কালান্তরের কড়চা-আমার এবারের বঙ্গদর্শন : ভূমিকা by আবদুল গাফ্ফর চৌধুরী
পুরো একটা মাস কাটিয়ে এলাম জন্মভূমি বাংলাদেশে। ১৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে ঢাকায় রওনা হয়েছি। ফিরে এসেছি ২০ মার্চ রবিবার। এবার দেশে যাওয়া হতো না যদি অনুজপ্রতিম সাবেক ব্যুরোক্র্যাট খোন্দকার রাশেদুল হক (নবা) জোর-জবরদস্তি না খাটাতেন।
পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নিয়ে তিনি এখন ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট। একটানা তিন-তিনবার এই পদে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব এবং কৃতিত্ব দুটোই রাশেদুল হকের। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েও মানুষ যে সক্রিয় ও জনপ্রিয় থাকতে পারে রাশেদুল হক তার প্রমাণ। তাঁর ডাক নাম নবা। এই নামে তাঁকে না চেনে ঢাকায় এমন মানুষের সংখ্যা কম।
এই নবা ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়াতেই আমাকে জানিয়েছিলেন, ঢাকায় অফিসার্স ক্লাব এবার ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একটা সাড়ম্বর আলোচনা সভা করবে। তাতে প্রধান আলোচক আমি। সুতরাং তাদের অতিথি হয়ে ঢাকায় যেতেই হবে। আমি তাঁর আমন্ত্রণে রাজি হয়েছিলাম। ফলে এবার আমার বঙ্গদর্শন তথা জন্মভূমি দর্শনের সুযোগ ঘটে।
নামে আলোচনা সভা। কিন্তু মঞ্চে উঠে চারদিক তাকিয়ে দেখি বিশাল জনসভার মতো। দলবেঁধে সরকরি অফিসাররা তো এসেছেনই, সেই সঙ্গে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং রাজধানীর এলিট শ্রেণীর একটা বড় অংশের সমাবেশ ঘটেছিল। মনোজ্ঞ মঞ্চসজ্জা এবং আলোচনা সভার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটিও ছিল উন্নতমানের এবং আকর্ষণীয়। সবশেষে নৈশ ভোজ। দেশি সুস্বাদু খাবার। খাবারের টেবিলে পরিচিত এবং অপরিচিত বন্ধু বিশিষ্টজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ ও আলাপ। এমন একটি চমৎকার সন্ধ্যার জন্য মনে মনে অভিনন্দন জানিয়েছি খোন্দকার রাশেদুল হক এবং অফিসার্স ক্লাবের কর্মকর্তা ও সদস্যদের। অনুষ্ঠান শেষে মনে মনেই রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি আওড়েছি_'আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে?'
এবার ঢাকায় দীর্ঘদিন থাকার ইচ্ছে নিয়ে যাইনি, তেমন এনগেজমেন্টও কিছু ছিল না। সুতরাং অফিসার্স ক্লাবের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পরই লন্ডনে ফিরে আসতে পারতাম। কিন্তু এলাম না এক শিল্পপতি বন্ধুর পরামর্শে। তিনি গেটকো (মবঃপড়) গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে এম খালেদ। বাংলাদেশের শিক্ষিত, রুচিশীল ও সৎ শিল্পপতিদের মধ্যে তিনি একজন। পরিচিত হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, তিনি একজন উদার মনের মানুষ। দেশপ্রেমিক এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী। ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত গেটকো লিমিটেডের অফিসে গিয়েছিলাম। কথা প্রসঙ্গে খালেদ সাহেব আমাকে বললেন, 'ঢাকায় যখন এসেছেনই, আর ক'টা দিন থেকে যান। দেশ নিয়ে যখন লেখালেখি করেন, তখন দেশের অবস্থা একটু ভালোভাবে দেখে যাওয়া ভালো। তাতে আপনার লেখা আরো বেশি প্রাণ পাবে।' খালেদ সাহেবের উপদেশ শিরোধার্য করেছি এবং তাতে লাভবান হয়েছি। দেশ সম্পর্কে অনেক অজানা কথাই জেনেছি। বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বেড়েছে এবং এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমার আজকের এই ধারাবাহিক রচনাটির সূচনা।
মাসাধিককালের মধ্যে এবার বেশির ভাগ সময়ই ঢাকায় কাটিয়েছি। মাঝখানে কয়েক দিনের জন্য নিজের জেলা বরিশালে এবং স্বগ্রাম উলনিয়ায় গিয়েছিলাম। উলানিয়া এককালে ছিল একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। এখন মেঘনার ভাঙনে বিপন্ন। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার এই বিরাট জনপদটি নদী গ্রাসে হারিয়ে গেলে লাখ লাখ মানুষ নিরাশ্রয় হবে, জীবন-জীবিকা হারাবে। জনপদটিকে রক্ষায় কিছু একটা করার জন্য সরকারের কাছে ধরনা দিচ্ছে মেহেন্দিগঞ্জের সব দলমতের মানুষ।
