চার দিক-ময়নাকাহিনি... by মনিরুল আলম
আদালতপাড়ায় তখন মধ্য দুপুর। কর্মব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি। অন্যের দিকে খেয়াল করার সময় নেই কারও। সবাই দিশেহারার মতো যেন ছুটছে। একটু পরপর প্রিজন ভ্যানের ভয় লাগানো সেই শব্দ আর নিরাপত্তাকর্মীদের হুইসেল। আসামিদের হাতে হাতকড়া আর পায়ে বাঁধা ডান্ডাবেড়ি—ছুটছে পুলিশ, ছুটছে আসামি আর তাদের স্বজনেরা।
পুলিশের প্রিজন ভ্যান, আসামির আত্মীয়স্বজন আর উকিলের হাঁকডাক—সবকিছুই যেন কেমন অস্থিরতায় ভরা। কেউ হত্যা মামলা, কেউ জমিজমা, কেউ বা আবার হয়রানির শিকার হয়ে দিনের পর দিন আসছে এই আদালতে। নতুন কেউ এলে একটু অবাকই হবে আদালতপাড়ার এত সব কর্মযজ্ঞ দেখে।
এই ছোটাছুটির মধ্যে নাকে নোলক পরা ময়না এসে দাঁড়ান—সঙ্গে একটা ছোট পোঁটলা। চোখ দুটো যেন কিছু একটা খুঁজতে থাকে আদালতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। ভারাক্রান্ত মন আর দিশেহারা চাহনিই বলে দেয়, ময়না সুখে নেই। সাজানো সংসারে দুঃখ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তা না হলে কেউ আদালতপাড়ায় আসে। প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’
‘আমার ছেলেরে মিথ্যা মামলা দিছে। হেই কোরমানির (কোরবানি) ঈদের তনে এই আদালতে ভুগতাছি। আইজ নয় মাস হইল, কোনো কূল-কিনারা করতে পারতাছি না। এ পর্যন্ত তিনজন উকিল ধরছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু করবার পারতাছি না। আমরা এই আইন-আদালতের কিছুই বুঝি না বাবা।’ একটানা কথা বলে একটু দম নেন ময়না।
‘আপনার ছেলের নাম কী? সে কী অপরাধ করেছিল?’
‘হে কোনো অপরাধ করে নাই। শাহবাগ থেকে মাসের বেতন নিয়া বাসায় আইতেছিল। ওরা দুশমনি কইরা পুলিশের হাতে ধরাই দিছে। পুলিশ কয় ছিনতাই করছে। আমার পোলার পকেটে চার হাজার টাকা পাওয়া গেছে। গাড়ির কাজ শিখতে দিছিলাম। বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। বিদেশ না গিয়া গেল জেলে। আমার পোলার লগে ওরা দুশমনি করল। আল্লায় এর বিচার করব।’ বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন ময়না।
‘ওই, তুই কান্দোস ক্যান? ১৫ হাজার ট্যাহা নিয়া আইছি। দেহি উকিলেরে ধইরা কিছু করা যায় কি না।’ ময়নার স্বামী আদালতপাড়ায় শত শত মানুষ চলাচলের মধ্যে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, শান্ত থাকতে বলেন। ময়না যেন আরও ভেঙে পড়ে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকান।
‘আমাগো রাজুরে দেখসোস, পুলিশ কেমনে হাতকড়া পরাইয়া টানতে টানতে লইয়া আইতাছে।’ রাজুর নাম শুনতেই ময়নার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়, ‘কই, আমার সোনাবাপ রাজু কই?’ স্বামীর জামাটা খামচে ধরে সামনের দিকে তাকান ময়না।
ময়নার সামনে দিয়েই পুলিশ রাজুকে আদালতকক্ষে নিয়ে যায়। আজ ওর শুনানি হবে। ময়না ছেলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। মা-ছেলেতে চোখাচোখি হয়। মা ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চাইলেও আইন তাঁদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিচারকক্ষে ময়নার প্রবেশাধিকার নেই। আর তাই তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছেলেকে দেখতে থাকেন।
‘হের বাপে সিএনজি চালায়। আমাগো দুইডা সিএনজি আছে। ওইগুলো দিয়াই আমাগো সংসার চলে। ইচ্ছা ছিল ছেলেরে গাড়ির কাজ শিখাইয়া বিদেশ পাঠামু। ছেলে কামাইলে আমাগো হের একটু পরিশ্রম কমত। কিন্তু আমাগো একি হইল! এহন কয় দিন পরপর এই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। পোলাডার দিকে চাওন যায় না। আমার সোনার পোলার ভাগ্যে কি এই ছিল!’
সময় ফুরিয়ে যায়। আদালত আবার নতুন করে হাজিরার তারিখ দেন। ময়না তাঁর সঙ্গে থাকা পোঁটলাটা হাতে নিয়ে দেন ছুট। ততক্ষণে পুলিশ রাজুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। ঘটনাটি ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগের।
আদালতপাড়ায় প্রতিদিন এ রকম শত শত ময়নাকাহিনি তৈরি হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। আর দাঁড়িয়ে থাকা পাকুড়গাছটি নীরব সাক্ষী হয়ে পাতা ঝরায়, নতুন পাতায় নতুন ময়নাদের কাহিনি লিখতে হবে বলে...।
এই ছোটাছুটির মধ্যে নাকে নোলক পরা ময়না এসে দাঁড়ান—সঙ্গে একটা ছোট পোঁটলা। চোখ দুটো যেন কিছু একটা খুঁজতে থাকে আদালতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। ভারাক্রান্ত মন আর দিশেহারা চাহনিই বলে দেয়, ময়না সুখে নেই। সাজানো সংসারে দুঃখ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তা না হলে কেউ আদালতপাড়ায় আসে। প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’
‘আমার ছেলেরে মিথ্যা মামলা দিছে। হেই কোরমানির (কোরবানি) ঈদের তনে এই আদালতে ভুগতাছি। আইজ নয় মাস হইল, কোনো কূল-কিনারা করতে পারতাছি না। এ পর্যন্ত তিনজন উকিল ধরছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু করবার পারতাছি না। আমরা এই আইন-আদালতের কিছুই বুঝি না বাবা।’ একটানা কথা বলে একটু দম নেন ময়না।
‘আপনার ছেলের নাম কী? সে কী অপরাধ করেছিল?’
‘হে কোনো অপরাধ করে নাই। শাহবাগ থেকে মাসের বেতন নিয়া বাসায় আইতেছিল। ওরা দুশমনি কইরা পুলিশের হাতে ধরাই দিছে। পুলিশ কয় ছিনতাই করছে। আমার পোলার পকেটে চার হাজার টাকা পাওয়া গেছে। গাড়ির কাজ শিখতে দিছিলাম। বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। বিদেশ না গিয়া গেল জেলে। আমার পোলার লগে ওরা দুশমনি করল। আল্লায় এর বিচার করব।’ বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন ময়না।
‘ওই, তুই কান্দোস ক্যান? ১৫ হাজার ট্যাহা নিয়া আইছি। দেহি উকিলেরে ধইরা কিছু করা যায় কি না।’ ময়নার স্বামী আদালতপাড়ায় শত শত মানুষ চলাচলের মধ্যে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, শান্ত থাকতে বলেন। ময়না যেন আরও ভেঙে পড়ে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকান।
‘আমাগো রাজুরে দেখসোস, পুলিশ কেমনে হাতকড়া পরাইয়া টানতে টানতে লইয়া আইতাছে।’ রাজুর নাম শুনতেই ময়নার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়, ‘কই, আমার সোনাবাপ রাজু কই?’ স্বামীর জামাটা খামচে ধরে সামনের দিকে তাকান ময়না।
ময়নার সামনে দিয়েই পুলিশ রাজুকে আদালতকক্ষে নিয়ে যায়। আজ ওর শুনানি হবে। ময়না ছেলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। মা-ছেলেতে চোখাচোখি হয়। মা ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চাইলেও আইন তাঁদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিচারকক্ষে ময়নার প্রবেশাধিকার নেই। আর তাই তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছেলেকে দেখতে থাকেন।
‘হের বাপে সিএনজি চালায়। আমাগো দুইডা সিএনজি আছে। ওইগুলো দিয়াই আমাগো সংসার চলে। ইচ্ছা ছিল ছেলেরে গাড়ির কাজ শিখাইয়া বিদেশ পাঠামু। ছেলে কামাইলে আমাগো হের একটু পরিশ্রম কমত। কিন্তু আমাগো একি হইল! এহন কয় দিন পরপর এই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। পোলাডার দিকে চাওন যায় না। আমার সোনার পোলার ভাগ্যে কি এই ছিল!’
সময় ফুরিয়ে যায়। আদালত আবার নতুন করে হাজিরার তারিখ দেন। ময়না তাঁর সঙ্গে থাকা পোঁটলাটা হাতে নিয়ে দেন ছুট। ততক্ষণে পুলিশ রাজুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। ঘটনাটি ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগের।
আদালতপাড়ায় প্রতিদিন এ রকম শত শত ময়নাকাহিনি তৈরি হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। আর দাঁড়িয়ে থাকা পাকুড়গাছটি নীরব সাক্ষী হয়ে পাতা ঝরায়, নতুন পাতায় নতুন ময়নাদের কাহিনি লিখতে হবে বলে...।
No comments