শিক্ষা-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন by মামুনুর রশীদ
আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। এর আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। যেটুকু জানতাম তা মূলত সরকারি ও মিডিয়া ভাষ্যনির্ভর; ফলে ধারণাটাও মূলত নেতিবাচক ছিল_ এটা স্বীকার করতে হবে।
মিডিয়া সূত্রেই জানতাম, দেশে প্রতিষ্ঠিত ৫৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই আইন অনুযায়ী স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়েনি, এখানে শিক্ষক ও শিক্ষাদানের মান খুবই প্রশ্নবোধক এবং এদের অনেকেই সার্টিফিকেট বিক্রির মতো গুরুতর ও ন্যক্কারজনক অপরাধ করেছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে এটাও লক্ষ্য করছি যে, সাবেক ইউজিসিপ্রধান প্রায়ই বলে থাকেন, 'দু'একটি ছাড়া কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই মান ভালো নয়। একদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে এত অভিযোগ, অন্যদিকে প্রতি বছর তাদের ছাত্রসংখ্যা বাড়তে বাড়তে এত দিনে দু'লাখে পেঁৗছেছে, অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। এ বৈপরীত্য অনেক সময় আমার মনে খটকা তৈরি করলেও ব্যাপারটা কখনও তলিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করার সুবাদে এ খাত সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো মিডিয়া সূত্রে এ খাত সম্পর্কে যে ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা আদৌ গোটা খাতটির জন্য প্রযোজ্য নয়।
কেবল দুর্বলতম অংশের অনিয়ম বা ব্যর্থতা দিয়ে একটা গোটা খাতকে মাপলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই-বা দাঁড়াবে কোথায়? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় অঙ্গনেই শিক্ষার্থীদের নিজের মনে করি এবং তাদের স্বার্থে উভয়ের উন্নয়ন করাই আমাদের সবার দায়িত্ব বলে মনে করি। এখানে উচ্চশিক্ষার কোনো একটি অংশকে নিজের মনে করে অন্য পক্ষকে অশ্রদ্ধা বা অবহেলা করার কোনো যুক্তি দেখি না। অথচ গত কয়েক বছর ধরে যেন অনেকটা সে ধরনের মনোভাবকেই কেউ কেউ প্ররোচিত করতে চেয়েছেন। বর্তমান বৈশ্বিক যুগের বাস্তবতা হলো উচ্চশিক্ষায় পাবলিক খাতের পাশাপাশি একটি সবল ও সুঠাম বেসরকারি খাতও গড়ে তুলতে হবে। তবে এটা করতে গেলে চাই যথাযথ নীতিমালা। সঠিক নীতির জন্য আগে চাই খাতটি সম্পর্কে সৎ ও যথাযথ মূল্যায়ন।
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে অন্তত ২০ হাজার গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে ৪ বছরে সরকারের খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। তাহলে পাবলিক খাত থেকে এ ২০ হাজার গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে সরকারের বছরে খরচ হতো প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। আবার তারা বিদেশে পড়তে গেলে খরচের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হতো। ফলে দেশ হারাত প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। দেশ কোনো সরকারি খরচ ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির ক্রমবিকাশে অপরিহার্য এ সহযোগিতা পাচ্ছে। এককথায় সম্পূর্ণ নিজ খরচে ও চেষ্টায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, যার যথাযথ মূল্যায়ন তারা পাচ্ছে না।
