কথা সামান্যই-বেঁচে থাকার রকম by ফজলুল আলম
মানুষ নানাভাবে বেঁচে থাকে। সব বাঁচাই আবার বাঁচার মতো করে বাঁচা হয়েছে বলা যায় না। বেঁচে থাকা আত্মসংরক্ষণের একটা দিক। এই বেঁচে থাকা দৈহিক বাঁচার বিষয় হিসেবে এখানে ওঠানো হচ্ছে না। কারণ সেটা এই কলামের পরিসরে মোটেই সম্ভব হবে না।
আমি ভাবছিলাম, সবার বাঁচা একরকম হয় না কেন? পৃথিবীর ইতিহাসে ধনী-গরিবের বাঁচার রকমে ভেদাভেদ থাকলেও মানসিক বাঁচার সঙ্গে ধনসম্পদের বিষয়টা আসে না। ধনসম্পদ নিয়েও মানুষ অতৃপ্তিতে জীবন কাটায় এবং অনেকে ধনসম্পদ ছাড়াই তৃপ্তিতে জীবনযাপন করে। নিজের জীবনকে নিজের মতো করে পূর্ণভাবে উপভোগ করার উপাদান কী কী হতে পারে? আজকের কলামে আমি এ বিষয়ে ফ্রিডরিখ নীৎসের একটি নাতিদীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। তাঁর ভাষায় (বাংলা ভাবানুবাদ আমার) :
"প্রশ্নটা ছিল- কোনো ব্যক্তি যা হয়েছে, তা কিভাবে হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমাকে জীবনের আত্মসংরক্ষণ ক্ষেত্রের একটা কর্মের কথা উল্লেখ করতে হয়- এই কর্মটি হলো স্বার্থপরতা। বেঁচে থাকার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের চেয়ে এ কাজটা, এর উদ্দেশ্য ও কাজটার পরিপূরক অবস্থান গড়পড়তা কর্মকাণ্ডের চেয়ে বড়। কেউ বর্তমানে যা হয়েছে, সেটার পূর্বধারণা হচ্ছে যে, তারই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে, সে কী হয়েছে। এই দৃষ্টি থেকে সামান্য সময়ের পথবিচ্যুতি ও বিপথগামী, এমনকি জীবনের বিশাল ভুল পদক্ষেপ, বিলম্বিত কাজ, সংকোচজনিত কাজ, বর্তমান উদ্দেশ্যের বাইরে গুরুত্বহীন কাজে গুরুত্ব প্রদান- সব কিছুরই অবদান আছে। নিজেকে ভুলে যাওয়া, নিজেকে না বোঝা, নিজেকে খাটো করা, নিজেকে সংকীর্ণ করে তোলা, নিজেকে মামুলি করে তোলা, এসবের মাল-মসলা- এসবই তখন যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী প্রকাশ করলে এসবের অভিব্যক্তি হবে : প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, অন্যের জন্য ও অন্য কাজে বেঁচে থাকা- এগুলি কঠিন স্বার্থপরতার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য সৃষ্ট। এটা একটা ব্যতিক্রমী বিষয় : আমার নীতির ও বিশ্বাসের বাইরে আমি নিঃস্বার্থ উদ্যোগ নিই; এটাও স্বার্থপরতা, নিজেকে পরিমার্জনা করার পক্ষে। সাড়ম্বর কথাবার্তা, সাড়ম্বর মনোভঙ্গির বিরুদ্ধেও সজাগ থাকতে হবে। এর সবই বিপজ্জনক-স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নিজেকে আগেভাগে চিনে ফেলবে। এ সময়ের মধ্যে যে 'ধারণা' দিয়ে আধিপত্য বিস্তৃত হবে, তা গভীরভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে- এটা আদেশ দিতে শুরু করে, এটা ধীরে ধীরে পথবিচ্যুতি ও বিপথগমন থেকে যথাযথ পথে ফিরে আসে, এটা ব্যক্তি গুণাবলি সক্ষমতা বিকাশের জন্য তৈরি হয়; এই গুণাবলি পূর্ণত্ব অর্জনের পক্ষে একসময়ে অপরিহার্য হয়ে উঠবে- এটা একে একে সহায়ক ধারণক্ষমতা সৃষ্টি করে- তারপর একসময় কর্তৃত্বব্যঞ্জক কাজ, 'লক্ষ্য', 'উদ্দেশ্য', 'অর্থ' ইত্যাদির ইঙ্গিত দেয়। এদিক থেকে বিচার করলে আমার জীবন এক কথায় চমৎকার বটে। কারণ মূল্যবোধের সামর্থ্যের পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য আরো বেশি দাবি থাকে। তবে দেখতে হবে, পরস্পরবিরোধী সামর্থ্যগুলি একে অপরকে বিব্রত করবে বা ধ্বংস করবে, তেমন যেন না হয়।...