এই কিছু একটা করার পথের বড় বাধা ব্যুরোক্রেসির লাল ফিতা। আমি নিজেও এই সমৃদ্ধ ও উন্নত এলাকাটি রক্ষার জন্য সরকারি মহলে দেন-দরবার করেছি। কোনো ফল হবে কি না জানি না। দেশের প্রশাসন চালায় প্রকৃতপক্ষে আমলাতন্ত্র। অনভিজ্ঞ মন্ত্রীরা তাঁদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। মার্ক টোয়েনের গল্পের নায়কের মতো বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র আবার মূক, বধির ও দৃষ্টিহীন। হৃদয় পাষাণবৎ এবং কোনো অনুভূতি সেখানে দাগ কাটে না। বাংলাদেশের প্রশাসনও তাই মন্ত্রীদের অভিজ্ঞতা এবং সচিবদের অযোগ্যতা ও অমানবিকতার যোগফল_অর্থাৎ অচল। এবারের বঙ্গদর্শনেও আমার এই অভিজ্ঞতার রকমফের ঘটেনি।
ঢাকার যে কটা দৈনিকে আমি কলাম লিখি, তার প্রত্যেকটার অফিসে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাতে নতুন ও তরুণ সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, পুরনো সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ইনডিপেনডেন্টের মাহবুবুল আলম, কালের কণ্ঠের আবেদ খান, সমকালের গোলাম সারওয়ার, যুগান্তরের সাইফুল ইসলাম_প্রত্যেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটা ব্যাপারে দেখলাম, সম্পাদকরা একইভাবে উদ্বিগ্ন_তাহলে খাদ্যমূল্য থেকে শুরু করে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস (বিশেষ করে ছাত্র সন্ত্রাস) নিয়ন্ত্রণে সরকারের ক্রমাগত অদক্ষতা এবং ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্কে বিদেশি প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের আশংকা। এ ব্যাপারে সরকার এবং ড. ইউনূস উভয় পক্ষই সমানভাবে কোনো কোনো সম্পাদকের দ্বারা সমালোচিত (এ ব্যাপারে আমার মত পরে ব্যক্ত করব)।
এ প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট কথা এখানে আপাতত বলে রাখতে চাই। ঢাকার সংবাদপত্রের মালিকদের মধ্যে কালের কণ্ঠ গ্রুপের (বসুন্ধরা) শাহ আলমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি ঢাকায় গেলেই তাঁর আমন্ত্রণ পাই এবং সুরম্য অফিসে খাবারের টেবিলেও শরিক হই। এবার তাঁর কালের কণ্ঠ ও অন্যান্য প্রকাশনার অফিস স্থানান্তর নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন। তথাপি ঢাকায় পেঁৗছামাত্রই তাঁর আমন্ত্রণ পেয়েছি।
আমার কাছে শাহ আলম এক অমায়িক মানুষ। বাজারে তাঁর সম্পর্কে যত গসিপ, তার সঙ্গে তাঁর আচরণের কোনো মিল খুঁজে পাই না। তাঁর চরিত্রের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ঢাকার সংবাদপত্রের বেশির ভাগ মালিকানার বাজারে ফেরেশতা খুঁজতে গেলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। শাহ আলমের যে দিকটি আমার ভালো লেগেছে, তা হলো তিনি তাঁর কাগজটিকে নিরপেক্ষতা নামের ভণ্ডামির মুখোশ পরাননি। ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্কেও তাঁর পত্রিকায় 'রাখ রাখ ঢাক ঢাক' ভূমিকা ছিল না এবং নেই।
কালের কণ্ঠ প্রকাশ্যে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা হলো ড. ইউনূসের কার্যকলাপকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমর্থনদানের জন্য এবং সরকারকে একটি বিদেশি চাপের কাছে নতি স্বীকার করানোর লক্ষ্যে একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং ইংরেজি, বাংলা দুটি তথাকথিত নিরপেক্ষ দৈনিকের সমন্বয়ে যে স্বদেশি চক্রান্ত গড়ে উঠেছে, তাকে প্রতিরোধ করা এবং নোবেল লরিয়েটের দেবতার মুখোশটি খুলে ফেলা। এটা করা না হলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও প্রচারণার মুখে সরকারকে আরো বেশি বিব্রত হতে হতো। এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদক আবেদ খানের দৃঢ়তাও আমার ভালো লেগেছে। তিনিও লোকনিন্দার পরোয়া করছেন না।