গত কয়েক বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কিছু ব্যক্তিকে বহুবার শুধু এ খাতের ব্যর্থতাই তুলে ধরতে দেখা গেছে। সেই ব্যর্থতা নির্ণয়ের মানদণ্ডই-বা কতটা যথাযথ ছিল তা নিয়েও আছে অনেক প্রশ্ন। পাশাপাশি তাদের অর্জনের তেমন কোনো স্বীকৃতিই চোখে পড়েনি। এ খাত সম্পর্কে যারা এতটুকু ধারণা রাখেন তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক মূল্যায়নের সঙ্গে এ খাতের বাস্তবতার যে ফারাক তাতে অবাক না হয়ে পারবেন না। মুখে মুখেই এখন অন্তত আধাডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি আছে, যাদের মান সবাই খুব ভালো বলে জানেন। এগুলোর গ্র্যাজুয়েটরা হামেশাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চাকরি বাজারে টেক্কা দিয়ে টিকে যাচ্ছে। এর বাইরেও ডজনখানেক উঠতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের মানও সব বিচারে সন্তোষজনক। মোট ৫৩টির মধ্যে বেশ কয়েকটির মান প্রশ্নবোধক হতে পারে; কিন্তু যেখানে অন্তত দেড়-দুই ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সন্তোষজনক সেখানে 'দু'একটি' ছাড়া কোনোটি ভালো নয়_ এ জাতীয় মন্তব্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি সহায়তা ছাড়া সম্পূর্ণ নিজস্ব বিনিয়োগ ও ছাত্র ফি থেকে সঞ্চিত পুঁজির পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের অর্জনগুলো সম্ভব করেছে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় যাদের এখনও স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি হয়নি, তারাও অধিকাংশ নিজস্ব ভবনে বা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজেই ব্যবহৃত পূর্ণ ভবনে অবস্থিত। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এগুলোর অবকাঠামো বরং অনেক আধুনিক। তদুপরি এখানে নিয়মিত ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয়, সময়মতো ফল প্রকাশ হয় এবং ছাত্রছাত্রীরাও সঠিক সময়ে পড়াশোনা শেষ করে বের হয়ে যায়। শিক্ষকরাও নিয়মিত ও সম্মানজনক বেতন পান। তাদের গ্র্যাজুয়েটরা নানা এক্সট্রা/কো-কারিকুলাম একটিভিটিসের কল্যাণে বেশি চৌকস হয়ে বের হয়। আবার ইংরেজি ও আইটি দক্ষতায় বিশেষ নজর দেওয়াতেও তাদের চাকরির উপযোগিতা বাড়ে। যে খাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এত সব উপকার পাচ্ছে তাদের কেবল একটা ইস্যুর জোরে 'অবৈধ' আখ্যা দেওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেকের যে ব্যাপক ব্যর্থতা আছে সেটা কেউ অস্বীকার করে না; কিন্তু তাদের ব্যর্থতাই এ খাতের একমাত্র বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্র নয়। তাদের পাশাপাশি ভালোদের অর্জনটাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। আবার খারাপদেরও রকমফের আছে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আইন ভঙ্গ করছে। মুনাফার লোভে অনুমোদন ছাড়া আউটার ক্যাম্পাস খুলছে ও সার্টিফিকেট বিক্রি করছে। আবার অনেকে ইচ্ছা সত্ত্বেও পুঁজির অভাবে কৌশলগত বা অন্য কোনো দুর্বলতার কারণে আকাঙ্ক্ষিত মানে পেঁৗছতে পারেনি। ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আধাডজন খুবই ভালো, দেড় ডজন বেশ ভালো এবং আরও ২ ডজন চেষ্টা সত্ত্বেও নানা বিষয়ে দুর্বল। বাকি দশ-বারোজন হচ্ছে যারা নানা সময়ে ইচ্ছাকৃত ও গুরুতর অপরাধ করছে। তাদের সবার মূল্যায়ন বা ব্যবস্থা এক হতে পারে না। অথচ কেবল স্থায়ী ক্যাম্পাসের ইস্যুতেই প্রায় পুরো গোষ্ঠীর ওপর ভর্তি বন্ধসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
এখানে প্রয়োজন ছিল বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমাত্রিক মাপকাঠিতে একটি যথাযথ শ্রেণীভেদ। প্রয়াত আসাদ সাহেবের সময়ও ইউজিসি এই ধরনের একটি উদ্যোগ নেয়। গত চার বছরে এ ধরনের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। অথচ অল্প ক'জনের অপরাধে বারবার গোটা খাতের দোষারোপ করা হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসকে মান নির্ণয়ের একমাত্র ইস্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে নতুন আইনে সাত এবং অপারগতায় আরও পাঁচ মোট ১২ বছর সময় দেওয়া আছে। বিদ্যমান ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮টির বয়সই কিন্তু ১২ বছরের কম। এরপর যে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত ক্যাম্পাস নির্মাণে সার্থক হয়েছে তাদের অধিকাংশই ১২-১৮ বছর সময় নিয়েছে। অতএব, কোনো যুক্তিতেই ১২ বছরের কম বয়সী প্রতিষ্ঠানের ওপর কেবল এই একটি ইস্যুতে চড়াও হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। অথচ এই একটি ইস্যুর জোরে ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সেপ্টেম্বরের পর থেকে নতুন ছাত্র ভর্তি বন্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এটি ঘটলে তাদের ক্যাম্পাস নির্মাণের উদ্যোগ ব্যর্থ তো হবেই, তাদের অস্তিত্বও হুমকিতে পড়বে। এ ছাড়াও তাদের বর্তমান ক্যাম্পাসের সম্প্রসারণ ও নতুন বিভাগ খোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এতেও তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
মূলত এ ধরনের একটা ঢালাও নীতির কারণে একটি উদীয়মান খাতের অস্তিত্বই আজ নানা অনিশ্চয়তায় ভুগছে। কিন্তু জাতীয় জীবনে এ খাত যে অবদান রাখছে তার সঠিক আলোকে এ অবস্থা কাম্য নয়। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য সম্প্রতি এ খাত সম্পর্কে আরও সহনশীল ও যুক্তিবাদী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন; কিন্তু এখানে গঠনমূলক পদক্ষেপ আরও স্পষ্ট করে উচ্চারিত হওয়া দরকার। এদিকে ইউজিসিতেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে। ইউজিসির নতুন চেয়ারম্যান এ দেশের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ এবং তার আধুনিক মনমানসিকতার জন্য সমাদৃত। জাতীয় স্বার্থেই সবাই আশা করবে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি অনর্থক বিরোধের দীর্ঘ সংস্কৃতি থেকে সরে এসে তারা সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার একটি নতুন যুগ উন্মোচন করবেন।
মামুনুর রশীদ : প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বিগত কয়েক বছর ধরে এটাও লক্ষ্য করছি যে, সাবেক ইউজিসিপ্রধান প্রায়ই বলে থাকেন, 'দু'একটি ছাড়া কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই মান ভালো নয়। একদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে এত অভিযোগ, অন্যদিকে প্রতি বছর তাদের ছাত্রসংখ্যা বাড়তে বাড়তে এত দিনে দু'লাখে পেঁৗছেছে, অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। এ বৈপরীত্য অনেক সময় আমার মনে খটকা তৈরি করলেও ব্যাপারটা কখনও তলিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করার সুবাদে এ খাত সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো মিডিয়া সূত্রে এ খাত সম্পর্কে যে ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা আদৌ গোটা খাতটির জন্য প্রযোজ্য নয়।
কেবল দুর্বলতম অংশের অনিয়ম বা ব্যর্থতা দিয়ে একটা গোটা খাতকে মাপলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই-বা দাঁড়াবে কোথায়? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় অঙ্গনেই শিক্ষার্থীদের নিজের মনে করি এবং তাদের স্বার্থে উভয়ের উন্নয়ন করাই আমাদের সবার দায়িত্ব বলে মনে করি। এখানে উচ্চশিক্ষার কোনো একটি অংশকে নিজের মনে করে অন্য পক্ষকে অশ্রদ্ধা বা অবহেলা করার কোনো যুক্তি দেখি না। অথচ গত কয়েক বছর ধরে যেন অনেকটা সে ধরনের মনোভাবকেই কেউ কেউ প্ররোচিত করতে চেয়েছেন। বর্তমান বৈশ্বিক যুগের বাস্তবতা হলো উচ্চশিক্ষায় পাবলিক খাতের পাশাপাশি একটি সবল ও সুঠাম বেসরকারি খাতও গড়ে তুলতে হবে। তবে এটা করতে গেলে চাই যথাযথ নীতিমালা। সঠিক নীতির জন্য আগে চাই খাতটি সম্পর্কে সৎ ও যথাযথ মূল্যায়ন।
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে অন্তত ২০ হাজার গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে ৪ বছরে সরকারের খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। তাহলে পাবলিক খাত থেকে এ ২০ হাজার গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে সরকারের বছরে খরচ হতো প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। আবার তারা বিদেশে পড়তে গেলে খরচের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হতো। ফলে দেশ হারাত প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। দেশ কোনো সরকারি খরচ ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির ক্রমবিকাশে অপরিহার্য এ সহযোগিতা পাচ্ছে। এককথায় সম্পূর্ণ নিজ খরচে ও চেষ্টায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, যার যথাযথ মূল্যায়ন তারা পাচ্ছে না।
গত কয়েক বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কিছু ব্যক্তিকে বহুবার শুধু এ খাতের ব্যর্থতাই তুলে ধরতে দেখা গেছে। সেই ব্যর্থতা নির্ণয়ের মানদণ্ডই-বা কতটা যথাযথ ছিল তা নিয়েও আছে অনেক প্রশ্ন। পাশাপাশি তাদের অর্জনের তেমন কোনো স্বীকৃতিই চোখে পড়েনি। এ খাত সম্পর্কে যারা এতটুকু ধারণা রাখেন তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক মূল্যায়নের সঙ্গে এ খাতের বাস্তবতার যে ফারাক তাতে অবাক না হয়ে পারবেন না। মুখে মুখেই এখন অন্তত আধাডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি আছে, যাদের মান সবাই খুব ভালো বলে জানেন। এগুলোর গ্র্যাজুয়েটরা হামেশাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চাকরি বাজারে টেক্কা দিয়ে টিকে যাচ্ছে। এর বাইরেও ডজনখানেক উঠতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের মানও সব বিচারে সন্তোষজনক। মোট ৫৩টির মধ্যে বেশ কয়েকটির মান প্রশ্নবোধক হতে পারে; কিন্তু যেখানে অন্তত দেড়-দুই ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সন্তোষজনক সেখানে 'দু'একটি' ছাড়া কোনোটি ভালো নয়_ এ জাতীয় মন্তব্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি সহায়তা ছাড়া সম্পূর্ণ নিজস্ব বিনিয়োগ ও ছাত্র ফি থেকে সঞ্চিত পুঁজির পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের অর্জনগুলো সম্ভব করেছে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় যাদের এখনও স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি হয়নি, তারাও অধিকাংশ নিজস্ব ভবনে বা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজেই ব্যবহৃত পূর্ণ ভবনে অবস্থিত। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এগুলোর অবকাঠামো বরং অনেক আধুনিক। তদুপরি এখানে নিয়মিত ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয়, সময়মতো ফল প্রকাশ হয় এবং ছাত্রছাত্রীরাও সঠিক সময়ে পড়াশোনা শেষ করে বের হয়ে যায়। শিক্ষকরাও নিয়মিত ও সম্মানজনক বেতন পান। তাদের গ্র্যাজুয়েটরা নানা এক্সট্রা/কো-কারিকুলাম একটিভিটিসের কল্যাণে বেশি চৌকস হয়ে বের হয়। আবার ইংরেজি ও আইটি দক্ষতায় বিশেষ নজর দেওয়াতেও তাদের চাকরির উপযোগিতা বাড়ে। যে খাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এত সব উপকার পাচ্ছে তাদের কেবল একটা ইস্যুর জোরে 'অবৈধ' আখ্যা দেওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেকের যে ব্যাপক ব্যর্থতা আছে সেটা কেউ অস্বীকার করে না; কিন্তু তাদের ব্যর্থতাই এ খাতের একমাত্র বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্র নয়। তাদের পাশাপাশি ভালোদের অর্জনটাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। আবার খারাপদেরও রকমফের আছে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আইন ভঙ্গ করছে। মুনাফার লোভে অনুমোদন ছাড়া আউটার ক্যাম্পাস খুলছে ও সার্টিফিকেট বিক্রি করছে। আবার অনেকে ইচ্ছা সত্ত্বেও পুঁজির অভাবে কৌশলগত বা অন্য কোনো দুর্বলতার কারণে আকাঙ্ক্ষিত মানে পেঁৗছতে পারেনি। ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আধাডজন খুবই ভালো, দেড় ডজন বেশ ভালো এবং আরও ২ ডজন চেষ্টা সত্ত্বেও নানা বিষয়ে দুর্বল। বাকি দশ-বারোজন হচ্ছে যারা নানা সময়ে ইচ্ছাকৃত ও গুরুতর অপরাধ করছে। তাদের সবার মূল্যায়ন বা ব্যবস্থা এক হতে পারে না। অথচ কেবল স্থায়ী ক্যাম্পাসের ইস্যুতেই প্রায় পুরো গোষ্ঠীর ওপর ভর্তি বন্ধসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
এখানে প্রয়োজন ছিল বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমাত্রিক মাপকাঠিতে একটি যথাযথ শ্রেণীভেদ। প্রয়াত আসাদ সাহেবের সময়ও ইউজিসি এই ধরনের একটি উদ্যোগ নেয়। গত চার বছরে এ ধরনের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। অথচ অল্প ক'জনের অপরাধে বারবার গোটা খাতের দোষারোপ করা হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসকে মান নির্ণয়ের একমাত্র ইস্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে নতুন আইনে সাত এবং অপারগতায় আরও পাঁচ মোট ১২ বছর সময় দেওয়া আছে। বিদ্যমান ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮টির বয়সই কিন্তু ১২ বছরের কম। এরপর যে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত ক্যাম্পাস নির্মাণে সার্থক হয়েছে তাদের অধিকাংশই ১২-১৮ বছর সময় নিয়েছে। অতএব, কোনো যুক্তিতেই ১২ বছরের কম বয়সী প্রতিষ্ঠানের ওপর কেবল এই একটি ইস্যুতে চড়াও হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। অথচ এই একটি ইস্যুর জোরে ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সেপ্টেম্বরের পর থেকে নতুন ছাত্র ভর্তি বন্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এটি ঘটলে তাদের ক্যাম্পাস নির্মাণের উদ্যোগ ব্যর্থ তো হবেই, তাদের অস্তিত্বও হুমকিতে পড়বে। এ ছাড়াও তাদের বর্তমান ক্যাম্পাসের সম্প্রসারণ ও নতুন বিভাগ খোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এতেও তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
মূলত এ ধরনের একটা ঢালাও নীতির কারণে একটি উদীয়মান খাতের অস্তিত্বই আজ নানা অনিশ্চয়তায় ভুগছে। কিন্তু জাতীয় জীবনে এ খাত যে অবদান রাখছে তার সঠিক আলোকে এ অবস্থা কাম্য নয়। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য সম্প্রতি এ খাত সম্পর্কে আরও সহনশীল ও যুক্তিবাদী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন; কিন্তু এখানে গঠনমূলক পদক্ষেপ আরও স্পষ্ট করে উচ্চারিত হওয়া দরকার। এদিকে ইউজিসিতেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে। ইউজিসির নতুন চেয়ারম্যান এ দেশের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ এবং তার আধুনিক মনমানসিকতার জন্য সমাদৃত। জাতীয় স্বার্থেই সবাই আশা করবে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি অনর্থক বিরোধের দীর্ঘ সংস্কৃতি থেকে সরে এসে তারা সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার একটি নতুন যুগ উন্মোচন করবেন।
মামুনুর রশীদ : প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments