সোজা কলমে-আর কত কাল ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু হয়ে থাকতে হবে by আহমদ রফিক
ফিলিস্তিনি আরবদের যুক্তিসংগত রাষ্ট্রীয় পুনর্বাসন যে অধরা থেকে যাবে ইসরায়েলি শাসকদের একগুঁয়েমি এবং তাদের সবচেয়ে বড় খুঁটি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব থেকে তা বুঝতে পারা যায়। সমস্যা তো আজকের নয়, তবু দীর্ঘকাল ধরেই এ বিষয়ে টালবাহানা চলছে এবং চলছে লোক দেখানো একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পরও।
শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর হোয়াইট হাউসে একের পর এক প্রেসিডেন্ট এসেছেন, গেছেন কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি। তাদের দাবি পূরণ হয়নি। এ বিষয়ে কি ডেমোক্র্যাট, কি রিপাবলিকান—কোনো দলেই সদিচ্ছার প্রকাশ দেখা যায়নি। ইসরায়েলি নেতারা সবাই (উদারনৈতিক বা রক্ষণশীল) এ ব্যাপারে এককাট্টা। তাঁদের জেরুজালেম চাই, তাঁদের আরও অনেক কিছু চাই। সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো ফিলিস্তিনিদের এখানে তাঁদের অনুগত হয়ে থাকতে হবে।
এ অবস্থায় কি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কোনো যুক্তিসংগত, সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব? তাই কথিত শান্তিচুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। আর সে জন্যই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বনেতাদের মাথাব্যথা নেই। বিশ্ববিবেকও ইদানীং বড় একটা কথা বলে না, তা গাজায় যত রক্ত ঝরুক, শিশু-নারীর জীবনহানি যতই ঘটুক। আশ্চর্য যে ফিলিস্তিনিদের জন্য আরব দেশগুলোরও কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। যারা পরাশক্তির বলয়ে মাথা বিকানো, তাদের যেমন জাতি-জনগোষ্ঠীর জন্য ভাবনা নেই, তেমনি নেই অন্যদেরও।
সম্প্রতি খাদ্য ও ওষুধের ত্রাণবাহী লিবীয় জাহাজ ইসরায়েলি নৌবাহিনীর বাধায় অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। এমন একটি খবর দেখে কিছু লেখার কথা মনে এল। কিছুদিন আগে অনুরূপ ত্রাণবাহী তুরস্কের একটি জাহাজে ইসরায়েলি হামলায় কয়েকজন ত্রাণকর্মী মারা যান, জাহাজটি গাজায় পৌঁছাতে পারেনি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ তুর্কি সরকার ইসরায়েলের তরফ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানায়। কিন্তু ইসরায়েল নির্বাক। তাদের অনড় অবস্থান ও ইঙ্গ-মার্কিনদের নীরবতা লক্ষ করে তুরস্ক সরকারকে তাদের দাবি থেকে সরে আসতে হয়। মার খেয়ে মার হজম।
ইসরায়েলের এ ধরনের আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী চরিত্র এবং সে বিষয়ে অনমনীয় মনোভাব নতুন কিছু নয়। এমন মনোভাব আগে অনেক ঘটনায় দেখা গেছে। সবাই জানেন যে এর কারণ একটাই, আর তা হলো মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েলের গভীর প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এখন সোভিয়েত কর্তৃত্বহীন বিশ্বরাজনীতিতে সর্বশক্তিমান মুরব্বি, তার ইচ্ছায় অবাধ্য হয় এমন সাহস দু-একটি রাষ্ট্র ছাড়া কারোর নেই।
তাই নিরপেক্ষ বিশ্বের (যদি তা আদৌ থেকে থাকে) সমালোচনায় ইসরায়েলের কিছু যায়-আসে না। খুঁটি ঠিক থাকলেই হলো। তাই বুঝতে পারা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল তোষণনীতির যুক্তিসংগত পরিবর্তন না ঘটা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন সমস্যার কোনো সুরাহা হবে না। ইয়াসির আরাফাতের সব চেষ্টা একই কারণে বিফলে গেছে। শেষ পর্যন্ত রামাল্লায় তাঁর লজ্জাজনক অবরুদ্ধ জীবন এবং পরে আরাফাতের মৃত্যুতেও (অথবা হত্যা) সমস্যার জট খোলেনি। খোলেনি দুর্বলচিত্ত, আপসবাদী মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বেও। কারণ, এর মধ্যে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনি জনতার সমর্থন গেছে চরমপন্থী সংগঠন হামাসের পক্ষে। মাহমুদ আব্বাস শক্তিহীন প্রেসিডেন্ট।
আর তাতেই যত বিপত্তি। ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কেউ এমনটা চায়নি। একই কারণে ফিলিস্তিনি জনগণের মুকুটহীন প্রতিনিধি ইয়াসির আরাফাতের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও ফিলিস্তিনি পুনর্বাসন ঘটুক, এটা চায়নি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। ছোট একটি ঘটনা উপলক্ষে আরাফাতকে রামাল্লায় অবরুদ্ধ করে রাখা, সেখানে বোমা বর্ষণ করা ও খাদ্য সরবরাহে বাধা দেওয়া—কী না করেছে ইসরায়েল, যাতে আরাফাত তাঁর আবাসস্থল ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। আরাফাত তা করেননি। এ অন্যায় তৎপরতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেনি পরাশক্তিরাও।
ফিলিস্তিনি জনগণের অবিসংবাদী প্রিয় নেতা জেরুজালেমের ‘গ্র্যান্ড মুফতি’র প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডের সূত্র ধরে ফিলিস্তিনি সমস্যা নিয়ে আমার স্পর্শকাতরতা সেই ছোটবেলা থেকে। পরিণত বয়সে অনেক লিখেছি এ সম্পর্কে, এমনকি কিছুটা আশা, কিছু আশঙ্কা নিয়ে ১৪০০ সালে গোটা কয়েক কলাম। তখন লিখেছি, ‘যে বাস্তবতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করেছিল, নীতিগতভাবে অনেকটা একই ধরনের বাস্তবতা এখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। তাদেরও নিজস্ব বাসভূমি প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে।’ কিন্তু সময় যত গেছে, হতাশা তত বেড়েছে। দেখেছি, বিশ্বরাজনীতির দুষ্ট ক্রিয়াকলাপ কত রূপ নিতে পারে। এখনো দেখছি।
একই বিষয় ২০০০ সালের অক্টোবরে লেখা ইয়াসির আরাফাতের সদর দপ্তরে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে। সেই লেখার শেষ কথা ছিল, ‘ইসরায়েলের সর্বশেষ কর্মকাণ্ড দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক শান্তি ও মীমাংসা এবং সহাবস্থানের সম্ভাবনা অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাদের সামরিক হামলা বস্তুত আরাফাতকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। তাঁর শান্তির হাত দুর্বল করেছে, ফিলিস্তিনি চরমপন্থীদের উৎসাহিত করছে। ইসরায়েল তার আধিপত্যবাদী মনোভাব বর্জন করতে না পারলে প্রকৃত মীমাংসা কখনো সম্ভব হবে না, হাজার শান্তিবৈঠকেও কিছু হবে না।’
ইসরায়েলের ছোট-বড় হামলার পরে তা-ই ঘটেছে। আরাফাতের মৃত্যুর পর ব্যক্তিত্বহীন, আপসবাদী মাহমুদ আব্বাস প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় সমর্থনে হামাসের জয় এবং তাদের অদূরদর্শী ছোটখাটো রকেট হামলার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক ইসরায়েলি হামলায় অনেক মৃত্যু, অনেক ক্ষয়ক্ষতি। সেই জের এখনো চলছে। ইসরায়েলি অমানবিকতা ত্রাণসামগ্রীর ওপরও আঘাত হানছে। বিশ্ব তা চেয়ে চেয়ে দেখছে, দেখছে আরব বিশ্বও। তাদের মধ্যেও ইতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, আরব ভাইদের দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা নেই।
আমার বিশ্বাস, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিমান আরব রাষ্ট্র বা রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন না ঘটা, তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো না হওয়া, সর্বোপরি ফিলিস্তিনি ‘ইস্যু’তে মিসর-লিবিয়াসহ গোটা আরব বিশ্ব এককাট্টা না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না, ফিলিস্তিনিদের দুঃখ ঘুচবে না, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না।
কারণ নানা কারণে, রাজনৈতিক কারণে আরব বিশ্ব বহুধাবিভক্ত, এমনকি তাদের কারও কারও মধ্যে শত্রুতাও রয়েছে এবং তা মতাদর্শগত, ক্ষমতাগত ও ব্যক্তিস্বার্থগত। কিন্তু শিমন পেরেজ, নেতানিয়াহু বা এহুদ বারাক ইসরায়েলি স্বার্থে এককাট্টা, তাঁদের রাজনীতি যতই পৃথক হোক। তা ছাড়া ইহুদি-চাতুর্যের একটা বিষয় তো আছেই। সে ক্ষেত্রে মাহমুদ আব্বাসের সাধ্য কি তাঁদের সঙ্গে টেক্কা দেন কিংবা আপন ব্যক্তিত্ববলে আরব নেতাদের মন জয় করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কার্যকর সমর্থন তুলে আনেন।
আরব দেশগুলো যদিও পারস্পরিক মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এক কাতারে চলতে না পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনি আরবদের পক্ষে দাঁড়াতে না পারার তো কোনো যুক্তি নেই। কোনো আরব শীর্ষ সম্মেলনে যদি আরব নেতারা এক টেবিলে বসতে পারেন, তাহলে তাঁদের দুর্ভাগ্যপীড়িত ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনি আরবদের জীবনমরণ সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের পক্ষে দৃঢ় সমর্থন জানাতে পারবেন না কেন? পারসিক ইরান যেখানে ফিলিস্তিনি আরবদের সমর্থনে তাদের সঙ্গে এককাট্টা, সেখানে আরব দেশগুলোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে ফিলিস্তিনি আরবদের দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। দাঁড়াতে পারলে ঠিকই ইহুদিদের টনক নড়ত, অবস্থার পরিবর্তন ঘটত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বরাজনীতির বিন্যাস সেটা ঘটতে দেয়নি।
তাই বলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বা আঞ্চলিক রাজনীতির পাশার ছক কোনো দিনই বদলাবে না, এমন তো নয়। কে ভেবেছিল ইরানের বর্তমান রাষ্ট্রনৈতিক বিন্যাসের কথা, বিশেষ করে তুদেহ পার্টি বা ফেদাইনদের শক্তিমান অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে? তার চেয়েও বড় বিস্ময়, তালেবান আল-কায়েদার অভ্যুত্থান? কারণ যা হোক, অবাঞ্ছিত ওই জঙ্গি মৌলবাদী শক্তি তো গোটা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নানা অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পরাশক্তি এতগুলো বছরে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়েও তাদের উৎখাত করে উঠতে পারেনি। কারও কারও ধারণা, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র আরেক ভিয়েতনাম যুদ্ধের মুখোমুখি হবে। হয়তো বা পরিণামেরও। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর নির্ধারিত তারিখে কাঙ্ক্ষিত সমাপনের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবেন না।
রাজনীতির নানা বিস্ময়ের কথা মাথায় রেখে ইহুদিদের বোঝা উচিত, আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক বিন্যাস চিরদিন এক রকম থাকবে, এমন তো কথা নেই। পরিবর্তনের ঢেউ নানা দিক থেকে বিশ্বরাজনীতির প্রাঙ্গণে আছড়ে পড়ছে। হয়তো কোনো এক প্রকার পরিবর্তনের মুখে মধ্যপ্রাচ্যের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোই তাদের তেলসমৃদ্ধ শক্তি নিয়ে একদিন সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
অথবা রবীন্দ্রনাথ-কথিত পূর্ব দিগন্তের কোনো মহামানবের বদলে মধ্যপ্রাচ্যে কট্টর পশ্চিমাবিরোধী কোনো জাতীয়তাবাদী একনায়ক বা ধর্মবাদী কোনো মহানায়কের আবির্ভাব ঘটবে না, এমন কথা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে? পারে না বলেই নিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ বিশ্বাস করে ইসরায়েলের উচিত ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে, জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের স্বার্থরক্ষামূলক প্রস্তাবে সম্মত হওয়া। জেরুজালেম ইহুদিদের একার নয়, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদেরও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। তাই জেরুজালেম বিভক্ত হতেই পারে।
সবচেয়ে বড় কথা, পিএলও তাদের অতীত সন্ত্রাসবাদী নীতি বাদ দিয়ে এগিয়ে এসেছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েলের উচিত তাদের একগুঁয়েমি পরিত্যাগ করে কার্যকর আলোচনায় মতৈক্যে পৌঁছা। কারণ, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষমাত্রই চায় ফিলিস্তিন সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধান, যাতে হঠকারিতা, সন্ত্রাসী চরমপন্থা নয়, পরস্পরের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে আরব-ইহুদি পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। এতে অন্তত একটি অঞ্চল মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতা থেকে মুক্ত থাকবে। হামাসেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে বোঝা উচিত যে সন্ত্রাসের পথ সঠিক নয়, অন্তত যতক্ষণ আলোচনার দরজা খোলা থাকে।
আহমদ রফিক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
এ অবস্থায় কি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কোনো যুক্তিসংগত, সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব? তাই কথিত শান্তিচুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। আর সে জন্যই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বনেতাদের মাথাব্যথা নেই। বিশ্ববিবেকও ইদানীং বড় একটা কথা বলে না, তা গাজায় যত রক্ত ঝরুক, শিশু-নারীর জীবনহানি যতই ঘটুক। আশ্চর্য যে ফিলিস্তিনিদের জন্য আরব দেশগুলোরও কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। যারা পরাশক্তির বলয়ে মাথা বিকানো, তাদের যেমন জাতি-জনগোষ্ঠীর জন্য ভাবনা নেই, তেমনি নেই অন্যদেরও।
সম্প্রতি খাদ্য ও ওষুধের ত্রাণবাহী লিবীয় জাহাজ ইসরায়েলি নৌবাহিনীর বাধায় অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। এমন একটি খবর দেখে কিছু লেখার কথা মনে এল। কিছুদিন আগে অনুরূপ ত্রাণবাহী তুরস্কের একটি জাহাজে ইসরায়েলি হামলায় কয়েকজন ত্রাণকর্মী মারা যান, জাহাজটি গাজায় পৌঁছাতে পারেনি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ তুর্কি সরকার ইসরায়েলের তরফ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানায়। কিন্তু ইসরায়েল নির্বাক। তাদের অনড় অবস্থান ও ইঙ্গ-মার্কিনদের নীরবতা লক্ষ করে তুরস্ক সরকারকে তাদের দাবি থেকে সরে আসতে হয়। মার খেয়ে মার হজম।
ইসরায়েলের এ ধরনের আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী চরিত্র এবং সে বিষয়ে অনমনীয় মনোভাব নতুন কিছু নয়। এমন মনোভাব আগে অনেক ঘটনায় দেখা গেছে। সবাই জানেন যে এর কারণ একটাই, আর তা হলো মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েলের গভীর প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এখন সোভিয়েত কর্তৃত্বহীন বিশ্বরাজনীতিতে সর্বশক্তিমান মুরব্বি, তার ইচ্ছায় অবাধ্য হয় এমন সাহস দু-একটি রাষ্ট্র ছাড়া কারোর নেই।
তাই নিরপেক্ষ বিশ্বের (যদি তা আদৌ থেকে থাকে) সমালোচনায় ইসরায়েলের কিছু যায়-আসে না। খুঁটি ঠিক থাকলেই হলো। তাই বুঝতে পারা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল তোষণনীতির যুক্তিসংগত পরিবর্তন না ঘটা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন সমস্যার কোনো সুরাহা হবে না। ইয়াসির আরাফাতের সব চেষ্টা একই কারণে বিফলে গেছে। শেষ পর্যন্ত রামাল্লায় তাঁর লজ্জাজনক অবরুদ্ধ জীবন এবং পরে আরাফাতের মৃত্যুতেও (অথবা হত্যা) সমস্যার জট খোলেনি। খোলেনি দুর্বলচিত্ত, আপসবাদী মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বেও। কারণ, এর মধ্যে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনি জনতার সমর্থন গেছে চরমপন্থী সংগঠন হামাসের পক্ষে। মাহমুদ আব্বাস শক্তিহীন প্রেসিডেন্ট।
আর তাতেই যত বিপত্তি। ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র কেউ এমনটা চায়নি। একই কারণে ফিলিস্তিনি জনগণের মুকুটহীন প্রতিনিধি ইয়াসির আরাফাতের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও ফিলিস্তিনি পুনর্বাসন ঘটুক, এটা চায়নি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। ছোট একটি ঘটনা উপলক্ষে আরাফাতকে রামাল্লায় অবরুদ্ধ করে রাখা, সেখানে বোমা বর্ষণ করা ও খাদ্য সরবরাহে বাধা দেওয়া—কী না করেছে ইসরায়েল, যাতে আরাফাত তাঁর আবাসস্থল ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। আরাফাত তা করেননি। এ অন্যায় তৎপরতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেনি পরাশক্তিরাও।
ফিলিস্তিনি জনগণের অবিসংবাদী প্রিয় নেতা জেরুজালেমের ‘গ্র্যান্ড মুফতি’র প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডের সূত্র ধরে ফিলিস্তিনি সমস্যা নিয়ে আমার স্পর্শকাতরতা সেই ছোটবেলা থেকে। পরিণত বয়সে অনেক লিখেছি এ সম্পর্কে, এমনকি কিছুটা আশা, কিছু আশঙ্কা নিয়ে ১৪০০ সালে গোটা কয়েক কলাম। তখন লিখেছি, ‘যে বাস্তবতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করেছিল, নীতিগতভাবে অনেকটা একই ধরনের বাস্তবতা এখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। তাদেরও নিজস্ব বাসভূমি প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে।’ কিন্তু সময় যত গেছে, হতাশা তত বেড়েছে। দেখেছি, বিশ্বরাজনীতির দুষ্ট ক্রিয়াকলাপ কত রূপ নিতে পারে। এখনো দেখছি।
একই বিষয় ২০০০ সালের অক্টোবরে লেখা ইয়াসির আরাফাতের সদর দপ্তরে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে। সেই লেখার শেষ কথা ছিল, ‘ইসরায়েলের সর্বশেষ কর্মকাণ্ড দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক শান্তি ও মীমাংসা এবং সহাবস্থানের সম্ভাবনা অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাদের সামরিক হামলা বস্তুত আরাফাতকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। তাঁর শান্তির হাত দুর্বল করেছে, ফিলিস্তিনি চরমপন্থীদের উৎসাহিত করছে। ইসরায়েল তার আধিপত্যবাদী মনোভাব বর্জন করতে না পারলে প্রকৃত মীমাংসা কখনো সম্ভব হবে না, হাজার শান্তিবৈঠকেও কিছু হবে না।’
ইসরায়েলের ছোট-বড় হামলার পরে তা-ই ঘটেছে। আরাফাতের মৃত্যুর পর ব্যক্তিত্বহীন, আপসবাদী মাহমুদ আব্বাস প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় সমর্থনে হামাসের জয় এবং তাদের অদূরদর্শী ছোটখাটো রকেট হামলার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক ইসরায়েলি হামলায় অনেক মৃত্যু, অনেক ক্ষয়ক্ষতি। সেই জের এখনো চলছে। ইসরায়েলি অমানবিকতা ত্রাণসামগ্রীর ওপরও আঘাত হানছে। বিশ্ব তা চেয়ে চেয়ে দেখছে, দেখছে আরব বিশ্বও। তাদের মধ্যেও ইতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, আরব ভাইদের দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা নেই।
আমার বিশ্বাস, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিমান আরব রাষ্ট্র বা রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন না ঘটা, তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো না হওয়া, সর্বোপরি ফিলিস্তিনি ‘ইস্যু’তে মিসর-লিবিয়াসহ গোটা আরব বিশ্ব এককাট্টা না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না, ফিলিস্তিনিদের দুঃখ ঘুচবে না, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না।
কারণ নানা কারণে, রাজনৈতিক কারণে আরব বিশ্ব বহুধাবিভক্ত, এমনকি তাদের কারও কারও মধ্যে শত্রুতাও রয়েছে এবং তা মতাদর্শগত, ক্ষমতাগত ও ব্যক্তিস্বার্থগত। কিন্তু শিমন পেরেজ, নেতানিয়াহু বা এহুদ বারাক ইসরায়েলি স্বার্থে এককাট্টা, তাঁদের রাজনীতি যতই পৃথক হোক। তা ছাড়া ইহুদি-চাতুর্যের একটা বিষয় তো আছেই। সে ক্ষেত্রে মাহমুদ আব্বাসের সাধ্য কি তাঁদের সঙ্গে টেক্কা দেন কিংবা আপন ব্যক্তিত্ববলে আরব নেতাদের মন জয় করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কার্যকর সমর্থন তুলে আনেন।
আরব দেশগুলো যদিও পারস্পরিক মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এক কাতারে চলতে না পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনি আরবদের পক্ষে দাঁড়াতে না পারার তো কোনো যুক্তি নেই। কোনো আরব শীর্ষ সম্মেলনে যদি আরব নেতারা এক টেবিলে বসতে পারেন, তাহলে তাঁদের দুর্ভাগ্যপীড়িত ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনি আরবদের জীবনমরণ সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের পক্ষে দৃঢ় সমর্থন জানাতে পারবেন না কেন? পারসিক ইরান যেখানে ফিলিস্তিনি আরবদের সমর্থনে তাদের সঙ্গে এককাট্টা, সেখানে আরব দেশগুলোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে ফিলিস্তিনি আরবদের দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। দাঁড়াতে পারলে ঠিকই ইহুদিদের টনক নড়ত, অবস্থার পরিবর্তন ঘটত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বরাজনীতির বিন্যাস সেটা ঘটতে দেয়নি।
তাই বলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বা আঞ্চলিক রাজনীতির পাশার ছক কোনো দিনই বদলাবে না, এমন তো নয়। কে ভেবেছিল ইরানের বর্তমান রাষ্ট্রনৈতিক বিন্যাসের কথা, বিশেষ করে তুদেহ পার্টি বা ফেদাইনদের শক্তিমান অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে? তার চেয়েও বড় বিস্ময়, তালেবান আল-কায়েদার অভ্যুত্থান? কারণ যা হোক, অবাঞ্ছিত ওই জঙ্গি মৌলবাদী শক্তি তো গোটা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নানা অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পরাশক্তি এতগুলো বছরে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়েও তাদের উৎখাত করে উঠতে পারেনি। কারও কারও ধারণা, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র আরেক ভিয়েতনাম যুদ্ধের মুখোমুখি হবে। হয়তো বা পরিণামেরও। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর নির্ধারিত তারিখে কাঙ্ক্ষিত সমাপনের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবেন না।
রাজনীতির নানা বিস্ময়ের কথা মাথায় রেখে ইহুদিদের বোঝা উচিত, আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক বিন্যাস চিরদিন এক রকম থাকবে, এমন তো কথা নেই। পরিবর্তনের ঢেউ নানা দিক থেকে বিশ্বরাজনীতির প্রাঙ্গণে আছড়ে পড়ছে। হয়তো কোনো এক প্রকার পরিবর্তনের মুখে মধ্যপ্রাচ্যের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোই তাদের তেলসমৃদ্ধ শক্তি নিয়ে একদিন সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
অথবা রবীন্দ্রনাথ-কথিত পূর্ব দিগন্তের কোনো মহামানবের বদলে মধ্যপ্রাচ্যে কট্টর পশ্চিমাবিরোধী কোনো জাতীয়তাবাদী একনায়ক বা ধর্মবাদী কোনো মহানায়কের আবির্ভাব ঘটবে না, এমন কথা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে? পারে না বলেই নিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ বিশ্বাস করে ইসরায়েলের উচিত ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে, জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের স্বার্থরক্ষামূলক প্রস্তাবে সম্মত হওয়া। জেরুজালেম ইহুদিদের একার নয়, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদেরও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। তাই জেরুজালেম বিভক্ত হতেই পারে।
সবচেয়ে বড় কথা, পিএলও তাদের অতীত সন্ত্রাসবাদী নীতি বাদ দিয়ে এগিয়ে এসেছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েলের উচিত তাদের একগুঁয়েমি পরিত্যাগ করে কার্যকর আলোচনায় মতৈক্যে পৌঁছা। কারণ, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষমাত্রই চায় ফিলিস্তিন সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধান, যাতে হঠকারিতা, সন্ত্রাসী চরমপন্থা নয়, পরস্পরের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে আরব-ইহুদি পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। এতে অন্তত একটি অঞ্চল মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতা থেকে মুক্ত থাকবে। হামাসেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে বোঝা উচিত যে সন্ত্রাসের পথ সঠিক নয়, অন্তত যতক্ষণ আলোচনার দরজা খোলা থাকে।
আহমদ রফিক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
No comments