদ্ধা ও পেছনে মূল শিবিরে থাকা সহযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করার সুযোগ করে দেন। তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বে রক্ষা পায় ২১ জন সহযোদ্ধার প্রাণ। কিন্তু তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন।
রমিজ উদ্দীন ১৯৭১ সালে কৃষিকাজ করতেন। তবে তাঁর মুজাহিদ ট্রেনিং নেওয়া ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তখন তাঁর স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর খানেক আগে তিনি বিয়ে করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ রমিজ উদ্দীনকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৮৮।
শহীদ রমিজ উদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম পানাউল্যাহ, মা হাজেরা খাতুন। স্ত্রী জোবেদা খাতুন। তাঁর এক ছেলে। রমিজ উদ্দীনের স্ত্রী ১৯৭২ সালে মারা যান। তাঁর ছেলে বজলু মিয়াকে লালন-পালন করেন দাদি। তাঁর মৃত্যুর পর বজলু মিয়া পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে সেদ্ধ ডিম ফেরি করে বিক্রি করেন। বজলু মিয়া লেখাপড়া করতে পারেননি। তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে রাজু মিয়া পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে লেখাপড়ার ইতি টানে। এখন রাস্তায় চানাচুর বিক্রি করে। মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়শোনা করছে। ছোট ছেলে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছে।
রমিজ উদ্দীনের একমাত্র সন্তান বজলু মিয়াকে তাঁর বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘আপনারা যে কী কন! আমি তো কিছুই বুঝি না।’ শহীদ রমিজ উদ্দীনের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: কেয়া চৌধুরী, সদস্যসচিব, চেতনায় ’৭১ হবিগঞ্জ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
No comments