এই দিনে-আমাদের শিশুরা... by মানসুরা হোসাইন

উৎসব তো কত রকমই হয়, কিন্তু উৎসবটি যদি হয় শিশুশ্রম নিরসনে সচেতনতা সৃষ্টিতে, তবে একটু অবাকই হতে হয়। ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশুশ্রমের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখিয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে একটি উৎসবের আয়োজন করেছে।


আজ মঙ্গলবার ১২ জুন সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এ উৎসব চলবে শাহবাগের গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে।
আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে দিনটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার: আসুন শিশুশ্রম নিরসন করি’। দিবসটিকে কেন্দ্র করেই এ ভিন্নধর্মী উৎসবের আয়োজন।
সবাই শিশুশ্রম বন্ধ করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে এটা চট করে বন্ধ করা যাচ্ছে না। কিন্তু চেষ্টা তো চালাতেই হবে। এ উৎসবটিরও মূল উদ্দেশ্য শিশুশ্রম প্রতিরোধে খানিকটা সচেতনতা তৈরি; বিভিন্ন এনজিও ও দাতাগোষ্ঠী যেসব প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে, তা সবাইকে দেখানো। প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর পাশাপাশি এসব নিয়ে মতামত বা সমালোচনা করারও সুযোগ পাবেন দর্শকেরা। সংশ্লিষ্ট এনজিও ও দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ফলে এই প্রতিনিধিরাও কাজের মধ্যে ফারাক থাকলে তা সংশোধনও করতে পারবেন।
সকাল ১০টায় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্যাথেরিন মাসুদ, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সহসভাপতি এম এহ্সানুর রহমান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সকাল ১০টা থেকে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে প্রদর্শনী দেখানো হবে। সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য এ উৎসবটি উন্মুক্ত থাকবে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ‘ইন আওয়ার ওউন ওয়ার্ডস’, ‘লেট মি লিভ, লেট মি গ্রো’,‘ভয়েসেস অব চিলড্রেন’, ‘আই ওয়ান্ট টু লিভ’, ইকো স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের ‘শিশুশ্রম মুক্ত ভজনপুর ইউনিয়ন’, ‘প্রশ্ন’, ‘তোমাদের পাশে থাকব’, ইউসেপের ‘দি মিরাকল’, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘আওয়ার চিলড্রেন, আওয়ার ন্যাশন’সহ ১২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠীর তৈরি মোট ২০টি প্রামাণ্যচিত্রে শিশুশ্রমিক ও তাদের জীবনের বিভিন্ন অজানা কাহিনি জানার সুযোগ থাকবে। তবে যে শিশুদের জীবন পরিবর্তনের জন্য এত আয়োজন, সেই শিশুদের জীবনে আসলেই কোনো পরিবর্তন হবে কি না তা আয়োজকদের কাছেও বিরাট প্রশ্ন। কেননা, এ পর্যন্ত এই শ্রমিকদের কেন্দ্র করে দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহু কর্মযজ্ঞ হয়েছে।
ইউনিসেফ এবং আইএলওর এক হিসাবে বাংলাদেশে কৃষি থেকে শুরু করে জাহাজভাঙা শিল্পসহ মোট চার শর বেশি ক্ষেত্রে শিশুরা কাজ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং আইএলও পরিচালিত ২০০২-০৩ সালের সর্বশেষ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৭৪ লাখ শিশু কাজ করে। ১৪ বছরের নিচে বয়সের শিশুদের শ্রম নিষিদ্ধ। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুশ্রম বলতে সপ্তাহে ৪৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করা বোঝায়। সে হিসাবে দেশে শিশুশ্রমিক ছিল ৪৭ লাখ। এদের মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ছিল। সরকার নতুন একটি জরিপ শুরু করেছে। জরিপ শেষ হলে দেশের শিশুশ্রমের বর্তমান চিত্র জানা সম্ভব হবে। আইএলও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সে অনুযায়ী সরকার অঙ্গীকারও করেছে। সরকার ২০০১ সালের মার্চ মাসে অত্যন্ত খারাপ ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল এবং প্রতিরোধে আইএলও কনভেনশন ১৮২ অনুসমর্থন করেছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকাটি চূড়ান্ত করেছে। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০-এর আলোকে কর্মপরিকল্পনা তৈরিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরফুদ্দিন খান এর আগে দীর্ঘ ১০ বছর আইএলওতে শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অভিভাবকদের মধ্যে এমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, যাতে করে বলা যাবে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। ২০০৩ সালের শিশুশ্রম জরিপের পর নতুন জরিপও করা হয়নি। তবে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরিরও বিকল্প নেই। উৎসবের পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে এই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ভবিষ্যৎ করণীয় হয়তো চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
মানসুরা হোসাইন

No comments

Powered by Blogger.