সম্মান বাঁচাতে চলে যাওয়া? by নাজনীন আখতার
'তোমাদের সম্মান বাঁচাতে চলে যাচ্ছি'-
আত্মহত্যার আগে অভিমানী পিংকি এভাবেই বিদায় জানিয়েছিল প্রিয় পরিবারকে।
রাষ্ট্র নিরাপত্তা না দিতে পারলে কিশোরী, তরম্নণীরা পাড়ায় রাসত্মায়
বখাটেদের উত্ত্যক্ততার শিকার হতেই থাকবে।
বাড়বে অপমানের
গস্নানিতে আত্মহননকারী মেয়ের সংখ্যা। সংশিস্নষ্টরা ইভটিজিংকে এখন আর
সামাজিক ব্যাধি বা মূল্যবোধের অবৰয় হিসাবে নয় চিহ্নিত করছেন সামাজিক
বিপর্যয় রূপে।
শুধু গত এক বছরের এক হিসাবে দেখা যায়, ইভটিজিংয়ের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এক বছরেই ইভটিজিংয়ের ঘটনা বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ১১টি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডবিস্নউএলএ) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালে দেশে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ১২টি। আর ইভটিজিংয়ের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৯টি। মোট ২১টি ঘটনার মধ্যে মাত্র ২টির ৰেত্রে আত্মহত্যার মামলা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালে ইভটিজিং আড়াই গুণ বেড়েছে। মোট ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছে ৭ জন। আত্মহত্যার ৩টিসহ মোট মামলা হয়েছে ১০টি। ঘটনার শিকার এবং আত্মহত্যাকারী মেয়েদের ৯০ শতাংশই স্কুলপড়ুয়া।
মামলায় আশানুরূপ বিচার না হওয়ায় ইভটিজিংয়ের শিকার পরিবারগুলোর মধ্যে স্বজন হারানোর স্থায়ী শূন্যতার পাশাপাশি বিরাজ করে আতঙ্ক, ৰোভ।
হুমকির মুখে পিংকির পরিবার
পাড়ার বখাটে ছেলেদের সামনে গত ১৯ জানুয়ারি পাশের বাড়ির ড্রাইভার বখাটে মুরাদের হাতে চড় খেয়ে গস্নানিতে আত্মহননকারী স্কুলছাত্রী পিংকির পরিবার এখন অনবরত হুমকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ঘটনাটিকে লোকজনের সহানুভূতি কেড়ে হাল্কা করার জন্য পুলিশের সহায়তায় পিংকির সঙ্গে মুরাদ প্রেমের গল্প সাজিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পিংকির চাচা আলী আশরাফ। এমন মর্মস্পশর্ী ঘটনা ঘটলেও পুলিশের কোন সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। শ্যামলী ২ নং রোডের ১৫২/ক-সি, চাকলাদার বাড়ির দোতলায় পিংকিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে মুহ্যমান পুরো পরিবার। সঙ্গে আতঙ্কও রয়েছে। প্রথমে এ প্রতিবেদককে বাড়িতে ঢুকতে দিতে দ্বিধা করছিলেন তাঁরা। কথা বলতেও সতর্ক ছিলেন তাঁরা। পরে সংশয় কাটতেই ৬৫ বছর বয়সী পিংকির দাদি এ প্রতিবেদকে বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখান পিংকির শোবার রম্নম, পিংকির ছবি, আত্মহত্যার স্থান, গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেয়া পিংকির বোর্ডের বই। পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতা কেটে বইগুলোতে নিজেই মলাট দিয়েছিল শ্যামলী আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী পিংকি। ঝকঝকে মলাটের বইগুলো তেমনি পড়ে রয়েছে। বইগুলো জড়িয়ে ধরে আহাজারি করে উঠলেন দাদি, 'চোৰের সামনে শুধু পিংকি ভাসে। রাইতে ঘুমাইতে পারি না।' তার আফসোস, সেদিন পেনশনের টাকা তুলতে না গেলে বাসাও খালি থাকত না মা মরা মেয়েটাও মরত না। তিনি বাড়িতে থাকলে মুরাদের চড় মারা আর অন্য বখাটেদের হাসাহাসির কথা নিশ্চয় তাকে বলত। বললেন, পিংকির দাদার পেনশনের টাকা তুলি মাসে মাসে। এবার দর্জি দোকানে জামা বানাবার জন্য কাপড় দিয়ে আসার পর থেকেই সারাৰণ আবদার জানাতে থাকে। 