অরণ্যে রোদন-কবিরা যখন সংবাদ শিরোনাম by আনিসুল হক

এই গল্পটা আপনারা জানেন, তবু আরেকবার সংক্ষেপে, নিরস গদ্যে বলে নিই। কবির স্ত্রী কবিকে বললেন, রাশি রাশি মিল দিচ্ছ, বড় বড় বই লিখছ, কিন্তু মাথার ওপরে যে বাড়ি পড়ো পড়ো, সেই খবরটা কি রাখো? আমাদের রাজা গুণের খুব কদর করেন, সবাই তাঁর কাছে যায়, হাত ভরে নিয়ে আসে, তুমিও যাও।


নিজেই পাড়াপ্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে কবিপত্নী নিয়ে এলেন রাজসভায় পরে যাওয়ার মতো উপযুক্ত পোশাক, গয়নাগাটি, শিরোভূষণ। সেসব নিজেই অনেক যত্ন করে পরিয়ে দিলেন কবিকে। কবির এই অপরূপ সাজ দেখে কবিপত্নী মুগ্ধ। বললেন, পুরনারীরা তোমাকে যখন দেখে কাতর হবে, তখন কিন্তু আমাকে ভুলবে না, আমি যেমন তোমাকে যত্ন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে পাঠাচ্ছি, তেমনি ফিরে এসে তুমিও আমাকে রতনভূষণরাজি দিয়ে সাজিয়ে তুলবে।
কবি রাজসভায় গেলেন। গিয়ে দেখলেন, এলাহি কাণ্ড। রাজসভা গমগম করছে। হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয়, রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়। সবারই মুখ গম্ভীর। এর মধ্যে নানাজনে আসছে, এলেন একজন নামাবলি গায়ে বৈষ্ণববেশে, তাঁকে রাজা পাঁচ হাজার টাকা দান করলেন। সবাই ধন্য ধন্য করে উঠল। এলেন একজন ব্যাকরণের পণ্ডিত, খটোমটো ভাষায় কী যেন শ্লোক পড়ে শোনালেন, রাজা তাঁকেও কিছু দান করলেন। একজন গণক এল, তাকে রাজা দিলেন টাকাকড়ি, এল একজন গণ্যমান্য, রাজা তাকে দান করলেন থলি ভরে, রাজপুরোহিত এলেন, পেলেন রাজদক্ষিণা, পিতার শ্রাদ্ধ করার জন্য দান পেল পুত্র, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা পেল নগদ কিছু। সব শেষে রাজা বললেন, ওই এক কোণে বসে আছেন বিপন্ন মুখচ্ছবি, তার খোঁজ নিতে হবে। কবি বললেন, না-না, আমি কিছু নই, আমি কবি। রাজা বললেন, তাহলে আজকে কাব্যালোচনা হবে। মন্ত্রী বললেন, অনেক কাজ যে পড়ে আছে। রাজা বললেন, সবাই বিদায় হও, আমি আর কবি থাকব শুধু, কবির সঙ্গে কথা হবে একান্তে। কবি রাজাকে শোনালেন তাঁর কাব্যকথা, বীণাপাণির বন্দনা করলেন, ‘যার যাহা আছে তার থাক তাই,/ কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই/ শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই একটি নিভৃত কোণে।’ কবির কাজ কী? কবি বললেন, ‘সংসারমাঝে কয়েকটি সুর/ রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,/ দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—/ তার পরে ছুটি নিব। সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,/ সুন্দর হবে নয়নের জল,/ স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল আরো আপনার হবে। প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে/ আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,/ আরেকটু স্নেহ শিশুমুখপরে/ শিশিরের মতো রবে।’
কবির কাব্য ও আলোচনা শুনে রাজা মুগ্ধ, বিগলিত, আত্মহারা। কবিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার রাজভান্ডারে যা আছে, তার সবকিছু আমি তোমাকে দিয়ে দিতে পারি। কবি বললেন, কিছুই দিতে হবে না, আপনার গলায় যে ফুলের মালাটা আছে, ওটা আমার গলায় পরিয়ে দিন। রাজা কবির কণ্ঠে নিজের ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। সেটা পরে বিজয়গর্বে গর্বিত কবি ফিরে এলেন নিজের ঘরে। কবিপত্নী বললেন, কী এনেছ। কবি বললেন, সবাই নানা রকমের দান গ্রহণ করেছে, টাকা-পয়সা, ধনরত্ন, আর আমি কী পেয়েছি জানো, রাজার নিজের গলার ফুলের মালা। কবিপত্নী প্রথমে একটুখানি রোষ দেখালেন, তারপর খুশিমনে কবিকে অনেক আদর করলেন, কবিও রাজমালাখানি পরিয়ে দিলেন স্ত্রীর গলায়।
কবিরা এ রকমই হন। বৈষয়িক ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ থাকে না। তাঁরা কেবল বীণাপাণির বরটুকু চান। শিল্প নামের সোনার হরিণ যেন তাঁদের কাছে ধরা দেয়, চিরদিন তাঁদের এই অধরার পেছনে ছুটে চলা। কিন্তু তাঁরা চান, সুখহাসি আরও উজ্জ্বল হোক, শিশুর মুখে আরও কিছু স্নেহ শিশিরের মতো টলমল করুক, পৃথিবীটা আরেকটু সুন্দর বসবাসযোগ্য হোক।
সবাই জানে, এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা পুরস্কারের কাহিনি। কী অপূর্ব এই কবিতাটি! লেখকদের আন্তর্জাতিক এক কর্মসূচিতে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া সিটিতে এসে এখানেই এই কবিতাটি আবার পড়তে পড়তে ভাবলাম, আহা, যে বাংলায় এই কবিতাটা পড়ল না, সে কি জানবে, সে কী হারাল? অনুবাদে কোথায় হারিয়ে যাবে এর মিলগুলো, এর পরিহাসগুলো? সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রিয় তিনজন কবিকে সংবাদ শিরোনাম হতে দেখে এই কাহিনিটা মনে পড়ল। খবরে পড়লাম, কবি মহাদেব সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ আর কবি মুহাম্মদ সামাদ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নিউইয়র্কে আসার জন্য পেয়েছিলেন পাঁচ লাখ টাকারও বেশি করে বরাদ্দ, তাঁদের জন্য বিমানে দেওয়া হয়েছিল বিজনেস ক্লাসের আসন, কিন্তু তাঁরা তা না নিয়ে ইকোনমি ক্লাসের টিকিটে আসবেন বলে তিনজনে মিলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে ১৩ লাখ টাকারও বেশি ফেরত দিয়ে এসেছেন। আমি তিনজন কবিকে খুব ভালো করে চিনি, তাঁরা আমার স্বজনের মতো। আমার ছাত্রাবস্থা থেকে আমি তাঁদের সাহচর্য পেয়ে এসেছি। আমি জানি, তাঁদের এ রকমই করার কথা। রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার কবিতার কবির মতো তাঁদেরও বৈষয়িক জ্ঞান সীমিত, এ রকম নীতিনিষ্ঠ নির্লোভ মানুষ খুব কমই আছে আমাদের ঢাকা শহরে। তবে নীতিনিষ্ঠ কথাটায় জোর দিতে হবে, তাঁরা নীতি মেনে চলেন, রাজনীতিতেও তাঁদের সুস্পষ্ট ও সরব অবস্থান আছে। প্রথম আলোর ইন্টারনেট সংস্করণে দেখলাম, এ খবরটা ওই দিন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০, সবচেয়ে পঠিত খবরের তালিকায় যেমন ঠাঁই পেয়েছে, তেমনি হয়েছে সবচেয়ে আলোচিত খবর। ২৪ জন পাঠক অনলাইনে এই খবর পড়ে তাঁদের মন্তব্য লিখেছেন। তাঁদের প্রায় সবাই, আমার মতোই, এই তিন কবিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন, এ রকম মানুষ এ দেশে আরও থাকলে ভালো হতো। কেউ কেউ অবশ্য পাশাপাশি এও বলেছেন, গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যাচ্ছেন, তাঁর যাত্রাবহর এত বড় কেন? ১০২ জন কেন যাবেন? কবিদেরই বা যাওয়ার কী দরকার, এই প্রশ্নও একজন কি দুজন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো কবিকে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার আবেদন জানান, কবির পক্ষে এই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়া সংগত হবে কি না, আমি ঠিক জানি না। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতার কবি কিন্তু রাজসভায় গিয়েছিলেন। ফুলের মালা ছাড়া কিছু নেননি, সে তিনি ভালোই করেছিলেন। কাজেই আমাদের প্রিয় তিন কবি নিউইয়র্কে আদৌ না গেলেই ভালো করতেন, এটা আমি ঠিক বলব না। কিন্তু এটা বলতে পারব, এই বহর যত ছোট হবে, ততই ভালো। গরিব দেশের টাকা বাঁচবে। যুক্তরাষ্ট্রেও সরকারি টাকা হলে এরা খুব কিপ্টের মতো খরচ করে, সব সময় শুনতে হয়, ট্যাক্সপেয়ারস মানি, অপচয় করা যাবে না। অর্থাৎ, এই টাকা সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল নয়, এই টাকা করদাতাদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা, এটার অপব্যয় না করার চেষ্টা করতে হবে সব সময়। তিন কবি—নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুহাম্মদ সামাদ সে চেষ্টাই করেছেন। ১৩ লাখ টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। একটা নজির স্থাপন করেছেন। এই নজির অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করুক।
কবিরা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন, বেশ, কিন্তু সাংবাদিকদের কি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়া উচিত? আমেরিকার বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর নীতি হলো, সাংবাদিকতার জন্য যদি কোথাও যেতে হয়, তাহলে তাঁরা নিজেদের খরচে যাবেন, কারও সফরসঙ্গী হয়ে যাবেন না। ইরাক যুদ্ধের সময় অবশ্য এমবেডেড হয়ে অনেক সাংবাদিকই সেই নীতি পরিত্যাগ করেছিলেন, সে নিয়ে সে দেশেই অনেক বিতর্ক হয়েছে। আমাদের অনেক মান্যবর সাংবাদিক-সম্পাদকই বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরসঙ্গী হয়েছেন, এর ঔচিত্য-অনৌচিত্য নিয়ে দেশে কেউ কখনো কিছু ভেবেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু মোটের ওপরে যে ব্যাপারে বিতর্ক নেই, তা হলো, জনগণের টাকা যতটা পারা যায় কম খরচ করা উচিত, দেশের টাকা যতটা পারা যায় দেশে রাখা উচিত। এ জাতীয় রাষ্ট্রীয় সফরবহরে রাখা উচিত ছোট, ঘনত্বে হওয়া উচিত কম। মানে বলতে চাচ্ছি, ঘন ঘন যেন সরকারি সফর সংঘটিত না হয়, অকারণে যেন জনগণের টাকা ব্যয় না হয়।
সরকারি টাকা ব্যয় করার সময় যেন মনে রাখা হয়, ওই টাকা গরিব মানুষের পকেট থেকে আনা। একটা বিড়ি খেলেও গরিব মানুষ কর দিয়েছে, একটা সিনেমা দেখার সময়ও কিছুটা টাকা সরকারের কোষে জমা রেখেছে। এখন নিশ্চয়ই আমরা ছোটবেলায় ট্রান্সলেশন ক্লাসে পড়া নাসির উদ্দিনকে আর পাব না, যিনি ছিলেন দিল্লির বাদশা, ‘সম্রাট হইয়াও যিনি ফকিরের মতো জীবনযাপন করিতেন, নিজের ছেঁড়া টুপি নিজেই সেলাই করে নিতেন।’ বেগম তাঁর কাছে টাকা চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘রাজকোষের অর্থ প্রজাসাধারণের, আমার নয়। আমি এখান থেকে একটা টাকাও তোমাকে দিতে পারব না।’
নাসির উদ্দিনকে আমরা আমাদের কালে আর পাব না বটে, কিন্তু একজন মতিয়া চৌধুরী, একজন নুরুল ইসলাম নাহিদ যেন আমরা পাই, যাঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব। আমাদের মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার—যিনিই সরকারি অর্থ ব্যয় করেন, তিনিই যেন একটু সচেতন হন; একটিবার অন্তত যেন ভাবেন, রাজকোষের এই টাকা আমার নয়, গরিব মানুষের, সাধারণ মানুষের। আমাদের তিনজন কবি আমাদের এই ভাবনাটা ভাবার সুযোগ করে দিলেন, উপলক্ষ এনে দিলেন—এ জন্য তিন কবিকে জানাই ভালোবাসা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.