অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ
উন্নয়ন অর্থনীতির অভিধানে 'এশীয় উন্নয়ন কৌশল' বলে একটি কথা চালু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। এখানে এই কৌশল বলতে এশিয়ার চারটি তেজি অর্থনীতির দেশ তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন কৌশলকে বোঝায়।
এই চারটি দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং সমাজ বিবর্তনের সফলতা শুধু এশিয়ায়ই নয়, সারা পৃথিবীর সামনে এখন একটা মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশগুলোতে উন্নয়নের হাওয়া বইতে শুরু করে ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে। ওই সময় উল্লিখিত দেশগুলো ছিল খুবই গরিব। আজ তাদের গড় মাথাপিছু আয় ৩০ হাজার ডলারের ওপরে।
দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া বাকি তিনটি দেশ আকারে একেবারেই ছোট ও ঘনবসতিপূর্ণ। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে চারটি দেশেই সম্পদ ও কর্মসংস্থানের তুলনায় শ্রমশক্তি ছিল প্রচুর। কিন্তু ছিল না তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম যে কাজটি তারা করে, তা হলো- শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও আধুনিকায়ন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা একটি বিরাট দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করে ফেলে। সংখ্যাধিক্যের কারণে দক্ষ হলেও শ্রমিকদের মজুরি উন্নত বিশ্বের তুলনায় রয়ে যায় অনেক সস্তা। এভাবে তারা প্রথমে শিল্পায়নের পথে বড় একটি বাধা (সহজলভ্য দক্ষ শ্রম) সহজেই দূর করে ফেলে।
এ ছাড়া কৃষি বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে সমতা ও ব্যক্তিমালিকানার ভিত্তিতে তারা ভূমি বণ্টনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার সাধন করে। দেশীয় কৃষিকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকার একদিকে দেয় ভর্তুকি, অন্যদিকে কৃষিপণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করার জন্য ট্যারিফ প্রথা চালু করে। শিল্প ও কৃষিতে ব্যক্তিমালিকানায় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে থাকে। দ্রুত ঘুরতে থাকে কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের চাকা। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিটি দেশ তাদের প্রবৃদ্ধির হার দুই অঙ্কের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
প্রথমদিকে ছোট অর্থনীতি এবং স্বল্প আয়ের কারণে দেশীয় বাজারে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা ছিল খুবই কম। আর তাই তাদের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মাত্র দুটি শব্দ- 'উৎপাদন' ও 'রপ্তানি'। ক্রমবর্ধমান 'রপ্তানি' নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তারা আরো যে দুটি বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিয়েছিল, তা হলো 'মানসম্মত রপ্তানি পণ্য' এবং বিশ্ববাজারে 'প্রতিযোগিতামূলক মূল্য'। আজকালকার উন্নয়ন অর্থনীতিতে এটাকে 'এশীয় ধারা' বা 'এশীয় পদ্ধতি' বলা হয়। এ চারটি এশীয় দেশই এ ধারা বা পদ্ধতির প্রবর্তক। এশিয়ার দুই বড় অর্থনীতি জাপান ও চীনের সঙ্গে 'এশীয় চারের' মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি। মিলের মধ্যে একটাই প্রধান- তারা সবাই বংশগত দিক থেকে মঙ্গোলীয়।
৪০ বছর আগে শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে 'এশীয় চার' চীনের তুলনায় যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি পেছনে ছিল জাপানের। মাত্র চার দশকের ব্যবধানে আজ তারা চীনকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে এবং জাপানকে ছুঁই ছুঁই করছে। দেশজ আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে ভোগ ও আমদানি বৃদ্ধি না পায়, সে জন্য তারা যথেষ্ট পরিমাণে ট্যারিফ বাড়িয়েছে। এতে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য-বৈষম্য তাদের অনুকূলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। বাড়তি পুঁজি তারা সঠিক খাতে দেদার বিনিয়োগ করতে থাকে এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের অর্থনীতির আকার।
অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি দেশ শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো গণমুখী করে তোলে এবং শিক্ষার প্রতিটি স্তরে অব্যাহতভাবে উন্নতি করে। শ্রমিক ও কর্মী তৈরির সঙ্গে সঙ্গে 'ব্যবস্থাপক', 'উদ্যোক্তা' ও 'নেতা' তৈরির জন্য তাদের উচ্চশিক্ষাকে তারা বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যায়। আজ এসব দেশের প্রতিটিতে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে উচ্চশিক্ষার প্রায় সব কটি শাখায় পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিটি পর্যায়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অনেক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাঁদের নিজ নিজ দেশ থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আসতে শুরু করেছেন। বর্তমানে সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্টদের মধ্যে অন্যতম। যে কয়টি বৈশিষ্ট্য 'এশীয় চারের' সব জায়গায় দেখা যায়, তা হলো রপ্তানিমুখী অর্থনীতি, উদ্বৃত্ত বাণিজ্য, অব্যাহত দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি, সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবাধ গণতন্ত্রের অভাব, প্রচুর পরিমাণ মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের মজুদ, উচ্চ সঞ্চয় হার, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিমালিকানা এবং স্বাধীনতা।
শিল্পায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে জাপানে একটি নতুন ধরনের 'শিল্প সংস্কৃতি' গড়ে ওঠে, যা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সংস্কৃতির মূলমন্ত্র হলো- সহমর্মিতা, সহযোগিতা, আত্মসংযম, আত্মোৎসর্গ, ব্যক্তি থেকে সমষ্টি বড়, অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় স্বল্প মেয়াদের তুলনায় দীর্ঘ মেয়াদের অধিক গুরুত্ব ইত্যাদি। 'এশীয় চার' জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির মূলমন্ত্রগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এবং সফলতা অর্জন করে। আজ তারা সেই সফলতারই সুফল ভোগ করছে।
মজার ব্যাপার হলো, অবাধ রাজনৈতিক স্বাধীনতা না দিয়েই 'এশীয় চার' জনগণকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা অন্য রকম। এখানকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি। এ দুইয়ের মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে কি না, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে 'এশীয় চারের' মতো দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করতে হলে দুটি বিষয়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমটি হলো শিক্ষা। বাংলাদেশে শিশু শিক্ষা, নারী শিক্ষা এবং মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার হার দিন দিন বাড়ছে। এখন অধিক গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষার মানের ওপর। উচ্চশিক্ষায় বিএ-এমএ পাসের পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও মান দুটোই বাড়াতে হবে। আধুনিক বাংলাদেশে শিক্ষার স্লোগান হওয়া উচিত 'দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির সঙ্গে দক্ষ ব্যবস্থাপক ও যোগ্য নেতা সৃষ্টি করতে হবে'।
এখানে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, 'এশীয় উন্নয়ন কৌশল' বাংলাদেশের জন্য হুবহু প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কারণ আলোচ্য চারটি দেশই জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ছোট। যেমন সিঙ্গাপুরের লোকসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ, হংকংয়ে ৭৫ লাখ, তাইওয়ানে দুই কোটি ৩০ লাখ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় চার কোটি ৮৭ লাখ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের লোকসংখ্যার অর্ধেকের মতো। যে কৌশল ছোট দেশে যেভাবে কার্যকর হয়েছে, সেটা বড় দেশে সেভাবে ফল নাও দিতে পারে। আমার মতে, 'এশীয় উন্নয়ন কৌশল' বাস্তবায়নের আগে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। অনেকের অপছন্দ হলেও এ প্রসঙ্গে আমি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং আ স ম আবদুর রবের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসতে চাই। দেশে যদিও তাঁদের জনপ্রিয়তা কম এবং তাঁদের দল ছোট, তবু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে বাংলাদেশের জন্য তাঁদের ধারণাকে আমি সঠিক বলে মনে করি। অনেকে বলবেন, এটা আমাদের এককেন্দ্রিক সংবিধানের সঙ্গে যায় না। আমি বলব, প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন করা হোক। দলের স্বার্থে যদি সংবিধান এতবার পরিবর্তন করা যায়, তাহলে দেশ ও জাতির স্বার্থে আরেকবার করা যাবে না কেন?
অবশেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশের মানুষের মনমানসিকতা এবং সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বড়, দেশ বড়। সমাজ ও দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হবে। বিনিয়োগের জন্য সবাইকে সাধ্যমতো সঞ্চয় করতে হবে। মনে রাখতে হবে জন এফ কেনেডির বিখ্যাত উক্তি- 'দেশ থেকে কী পেলাম, তা ভাবার আগে ভাবতে হবে, দেশকে কী দিলাম'। এটি একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। তার আগে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটা নূ্যনতম সমঝোতা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর
জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াস
awahid2569@gmail.com
No comments