'দাদি তাড়াতাড়ি টাকা তোল, জামা কিনব'। সে টাকা তুলতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন তিনি। এসে পিংকির লাশ পান। বললেন, বাড়ির নিচে ওর ছোট দুই কাজিনের সঙ্গে খেলতে খেলতে দুষ্টমি করে হাত কাটে। পরে দোকানে যায় ব্যান্ডএইড কিনতে। দুষ্টমি করে হাত কাটার কারণ কি জানতে চায় বখা মুরাদ। পিংকি জবাব না দেয়ায় মুরাদ তাকে চড় মারে। পিংকির কাজিনসহ আশপাশের সবাই সে ঘটনা দেখে হাততালি দিয়ে হেসে ওঠায় অপমানে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে সে। শূন্য বাড়িতে ফ্যানে দাদির শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। দাদি জানান, দরজা ধাক্কা দেয়ার পরও পিংকি দরজা না খোলায় দোতলার বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পিংকির কাজিনদের ঘরে ঢোকানো হয়। তারা ঘরে ঢুকে মূল দরজা খোলে। এর পরের ঘটনা বলতে গিয়ে আবেগে আপস্নত হয়ে পড়েন দাদি। আহাজারি করে বলেন 'এইডা আমি কী দেখলাম, ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতাছে আমার কলিজার টুকরা।' পিংকির আবদার মতো পেনশনের টাকা দিয়ে দর্জির দোকানে থাকা জামা তিনি নিয়ে এলেও তা পরে আনন্দ করার মানুষটি নেই। পিংকির চাচা জানালেন মামলা তুলে নেয়ার জন্য নানান ফোন থেকে তাদের হুমকি দেয়া হয়।
সিমির শূন্যতা বাড়িজুড়ে
গাছে ঢাকা বাড়িটিকে দেখলেই বোঝা যায় বাড়ির বাসিন্দারা সংস্কৃতিমনা। দোতলায় উঠতে প্রতিটি সিঁড়িতেই শিকায় ঝুলানো লতানো গাছ, দেয়ালে পেইন্টিংস। ড্রইংরম্নমজুড়ে শুধুই শিল্পকর্ম, মাটির মটকিতে আঁকা ছবি, টেরাকোটা। দেয়ালে সাঁটানো পেইন্টিংস ছাড়াও মেঝেতে ঠেস দিয়ে রাখা বড় পেইন্টিংস। একটি পরিবার চিরদিনের জন্য অনুপস্থিত একজন মানুষকে কিভাবে নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে তা দেখে থমকে যেতে হয়। বাড়িজুড়ে একজন মানুষের ছোঁয়া। সবই তার করা। শুধু সে নেই। গত ৯ বছর ধরে তার চপলতা, চঞ্চলতা শুধু মা-বাবা, বড় বোন আর দুই ভাইয়ের অনুভবের মধ্যে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে মাকে দেখা দেয়, আকুতি নিয়ে বলে, 'মা, ওদের জন্য বাঁচতে পারলাম না। আর তোমরা ওদের কিছুই করলে না?' ৯ বছর আগে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননকারী চারম্নকলার ছাত্রী সিমি বানুর পরিবারজুড়ে এখনও হাহাকার। সিমির বয়সী মেয়ে দেখলে মা জরিনা বেগমের আবেগ আপস্নুত আচরণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তোলে উপস্থিতদের। এ প্রতিবেদন তৈরির জন্য সিমিদের খিলগাঁওয়ের নবীনবাগের ২৪৮/৬ নং বাড়িতে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকের হাহাকার আর ৯ বছরেও বিচার না পাওয়ার চাপা ৰোভ উপলব্ধি করা যায়। অনবরত চোখের জল ফেলছিলেন মা জরিনা বেগম। বললেন, স্বপ্নে দেখা সিমিকে আমি কোন জবাব দিতে পারি না। মৃতু্যর আগে আমি ওদের ফাঁসি হয়েছে দেখে যেতে চাই। বখাটেদের ফাঁসি না হলে সিমির মতো মেয়েরা আত্মহত্যা করতেই থাকবে।
সিমির মা বললেন, নয় বছরেও মামলা তুলে না নেয়ায় অভিযুক্ত দোয়েল, কোয়েল, শাওন ঢিল ছুঁড়ে বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। গত ঈদ-উল-আজহায় সিমির বাবা আলী এমদাদকে মেরে একটি দাঁত ভেঙ্গে দেয়। সম্প্রতি বাড়ির পোষা কুকুরকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে মামলার আসামিরা।
প্রতিবাদী হও
প্রতিবাদী হওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় ও সচেতনতা ছাড়া এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন বলে মনে করছেন সংশিস্নষ্টরা। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারের কারণে আত্মহত্যায় উদ্যত দু'জন স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পরিবার থেকেই মেয়েটির জন্য সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। পরিবারে আস্থা না পেলে মেয়েটি অসহায় হয়ে পড়ে। স্কুল, কমিউনিটি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং পরিবারের সকলে মিলে কাউন্সেলিং করলে মেয়েরা আর আত্মহত্যায় ঝুঁকবে না। একমাত্র প্রতিবাদের মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। সম্প্রতি যৌন নিপীড়ন রোধে হাইকোর্ট একটি নীতিমালা দিয়েছে। যতদিন পর্যনত্ম আইন প্রণয়ন না হবে ততদিন পর্যনত্ম এ নীতিমালাই গাইডলাইন হিসাবে থাকবে। তাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব, মোকাবেলা করা সম্ভব সাহসিকতা দিয়ে। আমরা ইভটিজিং ঠেকাতে এ বিষয়টিকেই সবচেয়ে গুরম্নত্ব দিচ্ছি। ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েদের বোঝাতে হবে আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ডেপুটি ডিরেক্টর এ্যাডভোকেট কোহিনূর বেগম বলেন, প্রতি বছরই ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটছে। কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কিশোরী বা তরম্নণীদের চলাফেরার পথে অথর্াৎ রাসত্মায় ইভটিজিংয়ের ঘটনা বেশি ঘটে। হাইকোর্টের দেয়া নীতিমালায় কর্মৰেত্র বা শিৰাৰেত্রে ইভটিজিংকে যৌন হয়রানি হিসাবে অনত্মভর্ুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাসত্মার ৰেত্রে কি হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। এ বিষয়টি অনত্মর্ভুক্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে দ্রম্নত আইনটি পাসের উদ্যোগ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, ইভটিজিংয়ের মামলাগুলোর ৰেত্রে পুলিশকে আরও আনত্মরিক হওয়া প্রয়োজন। পিংকির মামলার ৰেত্রে আমরা বার বারই দেখছি পুলিশ বলছে অভিযুক্তের সঙ্গে মেয়েটির প্রেম ছিল। এটা একটি অদ্ভুত বক্তব্য। মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। এ বয়সে প্রেমের মতামত নেয়ার সময় তৈরি হয় না। আর প্রেম থাকলেও যেহেতু সে টিজিংয়ের শিকার হয়েছে এবং অপমানে আত্মহত্যা করেছে, সেহেতু এর বিচার অবশ্যই হতে হবে।
মনোবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদা আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণত উঠতি বয়সী মেয়েরাই পথে-ঘাটে চলতে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়। বয়স কম থাকার কারণে তারা আবেগপ্রবণ থাকে। ফলে সাধারণভাবে কটূক্তি বা অশস্নীল বাক্যবাণে তারা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পরিবার ও সমাজের অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তাদের আরও শঙ্কাগ্রসত্ম করে তোলে। তিনি বলেন, ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় মানসিক সমর্থন দেয়া সবচেয়ে জরম্নরি। আর উত্ত্যক্তকারীর অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া উচিত তাদের ছেলে যেন কোন মেয়ের প্রাণহানির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
আইনে যা আছে
২০০৯ সালের ১৫ মে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এ নীতিমালায় কর্মৰেত্র, শিৰাৰেত্র এবং ঘরের বাইরে যেকোন বয়সী নারী ও শিশু নিপীড়ন রোধে কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। আদালতের রায় বলা হয়, নারী ও শিশুদের হয়রানিমূলক নিপীড়ন করা যাবে না। সংসদে নতুন করে আইন পাস না হওয়া পর্যনত্ম এ নীতিমালা আইন হিসাবে কাজ করবে। অশোভন অঙ্গভঙ্গি, ইঙ্গিতমূলক আচরণ ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলা যাবে না। কর্মৰেত্রে বা বাইরে উৎপাত, অশালীন ই-মেইল, ফোনে বিরক্তি, কাউকে ইঙ্গিত করে সুন্দরী বলা যৌন নিপীড়নের আওতায় পড়বে।
বাংলাদেশে প্রচলিত দ-বিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী কেউ যদি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার জন্য কোন মনত্মব্য বা অঙ্গভঙ্গি বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে তাহলে ওই ব্যক্তি এক বছর কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে। উৎপাতের ফলে কেউ যদি মানসিক বা শারীরিকভাবে ৰতিগ্রসত্ম হয়, দ-বিধির ৩৫২ ধারায় উৎপাতকারীকে শাসত্মি দেয়া যাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত), ২০০৩-এর ১০(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোন পুরম্নষ তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোন নারীর শস্নীলতাহানি করলে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করলে তার জন্য এ কাজ হবে যৌন হয়রানি এবং এ কাজের জন্য ওই পুরম্নষকে অনধিক সাত বছর অনূ্যন তিন বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া যেতে পারে।
ঢাকা মহানগরীর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ রাসত্মায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন মহিলাকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে অথবা অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশস্নীল আওয়াজ বা অঙ্গ-ভঙ্গি বা মনত্মব্য করে তবে সেই ব্যক্তি এক বছর পর্যনত্ম মেয়াদের কারাদ- বা দুই হাজার টাকা পর্যনত্ম জরিমানা বা উভয় প্রকার দ-ে দ-িত হবে।
শুধু গত এক বছরের এক হিসাবে দেখা যায়, ইভটিজিংয়ের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এক বছরেই ইভটিজিংয়ের ঘটনা বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ১১টি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডবিস্নউএলএ) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালে দেশে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ১২টি। আর ইভটিজিংয়ের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৯টি। মোট ২১টি ঘটনার মধ্যে মাত্র ২টির ৰেত্রে আত্মহত্যার মামলা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালে ইভটিজিং আড়াই গুণ বেড়েছে। মোট ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছে ৭ জন। আত্মহত্যার ৩টিসহ মোট মামলা হয়েছে ১০টি। ঘটনার শিকার এবং আত্মহত্যাকারী মেয়েদের ৯০ শতাংশই স্কুলপড়ুয়া।
মামলায় আশানুরূপ বিচার না হওয়ায় ইভটিজিংয়ের শিকার পরিবারগুলোর মধ্যে স্বজন হারানোর স্থায়ী শূন্যতার পাশাপাশি বিরাজ করে আতঙ্ক, ৰোভ।
হুমকির মুখে পিংকির পরিবার