"জীবন এক কথায় চমৎকার বটে। কারণ মূল্যবোধের সামর্থ্যের পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য একক ব্যক্তির সামর্থ্যের আরো বেশি পরস্পরবিরোধী সামর্থ্যগুলি একে অপরকে বিব্রত করবে বা ধ্বংস করবে, তেমন যেন না হয়। সামর্থ্যের মর্যাদা স্তর; দূরত্ব; বৈরিতা ছাড়াও বিভাজন; কোনো কিছু একত্রিত না করা; কোনো প্রতিকূলতার নিষ্পত্তি না করা; বিশৃঙ্খলা তার উল্টো দিকে বিশাল প্রাচুর্য।- আমি বীরত্বপূর্ণ চরিত্রের উল্টো। এমনকি এ মুহূর্তে আমি আমার ভবিষ্যতের, সুদূর ভবিষ্যতের, দিকে তাকালে দেখি, শান্ত সমুদ্র- কোনো বাসনার ঝড় সেখানে নেই। এই বর্তমান অবস্থাতে আমি যা পাচ্ছি, আমি সেসব থেকে আর কোনো কিছুই এতটুকুও চাই না; আমি যা, আমি তা থেকে অন্য কিছু হতে চাই না...। আমি কোনো আশার ব্যঞ্জনা নিয়ে বসে থাকিনি। চুয়ালি্লশ বছর পর কেউ কি বলতে পারে, আমি সম্মান চাইনি, নারীসঙ্গের লালসা করিনি, বিত্তের পিছে ছুটিনি। এমন না যে, আমি এসব পেতে পারতাম না।...
"ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলি, যেমন পুষ্টি, স্থান, জলবায়ু, বিনোদন-স্বার্থপরতার সকল উপাদান, সবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই একজনকে নতুন করে শেখা শুরু করতে হবে। এতদিন মানবতা যেসবকে নিয়ে ভাবিত হয়েছিল, সেসব বাস্তবও নয়, স্রেফ কল্পনা; কঠোরভাবে বলতে হয়, সেসব রুগ্ণ ব্যক্তির প্রবৃত্তি থেকে উঠে আসা মিথ্যা মাত্র- 'ঈশ্বর', 'আত্মা', 'গুণ', 'পাপ', 'পরলোক', 'সত্য', 'চিরঞ্জীবিত্ব'... এ সবই মিথ্যা... গভীরতা সহকারে বলতে হয়, এসবই অহিতকর প্রবৃত্তি।
"কিন্তু মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব, তার 'দেবত্ব' এসবের মধ্যেই খোঁজা হয়েছে...। রাজনীতির সকল প্রশ্ন, সমাজবিন্যাস, শিক্ষা- এসবকে ভিত্তি পর্যায় পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণিত করা হয়েছে। কারণ সব যে অহিতকর বা অনিষ্টকর ব্যক্তিকে মহান ব্যক্তি মনে করা হয়েছে- জীবনের মৌলিক বিষয়গুলির প্রতি আমি যখন নিজেকে সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তুলনা করি, তখন পার্থক্যগুলি স্পষ্টত বোধগম্য হয়ে ওঠে। আমি এই সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মানবতার মধ্যে স্থানই দিতে চাই না- আমার কাছে তারা মানবতার আবর্জনা, রোগ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রবৃত্তির ভণ্ডুল হওয়া প্রজনন। তারা মূলত জীবনের ওপর প্রতিশোধ নেয়, তারা ক্ষতিকর ও অনারোগ্য কিম্ভূত জীব।...
