অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে-পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন

আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সংগতভাবেই আশা করা হয়েছিল যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আর কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করা হবে না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যখন এই চুক্তি সম্পাদিত হয়, তখন দেশবাসী এটাকে স্বাগত জানিয়েছিল।


কারণ পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংঘাতের অবসানের সেটা ছিল অন্যতম উপায়। তখন বিএনপি চুক্তির বিরোধিতা করলেও পরবর্তীকালে তাদের সরকারের সময় চুক্তি বাতিল করেনি। চুক্তির ন্যায়সংগত ভিত্তি ছিল বলেই তারা সে পথে যায়নি। অবশ্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রত্যক্ষ উদ্যোগও বিএনপি গ্রহণ করেনি। তাই এই মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের উচিত ছিল চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। কিন্তু লক্ষণীয় অগ্রগতি নেই।
এটা ঠিক যে জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে একটি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি করা হয়েছে। দুটি বৈঠকও হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য টাস্কফোর্স পুনর্গঠন, ভূমি কমিশন আইন সংশোধন প্রভৃতি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যোগফল বলতে গেলে শূন্য, ক্ষেত্র বিশেষে ঋণাত্মক। চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে পার্বত্যবাসীর মধ্যে একধরনের হতাশা বিরাজ করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পার্বত্য অঞ্চলে আবার সংঘাতময় পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে সেখানে চুক্তিবিরোধী নানা উপদল পরস্পরবিরোধী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। চাঁদাবাজি ও নানা ধরনের উৎপাত বাড়ছে। আদিবাসী ও সেখানে বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলছে।
পার্বত্য চুক্তির একটি অন্যতম বিষয় ছিল উপজাতীয় শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর ন্যায়সংগত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ জন্য চুক্তি অনুযায়ী গঠিত আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যথাশিগগির পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের কাজ শুরু করার কথা। যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, উপজাতীয় জনগণের ভূমির মালিকানা চূড়ান্ত করে তাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত এবং ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার কাজটি চুক্তিতে প্রাধান্য পায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, প্রায় ৯৩ হাজার আদিবাসী পরিবার এখনো পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। এরা এখন জন্মভূমিতে পরবাসী! সরকার এদের শুধু যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি তা-ই নয়, উপরন্তু নতুন সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির আগে ভূমি জরিপের জন্য ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান অনড় অবস্থান গ্রহণ করায় এক ভয়াবহ বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সেনা ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে ফেলার কথা। প্রথমে এ ব্যাপারে উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু এখন প্রায় বন্ধ। বরং বিদ্রোহ প্রতিরোধ কার্যক্রম (কাউন্টার ইনসার্জেন্সি) জোরদার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠন করে এর মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। এতে আদিবাসীদের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে দ্বিধা ও সংশয় বেড়েছে।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সেটা কোনো সরকার বা দলের থাকে না, তা দেশের দলিলে পরিণত হয়। তাই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে তা সমগ্র দেশের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে। চুক্তিতে যদি কোনো অসামঞ্জস্য থাকে, তা দূর করার উপায় হলো সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে অভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং চুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পার্বত্য আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

No comments

Powered by Blogger.