পাড়ার বখাটে ছেলেদের সামনে গত ১৯ জানুয়ারি পাশের বাড়ির ড্রাইভার বখাটে মুরাদের হাতে চড় খেয়ে গস্নানিতে আত্মহননকারী স্কুলছাত্রী পিংকির পরিবার এখন অনবরত হুমকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ঘটনাটিকে লোকজনের সহানুভূতি কেড়ে হাল্কা করার জন্য পুলিশের সহায়তায় পিংকির সঙ্গে মুরাদ প্রেমের গল্প সাজিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পিংকির চাচা আলী আশরাফ। এমন মর্মস্পশর্ী ঘটনা ঘটলেও পুলিশের কোন সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। শ্যামলী ২ নং রোডের ১৫২/ক-সি, চাকলাদার বাড়ির দোতলায় পিংকিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে মুহ্যমান পুরো পরিবার। সঙ্গে আতঙ্কও রয়েছে। প্রথমে এ প্রতিবেদককে বাড়িতে ঢুকতে দিতে দ্বিধা করছিলেন তাঁরা। কথা বলতেও সতর্ক ছিলেন তাঁরা। পরে সংশয় কাটতেই ৬৫ বছর বয়সী পিংকির দাদি এ প্রতিবেদকে বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখান পিংকির শোবার রম্নম, পিংকির ছবি, আত্মহত্যার স্থান, গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেয়া পিংকির বোর্ডের বই। পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতা কেটে বইগুলোতে নিজেই মলাট দিয়েছিল শ্যামলী আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী পিংকি। ঝকঝকে মলাটের বইগুলো তেমনি পড়ে রয়েছে। বইগুলো জড়িয়ে ধরে আহাজারি করে উঠলেন দাদি, 'চোৰের সামনে শুধু পিংকি ভাসে। রাইতে ঘুমাইতে পারি না।' তার আফসোস, সেদিন পেনশনের টাকা তুলতে না গেলে বাসাও খালি থাকত না মা মরা মেয়েটাও মরত না। তিনি বাড়িতে থাকলে মুরাদের চড় মারা আর অন্য বখাটেদের হাসাহাসির কথা নিশ্চয় তাকে বলত। বললেন, পিংকির দাদার পেনশনের টাকা তুলি মাসে মাসে। এবার দর্জি দোকানে জামা বানাবার জন্য কাপড় দিয়ে আসার পর থেকেই সারাৰণ আবদার জানাতে থাকে। 'দাদি তাড়াতাড়ি টাকা তোল, জামা কিনব'। সে টাকা তুলতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন তিনি। এসে পিংকির লাশ পান। বললেন, বাড়ির নিচে ওর ছোট দুই কাজিনের সঙ্গে খেলতে খেলতে দুষ্টমি করে হাত কাটে। পরে দোকানে যায় ব্যান্ডএইড কিনতে। দুষ্টমি করে হাত কাটার কারণ কি জানতে চায় বখা মুরাদ। পিংকি জবাব না দেয়ায় মুরাদ তাকে চড় মারে। পিংকির কাজিনসহ আশপাশের সবাই সে ঘটনা দেখে হাততালি দিয়ে হেসে ওঠায় অপমানে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে সে। শূন্য বাড়িতে ফ্যানে দাদির শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। দাদি জানান, দরজা ধাক্কা দেয়ার পরও পিংকি দরজা না খোলায় দোতলার বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পিংকির কাজিনদের ঘরে ঢোকানো হয়। তারা ঘরে ঢুকে মূল দরজা খোলে। এর পরের ঘটনা বলতে গিয়ে আবেগে আপস্নত হয়ে পড়েন দাদি। আহাজারি করে বলেন 'এইডা আমি কী দেখলাম, ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতাছে আমার কলিজার টুকরা।' পিংকির আবদার মতো পেনশনের টাকা দিয়ে দর্জির দোকানে থাকা জামা তিনি নিয়ে এলেও তা পরে আনন্দ করার মানুষটি নেই। পিংকির চাচা জানালেন মামলা তুলে নেয়ার জন্য নানান ফোন থেকে তাদের হুমকি দেয়া হয়।
সিমির শূন্যতা বাড়িজুড়ে
গাছে ঢাকা বাড়িটিকে দেখলেই বোঝা যায় বাড়ির বাসিন্দারা সংস্কৃতিমনা। দোতলায় উঠতে প্রতিটি সিঁড়িতেই শিকায় ঝুলানো লতানো গাছ, দেয়ালে পেইন্টিংস। ড্রইংরম্নমজুড়ে শুধুই শিল্পকর্ম, মাটির মটকিতে আঁকা ছবি, টেরাকোটা। দেয়ালে সাঁটানো পেইন্টিংস ছাড়াও মেঝেতে ঠেস দিয়ে রাখা বড় পেইন্টিংস। একটি পরিবার চিরদিনের জন্য অনুপস্থিত একজন মানুষকে কিভাবে নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে তা দেখে থমকে যেতে হয়। বাড়িজুড়ে একজন মানুষের ছোঁয়া। সবই তার করা। শুধু সে নেই। গত ৯ বছর ধরে তার চপলতা, চঞ্চলতা শুধু মা-বাবা, বড় বোন আর দুই ভাইয়ের অনুভবের মধ্যে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে মাকে দেখা দেয়, আকুতি নিয়ে বলে, 'মা, ওদের জন্য বাঁচতে পারলাম না। আর তোমরা ওদের কিছুই করলে না?' ৯ বছর আগে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননকারী চারম্নকলার ছাত্রী সিমি বানুর পরিবারজুড়ে এখনও হাহাকার। সিমির বয়সী মেয়ে দেখলে মা জরিনা বেগমের আবেগ আপস্নুত আচরণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তোলে উপস্থিতদের। এ প্রতিবেদন তৈরির জন্য সিমিদের খিলগাঁওয়ের নবীনবাগের ২৪৮/৬ নং বাড়িতে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকের হাহাকার আর ৯ বছরেও বিচার না পাওয়ার চাপা ৰোভ উপলব্ধি করা যায়। অনবরত চোখের জল ফেলছিলেন মা জরিনা বেগম। বললেন, স্বপ্নে দেখা সিমিকে আমি কোন জবাব দিতে পারি না। মৃতু্যর আগে আমি ওদের ফাঁসি হয়েছে দেখে যেতে চাই। বখাটেদের ফাঁসি না হলে সিমির মতো মেয়েরা আত্মহত্যা করতেই থাকবে।
সিমির মা বললেন, নয় বছরেও মামলা তুলে না নেয়ায় অভিযুক্ত দোয়েল, কোয়েল, শাওন ঢিল ছুঁড়ে বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। গত ঈদ-উল-আজহায় সিমির বাবা আলী এমদাদকে মেরে একটি দাঁত ভেঙ্গে দেয়। সম্প্রতি বাড়ির পোষা কুকুরকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে মামলার আসামিরা।
প্রতিবাদী হও
প্রতিবাদী হওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় ও সচেতনতা ছাড়া এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন বলে মনে করছেন সংশিস্নষ্টরা। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারের কারণে আত্মহত্যায় উদ্যত দু'জন স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পরিবার থেকেই মেয়েটির জন্য সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। পরিবারে আস্থা না পেলে মেয়েটি অসহায় হয়ে পড়ে। স্কুল, কমিউনিটি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং পরিবারের সকলে মিলে কাউন্সেলিং করলে মেয়েরা আর আত্মহত্যায় ঝুঁকবে না। একমাত্র প্রতিবাদের মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। সম্প্রতি যৌন নিপীড়ন রোধে হাইকোর্ট একটি নীতিমালা দিয়েছে। যতদিন পর্যনত্ম আইন প্রণয়ন না হবে ততদিন পর্যনত্ম এ নীতিমালাই গাইডলাইন হিসাবে থাকবে। তাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব, মোকাবেলা করা সম্ভব সাহসিকতা দিয়ে। আমরা ইভটিজিং ঠেকাতে এ বিষয়টিকেই সবচেয়ে গুরম্নত্ব দিচ্ছি। ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েদের বোঝাতে হবে আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ডেপুটি ডিরেক্টর এ্যাডভোকেট কোহিনূর বেগম বলেন, প্রতি বছরই ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটছে। কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কিশোরী বা তরম্নণীদের চলাফেরার পথে অথর্াৎ রাসত্মায় ইভটিজিংয়ের ঘটনা বেশি ঘটে। হাইকোর্টের দেয়া নীতিমালায় কর্মৰেত্র বা শিৰাৰেত্রে ইভটিজিংকে যৌন হয়রানি হিসাবে অনত্মভর্ুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাসত্মার ৰেত্রে কি হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। এ বিষয়টি অনত্মর্ভুক্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে দ্রম্নত আইনটি পাসের উদ্যোগ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, ইভটিজিংয়ের মামলাগুলোর ৰেত্রে পুলিশকে আরও আনত্মরিক হওয়া প্রয়োজন। পিংকির মামলার ৰেত্রে আমরা বার বারই দেখছি পুলিশ বলছে অভিযুক্তের সঙ্গে মেয়েটির প্রেম ছিল। এটা একটি অদ্ভুত বক্তব্য। মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। এ বয়সে প্রেমের মতামত নেয়ার সময় তৈরি হয় না। আর প্রেম থাকলেও যেহেতু সে টিজিংয়ের শিকার হয়েছে এবং অপমানে আত্মহত্যা করেছে, সেহেতু এর বিচার অবশ্যই হতে হবে।
মনোবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদা আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণত উঠতি বয়সী মেয়েরাই পথে-ঘাটে চলতে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়। বয়স কম থাকার কারণে তারা আবেগপ্রবণ থাকে। ফলে সাধারণভাবে কটূক্তি বা অশস্নীল বাক্যবাণে তারা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পরিবার ও সমাজের অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তাদের আরও শঙ্কাগ্রসত্ম করে তোলে। তিনি বলেন, ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় মানসিক সমর্থন দেয়া সবচেয়ে জরম্নরি। আর উত্ত্যক্তকারীর অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া উচিত তাদের ছেলে যেন কোন মেয়ের প্রাণহানির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
আইনে যা আছে
২০০৯ সালের ১৫ মে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এ নীতিমালায় কর্মৰেত্র, শিৰাৰেত্র এবং ঘরের বাইরে যেকোন বয়সী নারী ও শিশু নিপীড়ন রোধে কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। আদালতের রায় বলা হয়, নারী ও শিশুদের হয়রানিমূলক নিপীড়ন করা যাবে না। সংসদে নতুন করে আইন পাস না হওয়া পর্যনত্ম এ নীতিমালা আইন হিসাবে কাজ করবে। অশোভন অঙ্গভঙ্গি, ইঙ্গিতমূলক আচরণ ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলা যাবে না। কর্মৰেত্রে বা বাইরে উৎপাত, অশালীন ই-মেইল, ফোনে বিরক্তি, কাউকে ইঙ্গিত করে সুন্দরী বলা যৌন নিপীড়নের আওতায় পড়বে।
বাংলাদেশে প্রচলিত দ-বিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী কেউ যদি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার জন্য কোন মনত্মব্য বা অঙ্গভঙ্গি বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে তাহলে ওই ব্যক্তি এক বছর কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে। উৎপাতের ফলে কেউ যদি মানসিক বা শারীরিকভাবে ৰতিগ্রসত্ম হয়, দ-বিধির ৩৫২ ধারায় উৎপাতকারীকে শাসত্মি দেয়া যাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত), ২০০৩-এর ১০(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোন পুরম্নষ তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোন নারীর শস্নীলতাহানি করলে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করলে তার জন্য এ কাজ হবে যৌন হয়রানি এবং এ কাজের জন্য ওই পুরম্নষকে অনধিক সাত বছর অনূ্যন তিন বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া যেতে পারে।
ঢাকা মহানগরীর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ রাসত্মায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন মহিলাকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে অথবা অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশস্নীল আওয়াজ বা অঙ্গ-ভঙ্গি বা মনত্মব্য করে তবে সেই ব্যক্তি এক বছর পর্যনত্ম মেয়াদের কারাদ- বা দুই হাজার টাকা পর্যনত্ম জরিমানা বা উভয় প্রকার দ-ে দ-িত হবে।
No comments