বাঘা তেঁতুল-বখাটের বাবা ও বন্ধুবান্ধব by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বঙ্গীয় বখাটেদের বল বাড়ছে। আগে তাদের সহযোগী ছিল তাদের বন্ধুবান্ধব। এখন তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তাদের বাবারা। আজ বাংলায় বখাটেরা বাপ-বেটায় মিলে বেশ বলীয়ান একটি সম্প্রদায়। পাকিস্তানে তালেবান জঙ্গি এবং ভারতের মাওবাদী গেরিলাদের মতো এখন তারা অপ্রতিরোধ্য।
কয়েক বছর যাবত বখাটেদের বদৌলতে স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়েছে হাজার হাজার কিশোরী ও সদ্যযুবতীর। এবার মেয়েদের বিয়েটা পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার জো! বখাটেদের কারণে বহু মেধাবী মেয়ে কোনো দিনও এসএসসি পাস করতে পারবে না। পড়াশোনার পাট তাদের চুকে গেছে। তারা আজ গৃহবন্দী। এখন মা-বাবা তাদের বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলে বাঁচেন। কিন্তু সে পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বখাটেরা তাদের তৎপরতায় যোগ করেছে নতুন উপাদান। বিয়ের আসরে কনের বাড়িতে হামলা। শুরু হয়েছে কনেপক্ষের মানুষ ও বরযাত্রীদের পোলাও-বিরিয়ানি খাওয়ার বদলে বেদম মারধর খাওয়া। প্রশাসনের মৌন প্রশ্রয়ে বখাটেদের বখাটেপনার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগে হতো বিয়েবাড়িতে ধুমধাম। এখনো ধুমধামই হচ্ছে, তবে তা খুশির নয়, বিষাদের। চাপাতি ও রামদাবাদীদের ধুমধাম প্রতিদিন শিক্ষাঙ্গনে হচ্ছে। ওটা দ্বিমুখী। বখাটেরা বিয়েবাড়িতে যা করছে, তা ত্রিমুখী—কনেপক্ষ, বরপক্ষ ও বাপ-বেটা মিলে বখাটেপক্ষ।
এখন বাংলাদেশে যেকোনো মেয়ের বিয়ে বখাটেরা ও তাদের বাবারা ভণ্ডুল করে দেওয়ার হিম্মত রাখে। গত কিছুদিনে তেমন অঘটন অনেক ঘটেছে। এখন বরের মাথায় মখমলের পাগড়ি নয়, লোহার শিরস্ত্রাণ এবং শেরোয়ানির বদলে বর্ম বা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাতেও যদি তারা নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে দূর থেকে মুঠোফোনে বিয়ের শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতাটুকু সারতে পারে।
বখাটেপনা খুবই সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপার। গত দু-এক মাসে দেশের তিনটি প্রধান ধর্মের তিনটি মেয়ের বিয়ে বখাটেদের বলপ্রয়োগে বানচাল হয়ে গেছে। এখন থেকে কোনো মৌলবি বা পুরোহিত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোথাও বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে যাবেন না। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সোজা হাসপাতালে যাওয়ার বাসনা খুব কম নিকাহ রেজিস্ট্রার ও পুরোহিতেরই থাকার কথা।
ঘটনাটি ঘটেছে আগৈলঝাড়ায়। এক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান বানচাল করতে বখাটেদের ‘হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষে একজন নিহত ও মহিলাসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। এ সময় একটি বাড়ি ভাঙচুরসহ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে বিয়ের অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়।’ [সমকাল/প্রথম আলো]
নিহত ব্যক্তি বখাটের বাবা। বাংলাদেশে নানা শ্রেণী-পেশার শহীদের সংখ্যা অগণিত। বখাটের বাবা হিসেবে তিনিই সম্ভবত প্রথম শহীদ।
কাগজের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, তা এ রকম—মেয়েটিকে তার মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার পথে ‘আওয়ামী লীগের সদস্য জাকির সরদারের বখাটে ছেলে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। উত্ত্যক্ত করা অব্যাহত থাকায়’ তার বাবা ‘মেয়ের মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেন।’ গাজীপুর জেলার এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়। কনে তুলে নিতে শুক্রবার ৫০ জন বরযাত্রী আসার কথা ছিল। খবর পেয়ে বখাটে ‘তার সাত-আট সহযোগী নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধের হুমকি দেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বখাটেরা কনের বাড়ির প্রবেশপথে সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে পিকনিকের আয়োজন করে। কনেপক্ষ প্রতিবাদ করলে উভয়ের মধ্যে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে বখাটেরা কনের বাবাকে মারধর করে।’ মারধরে বখাটের বাবাও শামিল হন। কনের বাড়ি লুটপাট হয়। দুই পক্ষেরই আহত ব্যক্তিদের ঠাঁই হয় হাসপাতালে। সেখানে বখাটের বাবা ইহলোক ত্যাগ করেন। যেকোনো মৃত্যুই মর্মান্তিক। তা সে বখাটের বাবাই হোক, বা কোনো মহতের জন্মদাতাই হোক।
হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতো। তা হয়নি, কারণ, ৫৫ জন বরযাত্রীর বাস যখন মাওয়া ঘাটে, তখন তারা মুঠোফোনে খবর পান বরের প্রতিদ্বন্দ্বী কনের বাড়ির সামনে সৈন্যসামন্ত নিয়ে উপস্থিত। বরযাত্রী ছিল নিরস্ত্র। সুতরাং অগ্রসর হওয়া নিরাপদ নয়। বরের কথায়, ‘আমরা কনের বাড়িতে না গিয়ে গাজীপুরে ফিরে যাই।’ ঘটনাটি নিয়ে থানায় মামলা হয়েছে।
এখানে কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এক. বখাটে ও তার বাবা ক্ষমতাসীন দলের মানুষ। দুই. ছেলেটি হয়তো খুবই ভালো—শান্ত-সজ্জন, কিন্তু সংগীতপ্রিয়। তবে গান সে ঘরে বসে শুনবে না, যাকে সে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে, তার বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে শুনবে। একাও শুনবে না, বন্ধুদের নিয়ে শুনবে। সে গান আস্তেও শুনবে না, যন্ত্রের যত শক্তি আছে, তত শক্তি ব্যবহার করে শুনবে, যাতে ভালোবাসার পাত্রীটি ও তার বাড়ির মানুষের কানের তালা ফেটে যায়। তিন. সংগীতপ্রেমী ও নারীপ্রেমীর বাবা পুত্রের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন কেন? দূর থেকে পুত্রের বাজানো গান শুনলে তাঁকে জীবন দিতে হতো না। অবশ্য বিয়েশাদি, বীরত্বপূর্ণ কাজ ও বিপদে-আপদে পুত্রের পাশে দাঁড়ানো যেকোনো স্নেহশীল পিতারই কর্তব্য।
বখাটেদের এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আজকাল প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে সারা দেশে। বাংলার মাটিতে বখাটে ও তাদের বাবাদের তৎপরতা যদি বন্ধ না করা যায়, তাহলে আগামী ২০২১ সালের আগেই সোনার বাংলার অধিকাংশ বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বখাটেরা তাদের তৎপরতায় যোগ করেছে নতুন উপাদান। বিয়ের আসরে কনের বাড়িতে হামলা। শুরু হয়েছে কনেপক্ষের মানুষ ও বরযাত্রীদের পোলাও-বিরিয়ানি খাওয়ার বদলে বেদম মারধর খাওয়া। প্রশাসনের মৌন প্রশ্রয়ে বখাটেদের বখাটেপনার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগে হতো বিয়েবাড়িতে ধুমধাম। এখনো ধুমধামই হচ্ছে, তবে তা খুশির নয়, বিষাদের। চাপাতি ও রামদাবাদীদের ধুমধাম প্রতিদিন শিক্ষাঙ্গনে হচ্ছে। ওটা দ্বিমুখী। বখাটেরা বিয়েবাড়িতে যা করছে, তা ত্রিমুখী—কনেপক্ষ, বরপক্ষ ও বাপ-বেটা মিলে বখাটেপক্ষ।
এখন বাংলাদেশে যেকোনো মেয়ের বিয়ে বখাটেরা ও তাদের বাবারা ভণ্ডুল করে দেওয়ার হিম্মত রাখে। গত কিছুদিনে তেমন অঘটন অনেক ঘটেছে। এখন বরের মাথায় মখমলের পাগড়ি নয়, লোহার শিরস্ত্রাণ এবং শেরোয়ানির বদলে বর্ম বা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাতেও যদি তারা নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে দূর থেকে মুঠোফোনে বিয়ের শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতাটুকু সারতে পারে।
বখাটেপনা খুবই সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপার। গত দু-এক মাসে দেশের তিনটি প্রধান ধর্মের তিনটি মেয়ের বিয়ে বখাটেদের বলপ্রয়োগে বানচাল হয়ে গেছে। এখন থেকে কোনো মৌলবি বা পুরোহিত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোথাও বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে যাবেন না। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সোজা হাসপাতালে যাওয়ার বাসনা খুব কম নিকাহ রেজিস্ট্রার ও পুরোহিতেরই থাকার কথা।
ঘটনাটি ঘটেছে আগৈলঝাড়ায়। এক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান বানচাল করতে বখাটেদের ‘হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষে একজন নিহত ও মহিলাসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। এ সময় একটি বাড়ি ভাঙচুরসহ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে বিয়ের অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়।’ [সমকাল/প্রথম আলো]
নিহত ব্যক্তি বখাটের বাবা। বাংলাদেশে নানা শ্রেণী-পেশার শহীদের সংখ্যা অগণিত। বখাটের বাবা হিসেবে তিনিই সম্ভবত প্রথম শহীদ।
কাগজের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, তা এ রকম—মেয়েটিকে তার মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার পথে ‘আওয়ামী লীগের সদস্য জাকির সরদারের বখাটে ছেলে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। উত্ত্যক্ত করা অব্যাহত থাকায়’ তার বাবা ‘মেয়ের মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেন।’ গাজীপুর জেলার এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়। কনে তুলে নিতে শুক্রবার ৫০ জন বরযাত্রী আসার কথা ছিল। খবর পেয়ে বখাটে ‘তার সাত-আট সহযোগী নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধের হুমকি দেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বখাটেরা কনের বাড়ির প্রবেশপথে সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে পিকনিকের আয়োজন করে। কনেপক্ষ প্রতিবাদ করলে উভয়ের মধ্যে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে বখাটেরা কনের বাবাকে মারধর করে।’ মারধরে বখাটের বাবাও শামিল হন। কনের বাড়ি লুটপাট হয়। দুই পক্ষেরই আহত ব্যক্তিদের ঠাঁই হয় হাসপাতালে। সেখানে বখাটের বাবা ইহলোক ত্যাগ করেন। যেকোনো মৃত্যুই মর্মান্তিক। তা সে বখাটের বাবাই হোক, বা কোনো মহতের জন্মদাতাই হোক।
হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতো। তা হয়নি, কারণ, ৫৫ জন বরযাত্রীর বাস যখন মাওয়া ঘাটে, তখন তারা মুঠোফোনে খবর পান বরের প্রতিদ্বন্দ্বী কনের বাড়ির সামনে সৈন্যসামন্ত নিয়ে উপস্থিত। বরযাত্রী ছিল নিরস্ত্র। সুতরাং অগ্রসর হওয়া নিরাপদ নয়। বরের কথায়, ‘আমরা কনের বাড়িতে না গিয়ে গাজীপুরে ফিরে যাই।’ ঘটনাটি নিয়ে থানায় মামলা হয়েছে।
এখানে কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এক. বখাটে ও তার বাবা ক্ষমতাসীন দলের মানুষ। দুই. ছেলেটি হয়তো খুবই ভালো—শান্ত-সজ্জন, কিন্তু সংগীতপ্রিয়। তবে গান সে ঘরে বসে শুনবে না, যাকে সে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে, তার বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে শুনবে। একাও শুনবে না, বন্ধুদের নিয়ে শুনবে। সে গান আস্তেও শুনবে না, যন্ত্রের যত শক্তি আছে, তত শক্তি ব্যবহার করে শুনবে, যাতে ভালোবাসার পাত্রীটি ও তার বাড়ির মানুষের কানের তালা ফেটে যায়। তিন. সংগীতপ্রেমী ও নারীপ্রেমীর বাবা পুত্রের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন কেন? দূর থেকে পুত্রের বাজানো গান শুনলে তাঁকে জীবন দিতে হতো না। অবশ্য বিয়েশাদি, বীরত্বপূর্ণ কাজ ও বিপদে-আপদে পুত্রের পাশে দাঁড়ানো যেকোনো স্নেহশীল পিতারই কর্তব্য।
বখাটেদের এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আজকাল প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে সারা দেশে। বাংলার মাটিতে বখাটে ও তাদের বাবাদের তৎপরতা যদি বন্ধ না করা যায়, তাহলে আগামী ২০২১ সালের আগেই সোনার বাংলার অধিকাংশ বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments