তৃতীয় গর্ভের সন্তান- আনোয়ারা সৈয়দ হকের কলাম
কয়েক মাস আগে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম যে,
আমার এক চেনাশোনা আত্মীয়ার আবার বাচ্চা হবে। এর আগে তার আরও দুটো বাচ্চা
হয়েছে। সেই দুটো বাচ্চা ছিল ছেলে।
ছেলে পয়দা হবার আগেই
পেট আলট্রাসনোগ্রাম করে আত্মীয়া এবং তার স্বামী ও অন্যরা জেনেছিলেন যে, তার
ছেলে হবে । প্রথম বাচ্চা ছেলে কে না চায়? প্রথম বাচ্চা ছেলে হবে শুনে
আত্মীয়ার সংসারে একটা আনন্দের ঢেউ যেন বয়ে গিয়েছিল। সকলেই খুব খুশি। সবচেয়ে
বেশি খুশি হয়েছিলেন বাচ্চাটার বাবা-মা। যেন ছেলে হবার পুরো ক্রেডিট
তাদেরই।
দ্বিতীয় বাচ্চা হবার সময়ও সেই একই অবস্থা। আগে থেকেই জানা গেল যে, ছেলে বাচ্চা হবে। আবারও সংসারে বয়ে গেল আনন্দের হিল্লোল। দু'দুটো ছেলে বাচ্চা, এর চেয়ে সুখের খবর আর কি হতে পারে ? হলো তার আবারও ছেলে। আনন্দে, স্ফূর্তিতে সময় কাটল কিছুদিন। সকলে বলল, ব্যস, আর বাচ্চার দরকার নেই। দুটো ছেলে বাচ্চা বড় করে মানুষ করে তোলার ঝক্কি কি কম?
কিন্তু বছর তিন যেতে না যেতে আবার সেই আত্মীয়া গর্ভবতী হলেন। এটা ছিল আকস্মিক একটি গর্ভধারণ। বাবা মা কেউই এই গর্ভের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। একবার ভাবলেন গর্ভপাত করাবেন কি-না। কিন্তু না, এতে তাদের মন সায় দিল না। এবার আলট্রাসনোগ্রাম করে জানা গেল মেয়ে বাচ্চা হবে। মেয়ে বাচ্চা? সকলে খুশি হবার বদলে যুক্তির আশ্রয় নিলেন। দুটো ছেলে বাচ্চার পর একটা মেয়ে বাচ্চা। ব্যাপারটা যুক্তিসই। হোক একটি মেয়ে, কী আর করা যাবে। আত্মীয়া, অর্থাৎ যার বাচ্চা হবে, তিনি খুশিই হলেন। তার স্বামীও বললেন, নো কমপেস্নইন। দুটো ছেলের পর একটা মেয়ে হবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের মেনে নিতে হবে। এবং নেয়াই উচিত।
যথাসময়ে আত্মীয়া পূর্ণগর্ভা হলেন। এই গর্ভটি তাকে খুব ভুগিয়েছে। বাচ্চা পেটে আসার পর পর কত যে অশানত্মি। আর তো বাচ্চা তারা চাননি। তারপর জানা গেল মেয়ে বাচ্চা। সেটাও একরকম মেনে নেয়া গেল। কিন্তু এই বাচ্চাটা পেটে আসার পর তার মাকে কত যে জ্বালিয়েছে। তিনমাস তো বমিই হলো। তারপর মুখে অরম্নচি। তারপর পেট ব্যথা। তারপর কোমর ব্যথা। ব্যথায় সারা শরীর টনটন। মাথার চুলও কিছু পড়ে গেল। সকলে বলতে লাগল, এ রকম হবে না কেন, মেয়ে সনত্মান পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই মাকে কষ্ট দিতে থাকে। এরপর দেবে সে বাবাকে কষ্ট। তারপর যদি সে লক্ষ্মী মেয়ে না হয়, তাহলে সমাজের মুখেও চুনকালি মাখাতে পারে।
এতসব ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাবার পরেও এবং এতসব চিনত্মাভাবনার পরেও আমার আত্মীয়া তার অনাগত মেয়ে বাচ্চাটির জন্যে বুনতে শুরম্ন করলেন গোলাপি রঙের সুয়েটার। লাল রঙের পা মোজা, কারণ তখন ছিল শীতকাল।
যথাসময়ে প্রসব ব্যথা উঠল, কিন্তু বাচ্চা আর পৃথিবীর মুখ যেন দেখতে চায় না! সকলে বলল, আগের বাচ্চা দুটো কত সহজে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু এই মেয়ে বাচ্চাটি পেটে আসা অবধি শুধু মাকে কষ্টই দিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখ প্রসবের সময়ও সে পেট থেকে যেন নড়তে চায় না!
কিন্তু না, নড়ল সে পেট থেকে ঠিকই। একটু সময় নিয়ে হলেও খুব গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে সে বেরিয়ে এলো পৃথিবীতে। এবং পেট থেকে বেরিয়ে এলো একটি ছেলে শিশু হিসেবে। অর্থাৎ সে মেয়ে শিশু নয়, ছেলে শিশু। ডাক্তার, নার্স হতভম্ব হয়ে গেল। তার মানে আলট্রাসনোগ্রাম তাদের ভুল তথ্য দিয়েছে। হাজার হোক একটি মেশিন তো বটে। সবসময় সঠিক তথ্য নাও দিতে পারে। তাছাড়া ডাক্তারও বললেন, আলট্রাসনোগ্রাম এখনও এক শ'ভাগ সত্য খবর দিতে পারে না।
আবার ছেলে শিশু হয়েছে শুনে বাবা মা প্রথমে যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। আত্মীয়স্বজনেরাও। তারপর ঝর্ণার স্রোতধারার মতো অনর্গল বয়ে যেতে লাগল আনন্দের বন্যা। হাসপাতালে অপেমাণ আত্মীয়স্বজনের ভেতরে যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ছেলেরা হো হো করে হেসে উঠলেন। মেয়েরা খিল খিল করতে করতে জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। পুরম্নষেরা কোলাকুলি করতে লাগলেন। বাচ্চার বাবার পিঠ চাপড়ে তারা কেউ কেউ বলতে লাগলেন, মিয়া, তুমি দেখাইলা বটে! আরে ব্বাস, তিন তিনটা ছেলে পয়দা করলা, এটা একটা সহজ কাম নাকি! একজন আত্মীয়া দৌড়ে বাজারে গিয়ে দশ বাক্স মিষ্টি কিনে আনলেন। সারা হাসপাতালে মিষ্টি বিলানো হলো। সবচেয়ে বেশি মিষ্টি খেলেন হাসপাতালের ডাক্তার, যদিও তার ডায়াবেটিস আছে, তার ভাবটা হলো যেন ছেলে বাচ্চা পেট থেকে বের করে আনার প্রাপ্য ক্রেডিট তারই। বাচ্চার বাবা তার স্ত্রীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, আমারও মনে হচ্ছিল এবারও আমার ছেলেই হবে! বংশে মেয়ে পয়দা করার মানুষ আমি না! তুমি খামোখা একগাদা গোলাপি লাল পোশাক বুনলে বসে বসে। ভাবলে বুঝি মেয়ে হবে। এখন ঐ মেয়ে বাচ্চার পোশাক আমি আমার ছেলেকে পরাব ভেবেছ? কভি নেহি। বড় হয়ে শুনলে সে অপমান বোধ করবে না? এখনই আমি বাজারে যাচ্ছি ছেলের পোশাক কিনতে, বুঝলে?
কাকতালীয়ভাবে আমি সেদিন সেই হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম। স্বামীর কথা শুনে আত্মীয়া হেসে উঠলেন। লাজুক কিন্তু গর্বের একটা হাসি। ছেলে পয়দা করার হাসি।
দ্বিতীয় বাচ্চা হবার সময়ও সেই একই অবস্থা। আগে থেকেই জানা গেল যে, ছেলে বাচ্চা হবে। আবারও সংসারে বয়ে গেল আনন্দের হিল্লোল। দু'দুটো ছেলে বাচ্চা, এর চেয়ে সুখের খবর আর কি হতে পারে ? হলো তার আবারও ছেলে। আনন্দে, স্ফূর্তিতে সময় কাটল কিছুদিন। সকলে বলল, ব্যস, আর বাচ্চার দরকার নেই। দুটো ছেলে বাচ্চা বড় করে মানুষ করে তোলার ঝক্কি কি কম?
কিন্তু বছর তিন যেতে না যেতে আবার সেই আত্মীয়া গর্ভবতী হলেন। এটা ছিল আকস্মিক একটি গর্ভধারণ। বাবা মা কেউই এই গর্ভের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। একবার ভাবলেন গর্ভপাত করাবেন কি-না। কিন্তু না, এতে তাদের মন সায় দিল না। এবার আলট্রাসনোগ্রাম করে জানা গেল মেয়ে বাচ্চা হবে। মেয়ে বাচ্চা? সকলে খুশি হবার বদলে যুক্তির আশ্রয় নিলেন। দুটো ছেলে বাচ্চার পর একটা মেয়ে বাচ্চা। ব্যাপারটা যুক্তিসই। হোক একটি মেয়ে, কী আর করা যাবে। আত্মীয়া, অর্থাৎ যার বাচ্চা হবে, তিনি খুশিই হলেন। তার স্বামীও বললেন, নো কমপেস্নইন। দুটো ছেলের পর একটা মেয়ে হবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের মেনে নিতে হবে। এবং নেয়াই উচিত।
যথাসময়ে আত্মীয়া পূর্ণগর্ভা হলেন। এই গর্ভটি তাকে খুব ভুগিয়েছে। বাচ্চা পেটে আসার পর পর কত যে অশানত্মি। আর তো বাচ্চা তারা চাননি। তারপর জানা গেল মেয়ে বাচ্চা। সেটাও একরকম মেনে নেয়া গেল। কিন্তু এই বাচ্চাটা পেটে আসার পর তার মাকে কত যে জ্বালিয়েছে। তিনমাস তো বমিই হলো। তারপর মুখে অরম্নচি। তারপর পেট ব্যথা। তারপর কোমর ব্যথা। ব্যথায় সারা শরীর টনটন। মাথার চুলও কিছু পড়ে গেল। সকলে বলতে লাগল, এ রকম হবে না কেন, মেয়ে সনত্মান পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই মাকে কষ্ট দিতে থাকে। এরপর দেবে সে বাবাকে কষ্ট। তারপর যদি সে লক্ষ্মী মেয়ে না হয়, তাহলে সমাজের মুখেও চুনকালি মাখাতে পারে।
এতসব ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাবার পরেও এবং এতসব চিনত্মাভাবনার পরেও আমার আত্মীয়া তার অনাগত মেয়ে বাচ্চাটির জন্যে বুনতে শুরম্ন করলেন গোলাপি রঙের সুয়েটার। লাল রঙের পা মোজা, কারণ তখন ছিল শীতকাল।
যথাসময়ে প্রসব ব্যথা উঠল, কিন্তু বাচ্চা আর পৃথিবীর মুখ যেন দেখতে চায় না! সকলে বলল, আগের বাচ্চা দুটো কত সহজে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু এই মেয়ে বাচ্চাটি পেটে আসা অবধি শুধু মাকে কষ্টই দিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখ প্রসবের সময়ও সে পেট থেকে যেন নড়তে চায় না!
কিন্তু না, নড়ল সে পেট থেকে ঠিকই। একটু সময় নিয়ে হলেও খুব গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে সে বেরিয়ে এলো পৃথিবীতে। এবং পেট থেকে বেরিয়ে এলো একটি ছেলে শিশু হিসেবে। অর্থাৎ সে মেয়ে শিশু নয়, ছেলে শিশু। ডাক্তার, নার্স হতভম্ব হয়ে গেল। তার মানে আলট্রাসনোগ্রাম তাদের ভুল তথ্য দিয়েছে। হাজার হোক একটি মেশিন তো বটে। সবসময় সঠিক তথ্য নাও দিতে পারে। তাছাড়া ডাক্তারও বললেন, আলট্রাসনোগ্রাম এখনও এক শ'ভাগ সত্য খবর দিতে পারে না।
আবার ছেলে শিশু হয়েছে শুনে বাবা মা প্রথমে যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। আত্মীয়স্বজনেরাও। তারপর ঝর্ণার স্রোতধারার মতো অনর্গল বয়ে যেতে লাগল আনন্দের বন্যা। হাসপাতালে অপেমাণ আত্মীয়স্বজনের ভেতরে যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ছেলেরা হো হো করে হেসে উঠলেন। মেয়েরা খিল খিল করতে করতে জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। পুরম্নষেরা কোলাকুলি করতে লাগলেন। বাচ্চার বাবার পিঠ চাপড়ে তারা কেউ কেউ বলতে লাগলেন, মিয়া, তুমি দেখাইলা বটে! আরে ব্বাস, তিন তিনটা ছেলে পয়দা করলা, এটা একটা সহজ কাম নাকি! একজন আত্মীয়া দৌড়ে বাজারে গিয়ে দশ বাক্স মিষ্টি কিনে আনলেন। সারা হাসপাতালে মিষ্টি বিলানো হলো। সবচেয়ে বেশি মিষ্টি খেলেন হাসপাতালের ডাক্তার, যদিও তার ডায়াবেটিস আছে, তার ভাবটা হলো যেন ছেলে বাচ্চা পেট থেকে বের করে আনার প্রাপ্য ক্রেডিট তারই। বাচ্চার বাবা তার স্ত্রীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, আমারও মনে হচ্ছিল এবারও আমার ছেলেই হবে! বংশে মেয়ে পয়দা করার মানুষ আমি না! তুমি খামোখা একগাদা গোলাপি লাল পোশাক বুনলে বসে বসে। ভাবলে বুঝি মেয়ে হবে। এখন ঐ মেয়ে বাচ্চার পোশাক আমি আমার ছেলেকে পরাব ভেবেছ? কভি নেহি। বড় হয়ে শুনলে সে অপমান বোধ করবে না? এখনই আমি বাজারে যাচ্ছি ছেলের পোশাক কিনতে, বুঝলে?
কাকতালীয়ভাবে আমি সেদিন সেই হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম। স্বামীর কথা শুনে আত্মীয়া হেসে উঠলেন। লাজুক কিন্তু গর্বের একটা হাসি। ছেলে পয়দা করার হাসি।
No comments