দৈনিক ইত্তেফাকের বর্তমান মালিক-সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আমন্ত্রণে পত্রিকাটির নতুন অফিস কারওয়ান বাজার ও কাজলায় গিয়েছিলাম। আগেই জানতাম, ইত্তেফাক অফিস আর রামকৃষ্ণ মিশন রোডে নেই। পুরনো ইত্তেফাক ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এবারও গাড়ি থামিয়েছি। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো অতীতের অনেক ছবি ভেসে উঠেছে। এই ভবনটির সামনে রোজ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর গাড়িটি থামাতেন। তারপর হেঁটে ভবনটিতে ঢুকতেন। এই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হককে দেখেছি মানিক মিয়ার সঙ্গে আলাপ করতে। সোহরাওয়ার্দী তখন অসুস্থ। বিদেশে চিকিৎসা চলছে। মানিক মিয়ার কাছ থেকে তাঁরই খোঁজখবর নিচ্ছেন শেরে বাংলা।
এই ভবনে আসতে দেখেছি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী থেকে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ_সাবেক পাকিস্তানের তাবৎ ডান ও বামের বড় বড় নেতার। শহীদ সোহরাওয়ার্দী শুধু পাজামা-পাঞ্জাবি পরে অফিসটিতে ঢুকতেন। কখনো কখনো সঙ্গে শেখ মুজিব। মানিক মিয়ার ব্যবহৃত ইজিচেয়ারটিতে শুয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। রাজনৈতিক আলোচনা চালাতেন।
এই ভবনে বেশি সময় আসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানিক মিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপের জন্য কখনো কখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতেন। আমার ধারণা, বাংলাদেশের ভাগ্য বহুবার নির্ধারিত হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের এই ইত্তেফাক ভবনে। আজ মানিক মিয়া নেই, ইত্তেফাকও এই ভবন ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু ভবনটির ঐতিহাসিকতা মুছে যায়নি। মানিক মিয়ার আমলে ছিল এটি একতলা ভবন। এখন সেই ভবন বহুতল।
এই বহুতল ভবনের কোনো এক ফ্লোরজুড়ে মানিক মিয়া স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলে ভালো হতো। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ইত্তেফাকের নতুন দুটি অফিসেই মানিক মিয়ার ছবি যত্নের সঙ্গে রেখেছেন। মানিক মিয়ার ব্যবহৃত 'ভস্কহল' গাড়িটিও একটু মেরামত করে ইত্তেফাকের কাজলার অফিসে রাখা হয়েছে। এই গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েও অতীতের বহু স্মৃতি মনে পড়েছে। এই গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে আমি বহুবার চড়েছি। এই মহাপুরুষের দুই ছেলের কাছে আমার একান্ত নিবেদন, সম্পত্তি অথবা পত্রিকা ভাগ হয়েছে হোক, মানিক মিয়ার স্মৃতি যেন ভাগ না হয়। দুই ভাই এবং পরিবারের সব সদস্য মিলে যেন মানিক মিয়ার একটি অভিন্ন স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলেন।
আমার এবারের বঙ্গদর্শনে প্রিয়-অপ্রিয় দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই আহরণ করেছি। প্রিয় অভিজ্ঞতার কথাটিই আগে বলি। দীর্ঘকাল পর এবার ঢাকায় একুশের রাতের অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। টেলিভিশনেও দেখেছি। আমাদের সময়ের একুশে আর বর্তমানের একুশের অনেক অমিল। সে কথা পরে আলোচনা করব। এবার একুশের পদকপ্রাপ্তদের নামের তালিকা দেখে খুশি হয়েছি। অনেক পদকপ্রাপ্তই আমার চেনা এবং একুশের রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হওয়ার যোগ্য মানুষ। তাঁদের কারো কারো বহু আগে এই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে তাঁরা যে তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেলেন, সম্মানিত হলেন, এটাই বড় কথা। এ জন্য সরকারও অভিনন্দন লাভের দাবিদার।
এবার একুশের পদক পেয়েছেন আরো কয়েকজনের সঙ্গে সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কালজয়ী ক্যামেরাশিল্পী আমানুল হক। দুজনকেই আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। নূরজাহান বেগমের বাবা প্রয়াত নাসিরউদ্দীন আহমদও আমাদের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতের এক প্রবাদপুরুষ। তাঁর 'সওগাত' পত্রিকায় কাজ করার সময় নূরজাহান আপার (তাঁকে আমি আপা ডাকি) সঙ্গে একই অফিসে কাজ করেছি, তাঁর সানি্নধ্য পেয়েছি। একসময় পুরনো ঢাকার শরৎ গুপ্ত রোডে আমরা প্রায় পাশাপাশি বাসায় থাকতাম। নূরজাহান আপা এখনো সেই বাসাতেই আছেন। একুশের পদক পেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে হুইলচেয়ারে ওঠার সময় (তিনি এখন খুবই অসুস্থ) তিনি চিৎকার করে উঠেছেন, 'গাফ্ফার, তুমি দেশে এসেছ! দেশেই থাকো না কেন?' পরম আবেগে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। তাঁর মেয়েরা, মেয়েজামাই, নাতি-নাতনিরাও আমাকে পরম আত্মীয়ের মতো ঘিরে ফেলেছেন। নারী জাগরণ ও নারী সাংবাদিকতায় নূরজাহান বেগমের অবদান অসামান্য। তাঁকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের গোটা নারীসমাজকে সম্মানিত করা হলো বলা চলে।
আমানুল হক শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা উপমহাদেশেরই একজন কিংবদন্তিতুল্য ফটোশিল্পী। ক্যামেরাকেও যে ধ্রুপদী শিল্প সৃষ্টির মাধ্যম করে তোলা যায়, শিল্পী আমানুল হক তা প্রমাণ করেছেন। ক্যামেরা হাতে শিল্প সৃষ্টিতে তাঁর অসামান্য নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে সত্যজিৎ রায় তাঁকে একবার তাঁর সহকারী করে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশর সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক দলিল আমানুল হকের ছবি। মুক্ত চিন্তা ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণাকেও যে ক্যামেরার সাহায্যে অমর শিল্পের রূপ দেওয়া যায়, আমানুল হকের ছবি তার প্রমাণ। তাঁর সম্পর্কে একটি গল্প বলি। বানানো গল্প নয়।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের অথবা ষাটের দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমানুল হক তখনই ক্যামেরাশিল্পী হিসেবে দুই বাংলাতেই খ্যাত ও নন্দিত। এই সময় তখনকার এক জাঁদরেল সম্পাদক ও সাহিত্যিক আমানুল হককে জানালেন, কলকাতার ইংরেজি 'স্টেটসম্যান' পত্রিকার সম্পাদক আমানুল হকের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি কয়েকটি ছবি তাঁর পত্রিকায় ছাপানোর জন্য কিনতে চান। আমানুল হক যদি রাজি থাকেন তাহলে ওই সম্পাদক-সাহিত্যিককে কিছু ছবি দিতে পারেন। তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। সুতরাং ছবিগুলো 'স্টেটসম্যান'কে দিয়ে আমানুল হককে ভালো টাকা এনে দিতে পারবেন। আমানুল হক তাঁকে বিশ্বাস করে বেশ কয়েকটি ছবি তাঁর হাতে তুলে দেন।
এর কিছুকাল পর দেখা গেল, ওই ছবিগুলো স্টেটসম্যানে ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু ফটোশিল্পী হিসেবে নাম ছাপা হয়েছে ওই সম্পাদক-সাহিত্যিকের। আরো কিছুকাল পর জানা গেল, ওই সাহিত্যিক আমানুল হকের ছবিগুলো স্টেটসম্যানের কাছে মোটা টাকায় বেচে বিলেতে চলে গেছেন। আমানুল হকের হয়ে আমরা কলকাতায় স্টেটসম্যানকে প্রকৃত ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম। ছবিগুলো যে আমানুল হকের, তা স্বীকার করে স্টেটসম্যান একটা সংশোধনী ছেপেছিল। ওই পর্যন্তই। আমানুল হক আর টাকার মুখ দেখেননি।
এই প্রবাদপুরুষ আমানুল হক এখনো বেঁচে আছেন এবং এবার একুশের পদক পেলেন। তাতে তাঁর অসংখ্য অনুরাগীর মতো আমিও আনন্দে অভিভূত হয়েছি। দীর্ঘকাল ধরে আমরা পরস্পরের বন্ধু, এটা আমার কাছে এক গর্ব ও গৌরবের বিষয়। একুশের পদকদানের অনুষ্ঠানে তিনি নিমিষে আমাকে চিনেছেন এবং জড়িয়ে ধরেছেন। এক মাস ঢাকায় কাটিয়ে যেদিন আবার লন্ডনে রওনা হব, তার আগের দিন দেখি আমার হোটেল কক্ষের টেবিলে দুই প্যাকেট মিষ্টি পাঠিয়েছেন আমানুল হক। সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত মিষ্টি। আমার জন্য আনিয়েছেন আমানুল হক। আমি ডায়াবেটিসে ভুগি। মিষ্টান্ন খাই না। তবু সব দ্বিধা ঝেড়ে আমানুল হকের পাঠানো মিষ্টি খেয়েছি।
(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ২৮ মার্চ, সোমবার, ২০১১
এই নবা ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়াতেই আমাকে জানিয়েছিলেন, ঢাকায় অফিসার্স ক্লাব এবার ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একটা সাড়ম্বর আলোচনা সভা করবে। তাতে প্রধান আলোচক আমি। সুতরাং তাদের অতিথি হয়ে ঢাকায় যেতেই হবে। আমি তাঁর আমন্ত্রণে রাজি হয়েছিলাম। ফলে এবার আমার বঙ্গদর্শন তথা জন্মভূমি দর্শনের সুযোগ ঘটে।
নামে আলোচনা সভা। কিন্তু মঞ্চে উঠে চারদিক তাকিয়ে দেখি বিশাল জনসভার মতো। দলবেঁধে সরকরি অফিসাররা তো এসেছেনই, সেই সঙ্গে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং রাজধানীর এলিট শ্রেণীর একটা বড় অংশের সমাবেশ ঘটেছিল। মনোজ্ঞ মঞ্চসজ্জা এবং আলোচনা সভার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটিও ছিল উন্নতমানের এবং আকর্ষণীয়। সবশেষে নৈশ ভোজ। দেশি সুস্বাদু খাবার। খাবারের টেবিলে পরিচিত এবং অপরিচিত বন্ধু বিশিষ্টজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ ও আলাপ। এমন একটি চমৎকার সন্ধ্যার জন্য মনে মনে অভিনন্দন জানিয়েছি খোন্দকার রাশেদুল হক এবং অফিসার্স ক্লাবের কর্মকর্তা ও সদস্যদের। অনুষ্ঠান শেষে মনে মনেই রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি আওড়েছি_'আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে?'
এবার ঢাকায় দীর্ঘদিন থাকার ইচ্ছে নিয়ে যাইনি, তেমন এনগেজমেন্টও কিছু ছিল না। সুতরাং অফিসার্স ক্লাবের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পরই লন্ডনে ফিরে আসতে পারতাম। কিন্তু এলাম না এক শিল্পপতি বন্ধুর পরামর্শে। তিনি গেটকো (মবঃপড়) গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে এম খালেদ। বাংলাদেশের শিক্ষিত, রুচিশীল ও সৎ শিল্পপতিদের মধ্যে তিনি একজন। পরিচিত হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, তিনি একজন উদার মনের মানুষ। দেশপ্রেমিক এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী। ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত গেটকো লিমিটেডের অফিসে গিয়েছিলাম। কথা প্রসঙ্গে খালেদ সাহেব আমাকে বললেন, 'ঢাকায় যখন এসেছেনই, আর ক'টা দিন থেকে যান। দেশ নিয়ে যখন লেখালেখি করেন, তখন দেশের অবস্থা একটু ভালোভাবে দেখে যাওয়া ভালো। তাতে আপনার লেখা আরো বেশি প্রাণ পাবে।' খালেদ সাহেবের উপদেশ শিরোধার্য করেছি এবং তাতে লাভবান হয়েছি। দেশ সম্পর্কে অনেক অজানা কথাই জেনেছি। বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বেড়েছে এবং এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমার আজকের এই ধারাবাহিক রচনাটির সূচনা।
মাসাধিককালের মধ্যে এবার বেশির ভাগ সময়ই ঢাকায় কাটিয়েছি। মাঝখানে কয়েক দিনের জন্য নিজের জেলা বরিশালে এবং স্বগ্রাম উলনিয়ায় গিয়েছিলাম। উলানিয়া এককালে ছিল একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। এখন মেঘনার ভাঙনে বিপন্ন। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার এই বিরাট জনপদটি নদী গ্রাসে হারিয়ে গেলে লাখ লাখ মানুষ নিরাশ্রয় হবে, জীবন-জীবিকা হারাবে। জনপদটিকে রক্ষায় কিছু একটা করার জন্য সরকারের কাছে ধরনা দিচ্ছে মেহেন্দিগঞ্জের সব দলমতের মানুষ।
এই কিছু একটা করার পথের বড় বাধা ব্যুরোক্রেসির লাল ফিতা। আমি নিজেও এই সমৃদ্ধ ও উন্নত এলাকাটি রক্ষার জন্য সরকারি মহলে দেন-দরবার করেছি। কোনো ফল হবে কি না জানি না। দেশের প্রশাসন চালায় প্রকৃতপক্ষে আমলাতন্ত্র। অনভিজ্ঞ মন্ত্রীরা তাঁদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। মার্ক টোয়েনের গল্পের নায়কের মতো বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র আবার মূক, বধির ও দৃষ্টিহীন। হৃদয় পাষাণবৎ এবং কোনো অনুভূতি সেখানে দাগ কাটে না। বাংলাদেশের প্রশাসনও তাই মন্ত্রীদের অভিজ্ঞতা এবং সচিবদের অযোগ্যতা ও অমানবিকতার যোগফল_অর্থাৎ অচল। এবারের বঙ্গদর্শনেও আমার এই অভিজ্ঞতার রকমফের ঘটেনি।
ঢাকার যে কটা দৈনিকে আমি কলাম লিখি, তার প্রত্যেকটার অফিসে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাতে নতুন ও তরুণ সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, পুরনো সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ইনডিপেনডেন্টের মাহবুবুল আলম, কালের কণ্ঠের আবেদ খান, সমকালের গোলাম সারওয়ার, যুগান্তরের সাইফুল ইসলাম_প্রত্যেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটা ব্যাপারে দেখলাম, সম্পাদকরা একইভাবে উদ্বিগ্ন_তাহলে খাদ্যমূল্য থেকে শুরু করে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস (বিশেষ করে ছাত্র সন্ত্রাস) নিয়ন্ত্রণে সরকারের ক্রমাগত অদক্ষতা এবং ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্কে বিদেশি প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের আশংকা। এ ব্যাপারে সরকার এবং ড. ইউনূস উভয় পক্ষই সমানভাবে কোনো কোনো সম্পাদকের দ্বারা সমালোচিত (এ ব্যাপারে আমার মত পরে ব্যক্ত করব)।
এ প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট কথা এখানে আপাতত বলে রাখতে চাই। ঢাকার সংবাদপত্রের মালিকদের মধ্যে কালের কণ্ঠ গ্রুপের (বসুন্ধরা) শাহ আলমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি ঢাকায় গেলেই তাঁর আমন্ত্রণ পাই এবং সুরম্য অফিসে খাবারের টেবিলেও শরিক হই। এবার তাঁর কালের কণ্ঠ ও অন্যান্য প্রকাশনার অফিস স্থানান্তর নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন। তথাপি ঢাকায় পেঁৗছামাত্রই তাঁর আমন্ত্রণ পেয়েছি।
আমার কাছে শাহ আলম এক অমায়িক মানুষ। বাজারে তাঁর সম্পর্কে যত গসিপ, তার সঙ্গে তাঁর আচরণের কোনো মিল খুঁজে পাই না। তাঁর চরিত্রের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ঢাকার সংবাদপত্রের বেশির ভাগ মালিকানার বাজারে ফেরেশতা খুঁজতে গেলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। শাহ আলমের যে দিকটি আমার ভালো লেগেছে, তা হলো তিনি তাঁর কাগজটিকে নিরপেক্ষতা নামের ভণ্ডামির মুখোশ পরাননি। ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্কেও তাঁর পত্রিকায় 'রাখ রাখ ঢাক ঢাক' ভূমিকা ছিল না এবং নেই।
কালের কণ্ঠ প্রকাশ্যে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা হলো ড. ইউনূসের কার্যকলাপকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমর্থনদানের জন্য এবং সরকারকে একটি বিদেশি চাপের কাছে নতি স্বীকার করানোর লক্ষ্যে একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং ইংরেজি, বাংলা দুটি তথাকথিত নিরপেক্ষ দৈনিকের সমন্বয়ে যে স্বদেশি চক্রান্ত গড়ে উঠেছে, তাকে প্রতিরোধ করা এবং নোবেল লরিয়েটের দেবতার মুখোশটি খুলে ফেলা। এটা করা না হলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও প্রচারণার মুখে সরকারকে আরো বেশি বিব্রত হতে হতো। এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদক আবেদ খানের দৃঢ়তাও আমার ভালো লেগেছে। তিনিও লোকনিন্দার পরোয়া করছেন না।
দৈনিক ইত্তেফাকের বর্তমান মালিক-সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর আমন্ত্রণে পত্রিকাটির নতুন অফিস কারওয়ান বাজার ও কাজলায় গিয়েছিলাম। আগেই জানতাম, ইত্তেফাক অফিস আর রামকৃষ্ণ মিশন রোডে নেই। পুরনো ইত্তেফাক ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এবারও গাড়ি থামিয়েছি। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো অতীতের অনেক ছবি ভেসে উঠেছে। এই ভবনটির সামনে রোজ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর গাড়িটি থামাতেন। তারপর হেঁটে ভবনটিতে ঢুকতেন। এই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হককে দেখেছি মানিক মিয়ার সঙ্গে আলাপ করতে। সোহরাওয়ার্দী তখন অসুস্থ। বিদেশে চিকিৎসা চলছে। মানিক মিয়ার কাছ থেকে তাঁরই খোঁজখবর নিচ্ছেন শেরে বাংলা।
এই ভবনে আসতে দেখেছি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী থেকে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ_সাবেক পাকিস্তানের তাবৎ ডান ও বামের বড় বড় নেতার। শহীদ সোহরাওয়ার্দী শুধু পাজামা-পাঞ্জাবি পরে অফিসটিতে ঢুকতেন। কখনো কখনো সঙ্গে শেখ মুজিব। মানিক মিয়ার ব্যবহৃত ইজিচেয়ারটিতে শুয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। রাজনৈতিক আলোচনা চালাতেন।
এই ভবনে বেশি সময় আসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানিক মিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপের জন্য কখনো কখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতেন। আমার ধারণা, বাংলাদেশের ভাগ্য বহুবার নির্ধারিত হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের এই ইত্তেফাক ভবনে। আজ মানিক মিয়া নেই, ইত্তেফাকও এই ভবন ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু ভবনটির ঐতিহাসিকতা মুছে যায়নি। মানিক মিয়ার আমলে ছিল এটি একতলা ভবন। এখন সেই ভবন বহুতল।
এই বহুতল ভবনের কোনো এক ফ্লোরজুড়ে মানিক মিয়া স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলে ভালো হতো। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ইত্তেফাকের নতুন দুটি অফিসেই মানিক মিয়ার ছবি যত্নের সঙ্গে রেখেছেন। মানিক মিয়ার ব্যবহৃত 'ভস্কহল' গাড়িটিও একটু মেরামত করে ইত্তেফাকের কাজলার অফিসে রাখা হয়েছে। এই গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েও অতীতের বহু স্মৃতি মনে পড়েছে। এই গাড়িতে মানিক মিয়ার সঙ্গে আমি বহুবার চড়েছি। এই মহাপুরুষের দুই ছেলের কাছে আমার একান্ত নিবেদন, সম্পত্তি অথবা পত্রিকা ভাগ হয়েছে হোক, মানিক মিয়ার স্মৃতি যেন ভাগ না হয়। দুই ভাই এবং পরিবারের সব সদস্য মিলে যেন মানিক মিয়ার একটি অভিন্ন স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলেন।
আমার এবারের বঙ্গদর্শনে প্রিয়-অপ্রিয় দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই আহরণ করেছি। প্রিয় অভিজ্ঞতার কথাটিই আগে বলি। দীর্ঘকাল পর এবার ঢাকায় একুশের রাতের অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। টেলিভিশনেও দেখেছি। আমাদের সময়ের একুশে আর বর্তমানের একুশের অনেক অমিল। সে কথা পরে আলোচনা করব। এবার একুশের পদকপ্রাপ্তদের নামের তালিকা দেখে খুশি হয়েছি। অনেক পদকপ্রাপ্তই আমার চেনা এবং একুশের রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হওয়ার যোগ্য মানুষ। তাঁদের কারো কারো বহু আগে এই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে তাঁরা যে তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেলেন, সম্মানিত হলেন, এটাই বড় কথা। এ জন্য সরকারও অভিনন্দন লাভের দাবিদার।
এবার একুশের পদক পেয়েছেন আরো কয়েকজনের সঙ্গে সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কালজয়ী ক্যামেরাশিল্পী আমানুল হক। দুজনকেই আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। নূরজাহান বেগমের বাবা প্রয়াত নাসিরউদ্দীন আহমদও আমাদের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতের এক প্রবাদপুরুষ। তাঁর 'সওগাত' পত্রিকায় কাজ করার সময় নূরজাহান আপার (তাঁকে আমি আপা ডাকি) সঙ্গে একই অফিসে কাজ করেছি, তাঁর সানি্নধ্য পেয়েছি। একসময় পুরনো ঢাকার শরৎ গুপ্ত রোডে আমরা প্রায় পাশাপাশি বাসায় থাকতাম। নূরজাহান আপা এখনো সেই বাসাতেই আছেন। একুশের পদক পেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে হুইলচেয়ারে ওঠার সময় (তিনি এখন খুবই অসুস্থ) তিনি চিৎকার করে উঠেছেন, 'গাফ্ফার, তুমি দেশে এসেছ! দেশেই থাকো না কেন?' পরম আবেগে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। তাঁর মেয়েরা, মেয়েজামাই, নাতি-নাতনিরাও আমাকে পরম আত্মীয়ের মতো ঘিরে ফেলেছেন। নারী জাগরণ ও নারী সাংবাদিকতায় নূরজাহান বেগমের অবদান অসামান্য। তাঁকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের গোটা নারীসমাজকে সম্মানিত করা হলো বলা চলে।
আমানুল হক শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা উপমহাদেশেরই একজন কিংবদন্তিতুল্য ফটোশিল্পী। ক্যামেরাকেও যে ধ্রুপদী শিল্প সৃষ্টির মাধ্যম করে তোলা যায়, শিল্পী আমানুল হক তা প্রমাণ করেছেন। ক্যামেরা হাতে শিল্প সৃষ্টিতে তাঁর অসামান্য নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে সত্যজিৎ রায় তাঁকে একবার তাঁর সহকারী করে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশর সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক দলিল আমানুল হকের ছবি। মুক্ত চিন্তা ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণাকেও যে ক্যামেরার সাহায্যে অমর শিল্পের রূপ দেওয়া যায়, আমানুল হকের ছবি তার প্রমাণ। তাঁর সম্পর্কে একটি গল্প বলি। বানানো গল্প নয়।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের অথবা ষাটের দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমানুল হক তখনই ক্যামেরাশিল্পী হিসেবে দুই বাংলাতেই খ্যাত ও নন্দিত। এই সময় তখনকার এক জাঁদরেল সম্পাদক ও সাহিত্যিক আমানুল হককে জানালেন, কলকাতার ইংরেজি 'স্টেটসম্যান' পত্রিকার সম্পাদক আমানুল হকের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি কয়েকটি ছবি তাঁর পত্রিকায় ছাপানোর জন্য কিনতে চান। আমানুল হক যদি রাজি থাকেন তাহলে ওই সম্পাদক-সাহিত্যিককে কিছু ছবি দিতে পারেন। তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। সুতরাং ছবিগুলো 'স্টেটসম্যান'কে দিয়ে আমানুল হককে ভালো টাকা এনে দিতে পারবেন। আমানুল হক তাঁকে বিশ্বাস করে বেশ কয়েকটি ছবি তাঁর হাতে তুলে দেন।
এর কিছুকাল পর দেখা গেল, ওই ছবিগুলো স্টেটসম্যানে ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু ফটোশিল্পী হিসেবে নাম ছাপা হয়েছে ওই সম্পাদক-সাহিত্যিকের। আরো কিছুকাল পর জানা গেল, ওই সাহিত্যিক আমানুল হকের ছবিগুলো স্টেটসম্যানের কাছে মোটা টাকায় বেচে বিলেতে চলে গেছেন। আমানুল হকের হয়ে আমরা কলকাতায় স্টেটসম্যানকে প্রকৃত ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম। ছবিগুলো যে আমানুল হকের, তা স্বীকার করে স্টেটসম্যান একটা সংশোধনী ছেপেছিল। ওই পর্যন্তই। আমানুল হক আর টাকার মুখ দেখেননি।
এই প্রবাদপুরুষ আমানুল হক এখনো বেঁচে আছেন এবং এবার একুশের পদক পেলেন। তাতে তাঁর অসংখ্য অনুরাগীর মতো আমিও আনন্দে অভিভূত হয়েছি। দীর্ঘকাল ধরে আমরা পরস্পরের বন্ধু, এটা আমার কাছে এক গর্ব ও গৌরবের বিষয়। একুশের পদকদানের অনুষ্ঠানে তিনি নিমিষে আমাকে চিনেছেন এবং জড়িয়ে ধরেছেন। এক মাস ঢাকায় কাটিয়ে যেদিন আবার লন্ডনে রওনা হব, তার আগের দিন দেখি আমার হোটেল কক্ষের টেবিলে দুই প্যাকেট মিষ্টি পাঠিয়েছেন আমানুল হক। সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত মিষ্টি। আমার জন্য আনিয়েছেন আমানুল হক। আমি ডায়াবেটিসে ভুগি। মিষ্টান্ন খাই না। তবু সব দ্বিধা ঝেড়ে আমানুল হকের পাঠানো মিষ্টি খেয়েছি।
(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ২৮ মার্চ, সোমবার, ২০১১
No comments