"মানবতার মহত্ত্বের ফর্মুলা হচ্ছে, একজন যা, সে তার চাইতে অন্য কিছু হতে চাইবে না, ভবিষ্যতেও না, অতীতেও না, চিরন্তনীনভাবে তো নয়ই। প্রয়োজনীয়ভাবে যা ঘটছে, সেসব শুধু সয়ে যাওয়া, সেসব কপটভাবে এড়িয়ে যাওয়া নয়- প্রয়োজনের কাছে সকল আদর্শই অসত্য- কিন্তু সেটাকেই ভালোবাসতে হয়..."
(নীৎসে : 'আমাকে চিনতে হলে', ২০১১, ঢাকা : সংবেদ)
আমি অবশ্যই বলব, ওপরের কথাগুলো নিয়ে সবাই ভাবেন না। কারণ এত গভীর ভাবনার শিক্ষা বা মানসিক প্রশিক্ষণ আমাদের সবার নেই। তবু মানুষ ভাবে, মূল্যবোধ কী তা খোঁজে, তার জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সে যা পেয়েছে, তা মেলায় বা মেলানোর চেষ্টা করে। অধিকাংশ সময়ই তারা বিফল মনোরথ হয়। আবার এমনও অনেকে আছেন, যাঁদের অর্জন তাঁদের পাওয়ার বৈধতা, যোগ্যতা ও সক্ষমতা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে চলে গেছে। শেষোক্ত ব্যক্তিরা কারা, সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। তবে আমরা তাঁদের চিনি (নস্ত্রাদামাসের ভবিষ্যদ্বাণী 'একসময়ে গ্রামপর্যায়ের ভাঁড়েরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।')। তাই কি হচ্ছে না? ধীরে ধীরে মামুলিত্বে দেশ ভরে যাচ্ছে এবং আমরা তাতে উল্লসিত হয়ে আছি।
তার পরও বলব, বাঁচার বিভিন্ন রকমে অনেকে (অধিকাংশ ধনী ও তথাকথিত সফল ব্যক্তি) অল্পই বাঁচে, অনেকে ভাবনা-চিন্তা করে আগের দলের চেয়ে বেশি বাঁচে- আবার অনেকে কিছু না পেয়েও জীবনের মূল্যবোধ গ্রহণ করে পরিপূর্ণ জীবন বাঁচে। আমরা যদি শেষের রকমে বাঁচতে চাই, তাহলে শিগগিরই আমাদের মনমানসিকতা পরিবর্তনের শিক্ষা শুরু করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও
সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
"প্রশ্নটা ছিল- কোনো ব্যক্তি যা হয়েছে, তা কিভাবে হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে আমাকে জীবনের আত্মসংরক্ষণ ক্ষেত্রের একটা কর্মের কথা উল্লেখ করতে হয়- এই কর্মটি হলো স্বার্থপরতা। বেঁচে থাকার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের চেয়ে এ কাজটা, এর উদ্দেশ্য ও কাজটার পরিপূরক অবস্থান গড়পড়তা কর্মকাণ্ডের চেয়ে বড়। কেউ বর্তমানে যা হয়েছে, সেটার পূর্বধারণা হচ্ছে যে, তারই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে, সে কী হয়েছে। এই দৃষ্টি থেকে সামান্য সময়ের পথবিচ্যুতি ও বিপথগামী, এমনকি জীবনের বিশাল ভুল পদক্ষেপ, বিলম্বিত কাজ, সংকোচজনিত কাজ, বর্তমান উদ্দেশ্যের বাইরে গুরুত্বহীন কাজে গুরুত্ব প্রদান- সব কিছুরই অবদান আছে। নিজেকে ভুলে যাওয়া, নিজেকে না বোঝা, নিজেকে খাটো করা, নিজেকে সংকীর্ণ করে তোলা, নিজেকে মামুলি করে তোলা, এসবের মাল-মসলা- এসবই তখন যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী প্রকাশ করলে এসবের অভিব্যক্তি হবে : প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, অন্যের জন্য ও অন্য কাজে বেঁচে থাকা- এগুলি কঠিন স্বার্থপরতার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য সৃষ্ট। এটা একটা ব্যতিক্রমী বিষয় : আমার নীতির ও বিশ্বাসের বাইরে আমি নিঃস্বার্থ উদ্যোগ নিই; এটাও স্বার্থপরতা, নিজেকে পরিমার্জনা করার পক্ষে। সাড়ম্বর কথাবার্তা, সাড়ম্বর মনোভঙ্গির বিরুদ্ধেও সজাগ থাকতে হবে। এর সবই বিপজ্জনক-স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নিজেকে আগেভাগে চিনে ফেলবে। এ সময়ের মধ্যে যে 'ধারণা' দিয়ে আধিপত্য বিস্তৃত হবে, তা গভীরভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে- এটা আদেশ দিতে শুরু করে, এটা ধীরে ধীরে পথবিচ্যুতি ও বিপথগমন থেকে যথাযথ পথে ফিরে আসে, এটা ব্যক্তি গুণাবলি সক্ষমতা বিকাশের জন্য তৈরি হয়; এই গুণাবলি পূর্ণত্ব অর্জনের পক্ষে একসময়ে অপরিহার্য হয়ে উঠবে- এটা একে একে সহায়ক ধারণক্ষমতা সৃষ্টি করে- তারপর একসময় কর্তৃত্বব্যঞ্জক কাজ, 'লক্ষ্য', 'উদ্দেশ্য', 'অর্থ' ইত্যাদির ইঙ্গিত দেয়। এদিক থেকে বিচার করলে আমার জীবন এক কথায় চমৎকার বটে। কারণ মূল্যবোধের সামর্থ্যের পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য আরো বেশি দাবি থাকে। তবে দেখতে হবে, পরস্পরবিরোধী সামর্থ্যগুলি একে অপরকে বিব্রত করবে বা ধ্বংস করবে, তেমন যেন না হয়।...
"জীবন এক কথায় চমৎকার বটে। কারণ মূল্যবোধের সামর্থ্যের পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য একক ব্যক্তির সামর্থ্যের আরো বেশি পরস্পরবিরোধী সামর্থ্যগুলি একে অপরকে বিব্রত করবে বা ধ্বংস করবে, তেমন যেন না হয়। সামর্থ্যের মর্যাদা স্তর; দূরত্ব; বৈরিতা ছাড়াও বিভাজন; কোনো কিছু একত্রিত না করা; কোনো প্রতিকূলতার নিষ্পত্তি না করা; বিশৃঙ্খলা তার উল্টো দিকে বিশাল প্রাচুর্য।- আমি বীরত্বপূর্ণ চরিত্রের উল্টো। এমনকি এ মুহূর্তে আমি আমার ভবিষ্যতের, সুদূর ভবিষ্যতের, দিকে তাকালে দেখি, শান্ত সমুদ্র- কোনো বাসনার ঝড় সেখানে নেই। এই বর্তমান অবস্থাতে আমি যা পাচ্ছি, আমি সেসব থেকে আর কোনো কিছুই এতটুকুও চাই না; আমি যা, আমি তা থেকে অন্য কিছু হতে চাই না...। আমি কোনো আশার ব্যঞ্জনা নিয়ে বসে থাকিনি। চুয়ালি্লশ বছর পর কেউ কি বলতে পারে, আমি সম্মান চাইনি, নারীসঙ্গের লালসা করিনি, বিত্তের পিছে ছুটিনি। এমন না যে, আমি এসব পেতে পারতাম না।...
"ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলি, যেমন পুষ্টি, স্থান, জলবায়ু, বিনোদন-স্বার্থপরতার সকল উপাদান, সবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই একজনকে নতুন করে শেখা শুরু করতে হবে। এতদিন মানবতা যেসবকে নিয়ে ভাবিত হয়েছিল, সেসব বাস্তবও নয়, স্রেফ কল্পনা; কঠোরভাবে বলতে হয়, সেসব রুগ্ণ ব্যক্তির প্রবৃত্তি থেকে উঠে আসা মিথ্যা মাত্র- 'ঈশ্বর', 'আত্মা', 'গুণ', 'পাপ', 'পরলোক', 'সত্য', 'চিরঞ্জীবিত্ব'... এ সবই মিথ্যা... গভীরতা সহকারে বলতে হয়, এসবই অহিতকর প্রবৃত্তি।
"কিন্তু মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব, তার 'দেবত্ব' এসবের মধ্যেই খোঁজা হয়েছে...। রাজনীতির সকল প্রশ্ন, সমাজবিন্যাস, শিক্ষা- এসবকে ভিত্তি পর্যায় পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণিত করা হয়েছে। কারণ সব যে অহিতকর বা অনিষ্টকর ব্যক্তিকে মহান ব্যক্তি মনে করা হয়েছে- জীবনের মৌলিক বিষয়গুলির প্রতি আমি যখন নিজেকে সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তুলনা করি, তখন পার্থক্যগুলি স্পষ্টত বোধগম্য হয়ে ওঠে। আমি এই সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মানবতার মধ্যে স্থানই দিতে চাই না- আমার কাছে তারা মানবতার আবর্জনা, রোগ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রবৃত্তির ভণ্ডুল হওয়া প্রজনন। তারা মূলত জীবনের ওপর প্রতিশোধ নেয়, তারা ক্ষতিকর ও অনারোগ্য কিম্ভূত জীব।...
"মানবতার মহত্ত্বের ফর্মুলা হচ্ছে, একজন যা, সে তার চাইতে অন্য কিছু হতে চাইবে না, ভবিষ্যতেও না, অতীতেও না, চিরন্তনীনভাবে তো নয়ই। প্রয়োজনীয়ভাবে যা ঘটছে, সেসব শুধু সয়ে যাওয়া, সেসব কপটভাবে এড়িয়ে যাওয়া নয়- প্রয়োজনের কাছে সকল আদর্শই অসত্য- কিন্তু সেটাকেই ভালোবাসতে হয়..."
(নীৎসে : 'আমাকে চিনতে হলে', ২০১১, ঢাকা : সংবেদ)
আমি অবশ্যই বলব, ওপরের কথাগুলো নিয়ে সবাই ভাবেন না। কারণ এত গভীর ভাবনার শিক্ষা বা মানসিক প্রশিক্ষণ আমাদের সবার নেই। তবু মানুষ ভাবে, মূল্যবোধ কী তা খোঁজে, তার জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সে যা পেয়েছে, তা মেলায় বা মেলানোর চেষ্টা করে। অধিকাংশ সময়ই তারা বিফল মনোরথ হয়। আবার এমনও অনেকে আছেন, যাঁদের অর্জন তাঁদের পাওয়ার বৈধতা, যোগ্যতা ও সক্ষমতা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে চলে গেছে। শেষোক্ত ব্যক্তিরা কারা, সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। তবে আমরা তাঁদের চিনি (নস্ত্রাদামাসের ভবিষ্যদ্বাণী 'একসময়ে গ্রামপর্যায়ের ভাঁড়েরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।')। তাই কি হচ্ছে না? ধীরে ধীরে মামুলিত্বে দেশ ভরে যাচ্ছে এবং আমরা তাতে উল্লসিত হয়ে আছি।
তার পরও বলব, বাঁচার বিভিন্ন রকমে অনেকে (অধিকাংশ ধনী ও তথাকথিত সফল ব্যক্তি) অল্পই বাঁচে, অনেকে ভাবনা-চিন্তা করে আগের দলের চেয়ে বেশি বাঁচে- আবার অনেকে কিছু না পেয়েও জীবনের মূল্যবোধ গ্রহণ করে পরিপূর্ণ জীবন বাঁচে। আমরা যদি শেষের রকমে বাঁচতে চাই, তাহলে শিগগিরই আমাদের মনমানসিকতা পরিবর্তনের শিক্ষা শুরু করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও
সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments