মানবাধিকার-সব ক্ষেত্রে সুবিচার পাওয়ার এটাই সময় by সলিল শেঠি

কল্পনা করুন, খরচ দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় সন্তান জন্মদানে আপনি চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না, কিন্তু এ নিয়ে আপনার করারও কিছু নেই। আপনার সন্তান শিক্ষা নিতে পারছে না আপনার পরিচয়ের কারণে—আবার সমতার জন্য আপনার যে দাবি, সেটিও উপেক্ষিত হচ্ছে।


অনেক মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো থেকে প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ পর্যাপ্ত বাসস্থান, খাদ্য, পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, কাজের অধিকার, শিক্ষা বা সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বৈষম্য, বাদপড়া এবং দীর্ঘায়িত অবহেলার শিকার হওয়াকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে না দেখে বরং একে অপরিবর্তনীয় অবস্থা বিবেচনা (ব্যাপারগুলো এমনই) করে তাদের দুর্ভাগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকারগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সবার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণে তাদের যে বাধ্যবাধকতা, সে ব্যাপারে প্রায়ই মুখে বড় বড় কথা বলে। এ ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া বেশির ভাগ মানুষের সুবিচার চাওয়ার সামর্থ্য নেই, বরং তারা সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির ঐচ্ছিক প্রটোকল রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক অনুসমর্থনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত এই প্রটোকল অনুযায়ী সরকার কর্তৃক একক বা সমষ্টিগতভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা স্থানীয়ভাবে প্রতিকার না পেলে জাতিসংঘের কাছে প্রতিকার চাইতে পারবে।
বাংলাদেশের জনগণ যদি এই পদ্ধতির সুবিধা পেতে চায়, তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রটোকলের শরিক রাষ্ট্র হতে হবে। শুধু এভাবেই বাংলাদেশের ওপর আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে। প্রটোকল অনুসমর্থনের জন্য উন্মুক্ত করার পর এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, এখনো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রটোকল অনুমোদন করেনি, যদিও আমরা অপেক্ষায় আছি।
বিশ্বনেতারা ২০-২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিউইয়র্কে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য মিলিত হবেন, যার লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাস করা। মানবাধিকারকে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত একটি সংযুক্ত বিষয় হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, একে বরং লক্ষ্য অর্জন-চেষ্টার কেন্দ্রে মূল বিষয় হিসেবে গণ্য করা উচিত। এই প্রটোকলের শরিক রাষ্ট্র হওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার দেখাতে পারে যে তারা দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নে ইচ্ছুক, যার মধ্য দিয়ে দরিদ্র মানুষ সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারবে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো এবং বিশ্ব এই বার্তা পাবে যে প্রান্তিকতার বিষয় নিয়ে আমরা আর আত্মতুষ্ট থাকতে পারি না এবং যারা দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে, তাদের আর অবহেলা করতে পারি না।
এই প্রটোকলের মাধ্যমে নতুন কোনো অধিকার তৈরি করা হয়নি, বরং এখানে অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠার পথ দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির রাষ্ট্রপক্ষ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কারও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলোতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যেমন—সরকার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও বিকল্প বাসস্থান বা ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ ব্যতিরেকে কাউকে তার বসতবাড়ি থেকে জোর করে উচ্ছেদ করতে পারে না। চুক্তি অনুযায়ী সরকার বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। যেমন—নিয়োগকারীদের কাছ থেকে কর্মী-শ্রমিকদের ন্যায্য সুবিধাদি পাওয়া নিশ্চিত করবে। এ চুক্তি অনুযায়ী সরকার সবার জন্য শিক্ষা, খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসুবিধা নিশ্চিতকরণে আইন প্রণয়ন ও কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করবে। চুক্তি অনুযায়ী জনগণকে তাদের অধিকারগুলো দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা নেবে।
বাংলাদেশের আদালত কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো সমুন্নত রেখেছেন। যেমন বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে জোর করে উচ্ছেদ করাটা বেআইনি বলে রায় দেওয়া হয়েছিল। এ সিদ্ধান্তগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়া দরকার, যা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
এই প্রটোকল আন্তর্জাতিক চুক্তিকে জোরদার করবে। এই চুক্তি জনগণকে একটি স্বাধীন, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সামনে তাদের অধিকারগুলোর দাবি জানানোর সুযোগ করে দেবে, যাঁরা তাদের অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হয়েছিল কি না নির্ধারণ করবেন। শুধু এ পদ্ধতি বাংলাদেশের মানবাধিকার সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারবে না। তবে এ পদ্ধতি সরকারি কর্মকর্তাদের দরিদ্র মানুষের কথা শুনতে উৎসাহিত করবে এবং এ কথা নিশ্চিত করবে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-চেষ্টার বাইরে কেউ থাকবে না।
ইকুয়েডর ও মঙ্গোলিয়া এই প্রটোকল অনুমোদনকারী প্রথম দুটি দেশ। এরই মধ্যে ৩৩টি দেশ এই প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো হলো বলিভিয়া, গিনি বিসাউ, মাদাগাস্কার, সেনেগাল, সলোমন আইল্যান্ড ও তিমোর-লেসতে। দেশগুলো প্রটোকলে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে এটি অনুমোদনে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে তিনটি দেশের মাথাপিছু গড় আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক নালিশপদ্ধতিগুলোর রাষ্ট্রপক্ষ হওয়ায় নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকারগুলো লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে আদালতে নালিশ জানানোর সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষ হওয়ার কারণে মানবতা, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর আন্তর্জাতিক তদন্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে—এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো লঙ্ঘনের বিষয়ে নালিশ জানানোর সুযোগ থাকাটা অপরিহার্য।
সরকার যদি মানবাধিকারের সব ক্ষেত্রে সুবিচারের সুযোগ নিশ্চিত করতে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে তাদের আন্তরিকতা দেখাতে চায়, তবে এই প্রটোকলের অনুমোদনের মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণিত হবে। নিউইয়র্কে এমডিজি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা দেওয়া উচিত যে বাংলাদেশ প্রটোকলের রাষ্ট্রপক্ষ হওয়ার জন্য আর কালক্ষেপণ করবে না।
সলিল শেঠি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব।

No comments

Powered by Blogger.