মতপ্রকাশ-গণমাধ্যমের রাজনীতি বনাম রাজনীতিতে গণমাধ্যম by রাশেদা রওনক খান
তথ্য বিভ্রাট আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিতে পারে, তাই তথ্য প্রচারে আমাদের সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এই সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার সম্ভব গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে যদি গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিষ্পেষিত হন,
তাহলে এই লজ্জা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বেড়েই চলছে! এই দমন-নিপীড়নের সংস্কৃতি বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারকেই
নিতে হবে
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর কে, এ প্রশ্ন এলে নিশ্চিতভাবেই 'গণমাধ্যমে'র কথা বলা হবে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও তাই স্বাভাবিকভাবেই খুব জটিল। জটিল বললাম এ কারণে যে, ক্ষমতাধর যে কোনো কিছুই খুব স্পর্শকাতর। গণমাধ্যমের ক্ষমতা কিংবা ব্যাপকতা কতটুকু তা বোঝা যায় যখন আমরা বাংলাদেশের কোনো গহিন গ্রামের কোনো এক বাড়িতে বসেই দেখতে পাই আমেরিকার হোয়াইট হাউসে এ মুহূর্তে কোন ফরেন পলিসি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে! কিংবা আফগান-আমেরিকার যুদ্ধের উদাহরণ টেনেই যদি বলি, দু'দেশের যুদ্ধ আসলে ততটুকুই আমাদের চোখে সত্য, যতটুকু আমরা সিএনএন-বিবিসির পর্দায় দেখেছি, এর বাইরের সত্য আমাদের অগোচরেই রয়ে গেল! এর বাইরে যেসব সত্য, তার বেশিরভাগ আড়ালেই থেকে যায়, যদি গণমাধ্যম তা আড়াল করে! অর্থাৎ আমার মূল কথা হলো, গণমাধ্যম হলো তাই, যার মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দেখি, বুঝি কিংবা জানি! এই বছরের ৯/১১-এ আমেরিকায় প্রকাশিত সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার ছবিগুলো একটি বার্তা বহন করছিল, তা হলো দল-মত-ধর্ম-জাত-শ্রেণী নির্বিশেষে তারা এক এবং অভিন্ন! তা বোঝানোর জন্য তাদের কাছে একটি ছবিই যথেষ্ট ছিল, যা আসলে একাত্মতাকেই প্রকাশ করে। ছবিটি ছিল 'বুশ-ক্লিনটন এবং ওবামা' এক সঙ্গে জনতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন সেদিনের নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতে। এই তিন ব্যক্তির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মিল-অমিল বিচার করলে তিন মেরুর হতে পারে কিন্তু গণমাধ্যমের বদৌলতে তারা সেদিন পৃথিবীর সামনে এক হয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ গণমাধ্যমের ক্ষমতা এতটাই যে, মিথ্যা কিংবা খণ্ডিত সত্যকে পুরো সত্যে রূপান্তরিত করতে পারে খুব সহজেই!
আবার ওয়ালস্ট্রিট কিংবা পল্টনের ময়দান যখন আন্দোলনের ভাষায় উচ্চকিত, তখন সে আন্দোলনের প্রতিটি ভাষা আমাদের কানে আসছে প্রতি মুহূর্তে এই গণমাধ্যমের কল্যাণেই। অর্থাৎ যদি বলি, উত্তর-আধুনিক যুগে গণমাধ্যম হচ্ছে গণআন্দোলন, বিষয়টি মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যেমন প্রয়োজন কথা বলার আগে ভেবে-চিন্তে কথা বলা, তেমনি গণমাধ্যমকর্মীদেরও রয়েছে ব্যাপক দায়িত্ব সঠিক তথ্য কিংবা বার্তা প্রচারে। যেমন, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথাই ধরা যাক। তিনি জানিয়েছেন, সাংসদরা সংসদে তার বক্তব্য নিয়ে যা বলেছেন, তিনি মোটেও এ ধরনের কোনো বক্তব্য দেননি। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী? দাঁড়াল যা, তাহলো গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পাটাতন তৈরি হয়েছে! অথবা অন্যভাবে বললে রাজনীতিবিদ যারা বিভিন্ন গণমাধ্যম না পড়ে, ক্রস চেক না করেই সংসদের মতো জায়গায় তা নিয়ে কথা বলে ফেলেছেন, তাদের গণমাধ্যম পাঠ করার বিষয়টিও একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে!
কেবল খবর প্রকাশই গণমাধ্যমের কাজ? এর বাইরে তার রয়েছে অনেক দায়িত্ব, সেসব দায়িত্ব যেন আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি সযতনে! খবর প্রকাশের মধ্য দিয়ে জনগণকে আলোকিত করা, আন্দোলিত করা, আনন্দ দেওয়া কিংবা দেশ-বিদেশের খবর দেওয়া_ সবই গণমাধ্যমের দায়িত্ব, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখলে মনে হয়, বিজ্ঞাপনের মাঝে মধ্যে একটু খবর প্রদান আর খবরভিত্তিক আলোচনা এবং নাটক দেখানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে তারা! চরম পুঁজিবাদী কিংবা নিওলিবারালিজমের যুগে টেলিভিশনের চিত্র এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক! এই স্বাভাবিকতার চিত্র দেশ-কাল-পাত্রভেদে কিছুটা ভিন্ন হলেও এই ভিন্নতার মাত্রা খুব বেশি হওয়ার সুযোগ নেই খোদ গণমাধ্যমের নিজ বৈশিষ্ট্যের কারণেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যও, যে বৈশিষ্ট্যের কারণে সারাক্ষণ চলে রেপ্লিকা তৈরির প্রতিযোগিতা। এই রেপ্লিকা তৈরির ধারা আমেরিকান আইডল-ইন্ডিয়ান আইডল হয়ে আমাদের দেশের দু-একটি চ্যানেলে প্রচার হওয়া পর্যন্ত সহনীয় বলা যেতে পারে; কিন্তু তা যদি দেদার দেশের সব টিভি চ্যানেল একযোগে এই প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান প্রচার করে, তাহলে দর্শকের মন পাওয়ার বদলে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
গত কয়েক বছর পড়ালেখার সুবাদে বিদেশে থাকার কারণে সেখানকার চ্যানেলগুলোর বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছি। আমেরিকার ৫০টি স্টেটের টিভি চ্যানেল প্রত্যেকটি থেকে প্রত্যেকটি ভিন্ন। অর্থাৎ স্টেটভেদে ওদের চ্যানেলও ভিন্ন। নিওলিবারালিজমের চরম রূপ এ মুহূর্তে আমেরিকার চেয়ে বিশ্বে আর কোথাও বেশি নয়, তবে তারা যদি পারে প্রতিটি চ্যানেলে ভিন্নতা আনতে, আমরা কেন
পারব না?
এবার দেশে এসে দেখলাম, অনেক নতুন চ্যানেল এসেছে! খুব আগ্রহ নিয়েই বসলাম নতুন-পুরনো সব চ্যানেল দেখার জন্য। কিন্তু রিমোট টিপলে হাতেগোনা দু'একটি ছাড়া কমবেশি সব একইরকম, উনিশ আর বিশের যে তফাত, সেরকম মনে হলো! একেবারেই স্বতন্ত্র ধারার কিংবা ভিন্নতা নিয়ে চ্যানেল এসেছে কি?
আমার অনেক দিনের স্বপ্ন শিশুদের একটি চ্যানেল থাকবে। কিন্তু কোথায়? সব যেন রেপ্লিকা তৈরির কারখানা! স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল, তার আর যেন কোনো দেখাই নেই। অথচ বাইরের দেশগুলোতে বাচ্চাদের চ্যানেলের প্রতি রয়েছে বিশেষ মনোযোগ। সেসব দেশের প্রতিটি নাগরিক বিশ্বাস করে, শেখার বয়স আসলে ওদেরই, তাই ওরা যেন সঠিক শিক্ষা পায়, তার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিই তাদের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত। জাতির এই ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার মতো কোনো ধনবান দায়িত্বশীল উদ্যোক্তা নেই আমাদের দেশে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কেউ যদি ভেবে থাকি, শিশুদের চ্যানেল খুলে কী লাভ? ব্যবসায়িক দিক থেকে লোকসানের খাতায় নাম লেখাই এর পরিণতি হবে, তাহলে বলব আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি! শিশুদের মনোজগৎ বোঝে তাদের মতো করে টিভি চ্যানেল এলে বাসায় বড়দের আর অন্য চ্যানেল দেখার সুযোগ মিলবে না, তা আমি হলফ করে বলে দিতে পারি। বাইরের দেশগুলোতে চাকরিজীবী বাবা-মায়ের প্রধান চিন্তার বিষয় 'বেবি সিটিং' নিয়ে। আর 'বেবি সিটিং'-এর কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই সহজ করে দেয় তাদের টিভি চ্যানেলগুলো। আমি আশা করছি, খুব শিগগির সমাজের কোনো এক বিত্তবান এবং চিত্তের অধিকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এগিয়ে আসবে শিশুদের জন্য চ্যানেল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। সেখানে প্রচারিত হবে পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্যাক্তির জীবন ইতিহাস, দেখানো হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিশুদের সাফল্য কাহিনী, আলোচিত হবে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের কথা, তৈরি হবে নিজ দেশের কার্টুন, যার সঙ্গে শিশু তার নিজ সমাজের মিল খুঁজে পাবে, প্রচার হবে শিশুদের নাটক, যেখানে থাকবে হাস্যরস, থাকবে আনন্দ, থাকবে সামাজিক সচেতনতামূলক বক্তব্য। গণমাধ্যমের যে ব্যাপকতা, তা কাজে লাগানোর একটি উপায় হতে পারে এ ধরনের চ্যানেল। একটি উদার, পরোপকারী, দায়িত্বববোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারে চ্যানেলটি!
এ তো গেল শিশুদের চ্যানেলের কথা, অন্য আরও অনেক বৈচিত্র্যময় চ্যানেলও হতে পারে। কেন কেবল নির্দিষ্ট ছাঁচেবন্দি কিছু প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক টক শো এবং খবরভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে চ্যানেল দেওয়ার সংস্কৃতি! প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যানেল এলেই তো হবে না, চাই নতুনত্ব, সঙ্গে দায়িত্বশীল উপস্থাপন। হতে পারে এমন একটি চ্যানেল, যার কাজ খবর প্রচারের পাশাপাশি কেবল ইতিহাস প্রচার করা। আমেরিকার ইতিহাস কেবল দুইশ' বছরের, তা প্রচারের জন্য রয়েছে কয়েকটি চ্যানেল, আর আমাদের ইতিহাস তো হাজার বছরের! এই চ্যানেলটিতে আমাদের অঞ্চলভেদে যে ইতিহাস ছড়িয়ে আছে, তাও তুলে আনতে পারে। বিটিভি আমাদের জাতীয় গণমাধ্যম, কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্য-পুস্তকের ইতিহাসের পরিবর্তনের মতোই বিটিভিতেও এই পরিবর্তন দেখি! ফলে জাতি কোনো সঠিক ইতিহাস জানতে পারে না। এই ইতিহাস পরিবর্তনের রাজনীতি বন্ধ করার পাশাপাশি সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কেউ এগিয়ে আসতে পারে একটি ইতিহাসভিত্তিক চ্যানেল চালুর মাধ্যমে। কারণ, গণমাধ্যমই পারে সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে আমাদের সামনে।
হতে পারে এমন আরও অনেক বৈচিত্র্যময় চ্যানেল। কিন্তু সব কথার শেষ কথা হলো গণমাধ্যমের বিশালতা এতটাই ব্যাপক যে, এই ব্যাপকতাকে কাজে লাগাতে হবে। তথ্য বিভ্রাট আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিতে পারে, তাই তথ্য প্রচারে আমাদের সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এই সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার সম্ভব গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে যদি গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিষ্পেষিত হন, তাহলে এই লজ্জা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বেড়েই চলছে! এই দমন-নিপীড়নের সংস্কৃতি বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। তা না হলে গণমাধ্যমের যে বৈশিষ্ট্য তা হতে সরে আসবে গণমাধ্যম, যা একটি জাতির জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে উঠবে।
রাশেদা রওনক খান :সহকারী অধ্যাপক
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যমকর্মী, বর্তমানে আমেরিকায় পিএইচডি অধ্যয়নরত
নিতে হবে
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর কে, এ প্রশ্ন এলে নিশ্চিতভাবেই 'গণমাধ্যমে'র কথা বলা হবে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও তাই স্বাভাবিকভাবেই খুব জটিল। জটিল বললাম এ কারণে যে, ক্ষমতাধর যে কোনো কিছুই খুব স্পর্শকাতর। গণমাধ্যমের ক্ষমতা কিংবা ব্যাপকতা কতটুকু তা বোঝা যায় যখন আমরা বাংলাদেশের কোনো গহিন গ্রামের কোনো এক বাড়িতে বসেই দেখতে পাই আমেরিকার হোয়াইট হাউসে এ মুহূর্তে কোন ফরেন পলিসি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে! কিংবা আফগান-আমেরিকার যুদ্ধের উদাহরণ টেনেই যদি বলি, দু'দেশের যুদ্ধ আসলে ততটুকুই আমাদের চোখে সত্য, যতটুকু আমরা সিএনএন-বিবিসির পর্দায় দেখেছি, এর বাইরের সত্য আমাদের অগোচরেই রয়ে গেল! এর বাইরে যেসব সত্য, তার বেশিরভাগ আড়ালেই থেকে যায়, যদি গণমাধ্যম তা আড়াল করে! অর্থাৎ আমার মূল কথা হলো, গণমাধ্যম হলো তাই, যার মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দেখি, বুঝি কিংবা জানি! এই বছরের ৯/১১-এ আমেরিকায় প্রকাশিত সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার ছবিগুলো একটি বার্তা বহন করছিল, তা হলো দল-মত-ধর্ম-জাত-শ্রেণী নির্বিশেষে তারা এক এবং অভিন্ন! তা বোঝানোর জন্য তাদের কাছে একটি ছবিই যথেষ্ট ছিল, যা আসলে একাত্মতাকেই প্রকাশ করে। ছবিটি ছিল 'বুশ-ক্লিনটন এবং ওবামা' এক সঙ্গে জনতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন সেদিনের নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতে। এই তিন ব্যক্তির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মিল-অমিল বিচার করলে তিন মেরুর হতে পারে কিন্তু গণমাধ্যমের বদৌলতে তারা সেদিন পৃথিবীর সামনে এক হয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ গণমাধ্যমের ক্ষমতা এতটাই যে, মিথ্যা কিংবা খণ্ডিত সত্যকে পুরো সত্যে রূপান্তরিত করতে পারে খুব সহজেই!
আবার ওয়ালস্ট্রিট কিংবা পল্টনের ময়দান যখন আন্দোলনের ভাষায় উচ্চকিত, তখন সে আন্দোলনের প্রতিটি ভাষা আমাদের কানে আসছে প্রতি মুহূর্তে এই গণমাধ্যমের কল্যাণেই। অর্থাৎ যদি বলি, উত্তর-আধুনিক যুগে গণমাধ্যম হচ্ছে গণআন্দোলন, বিষয়টি মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যেমন প্রয়োজন কথা বলার আগে ভেবে-চিন্তে কথা বলা, তেমনি গণমাধ্যমকর্মীদেরও রয়েছে ব্যাপক দায়িত্ব সঠিক তথ্য কিংবা বার্তা প্রচারে। যেমন, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথাই ধরা যাক। তিনি জানিয়েছেন, সাংসদরা সংসদে তার বক্তব্য নিয়ে যা বলেছেন, তিনি মোটেও এ ধরনের কোনো বক্তব্য দেননি। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী? দাঁড়াল যা, তাহলো গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পাটাতন তৈরি হয়েছে! অথবা অন্যভাবে বললে রাজনীতিবিদ যারা বিভিন্ন গণমাধ্যম না পড়ে, ক্রস চেক না করেই সংসদের মতো জায়গায় তা নিয়ে কথা বলে ফেলেছেন, তাদের গণমাধ্যম পাঠ করার বিষয়টিও একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে!
কেবল খবর প্রকাশই গণমাধ্যমের কাজ? এর বাইরে তার রয়েছে অনেক দায়িত্ব, সেসব দায়িত্ব যেন আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি সযতনে! খবর প্রকাশের মধ্য দিয়ে জনগণকে আলোকিত করা, আন্দোলিত করা, আনন্দ দেওয়া কিংবা দেশ-বিদেশের খবর দেওয়া_ সবই গণমাধ্যমের দায়িত্ব, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখলে মনে হয়, বিজ্ঞাপনের মাঝে মধ্যে একটু খবর প্রদান আর খবরভিত্তিক আলোচনা এবং নাটক দেখানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে তারা! চরম পুঁজিবাদী কিংবা নিওলিবারালিজমের যুগে টেলিভিশনের চিত্র এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক! এই স্বাভাবিকতার চিত্র দেশ-কাল-পাত্রভেদে কিছুটা ভিন্ন হলেও এই ভিন্নতার মাত্রা খুব বেশি হওয়ার সুযোগ নেই খোদ গণমাধ্যমের নিজ বৈশিষ্ট্যের কারণেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যও, যে বৈশিষ্ট্যের কারণে সারাক্ষণ চলে রেপ্লিকা তৈরির প্রতিযোগিতা। এই রেপ্লিকা তৈরির ধারা আমেরিকান আইডল-ইন্ডিয়ান আইডল হয়ে আমাদের দেশের দু-একটি চ্যানেলে প্রচার হওয়া পর্যন্ত সহনীয় বলা যেতে পারে; কিন্তু তা যদি দেদার দেশের সব টিভি চ্যানেল একযোগে এই প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান প্রচার করে, তাহলে দর্শকের মন পাওয়ার বদলে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
গত কয়েক বছর পড়ালেখার সুবাদে বিদেশে থাকার কারণে সেখানকার চ্যানেলগুলোর বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছি। আমেরিকার ৫০টি স্টেটের টিভি চ্যানেল প্রত্যেকটি থেকে প্রত্যেকটি ভিন্ন। অর্থাৎ স্টেটভেদে ওদের চ্যানেলও ভিন্ন। নিওলিবারালিজমের চরম রূপ এ মুহূর্তে আমেরিকার চেয়ে বিশ্বে আর কোথাও বেশি নয়, তবে তারা যদি পারে প্রতিটি চ্যানেলে ভিন্নতা আনতে, আমরা কেন
পারব না?
এবার দেশে এসে দেখলাম, অনেক নতুন চ্যানেল এসেছে! খুব আগ্রহ নিয়েই বসলাম নতুন-পুরনো সব চ্যানেল দেখার জন্য। কিন্তু রিমোট টিপলে হাতেগোনা দু'একটি ছাড়া কমবেশি সব একইরকম, উনিশ আর বিশের যে তফাত, সেরকম মনে হলো! একেবারেই স্বতন্ত্র ধারার কিংবা ভিন্নতা নিয়ে চ্যানেল এসেছে কি?
আমার অনেক দিনের স্বপ্ন শিশুদের একটি চ্যানেল থাকবে। কিন্তু কোথায়? সব যেন রেপ্লিকা তৈরির কারখানা! স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল, তার আর যেন কোনো দেখাই নেই। অথচ বাইরের দেশগুলোতে বাচ্চাদের চ্যানেলের প্রতি রয়েছে বিশেষ মনোযোগ। সেসব দেশের প্রতিটি নাগরিক বিশ্বাস করে, শেখার বয়স আসলে ওদেরই, তাই ওরা যেন সঠিক শিক্ষা পায়, তার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিই তাদের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত। জাতির এই ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার মতো কোনো ধনবান দায়িত্বশীল উদ্যোক্তা নেই আমাদের দেশে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কেউ যদি ভেবে থাকি, শিশুদের চ্যানেল খুলে কী লাভ? ব্যবসায়িক দিক থেকে লোকসানের খাতায় নাম লেখাই এর পরিণতি হবে, তাহলে বলব আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি! শিশুদের মনোজগৎ বোঝে তাদের মতো করে টিভি চ্যানেল এলে বাসায় বড়দের আর অন্য চ্যানেল দেখার সুযোগ মিলবে না, তা আমি হলফ করে বলে দিতে পারি। বাইরের দেশগুলোতে চাকরিজীবী বাবা-মায়ের প্রধান চিন্তার বিষয় 'বেবি সিটিং' নিয়ে। আর 'বেবি সিটিং'-এর কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই সহজ করে দেয় তাদের টিভি চ্যানেলগুলো। আমি আশা করছি, খুব শিগগির সমাজের কোনো এক বিত্তবান এবং চিত্তের অধিকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এগিয়ে আসবে শিশুদের জন্য চ্যানেল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। সেখানে প্রচারিত হবে পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্যাক্তির জীবন ইতিহাস, দেখানো হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিশুদের সাফল্য কাহিনী, আলোচিত হবে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের কথা, তৈরি হবে নিজ দেশের কার্টুন, যার সঙ্গে শিশু তার নিজ সমাজের মিল খুঁজে পাবে, প্রচার হবে শিশুদের নাটক, যেখানে থাকবে হাস্যরস, থাকবে আনন্দ, থাকবে সামাজিক সচেতনতামূলক বক্তব্য। গণমাধ্যমের যে ব্যাপকতা, তা কাজে লাগানোর একটি উপায় হতে পারে এ ধরনের চ্যানেল। একটি উদার, পরোপকারী, দায়িত্বববোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারে চ্যানেলটি!
এ তো গেল শিশুদের চ্যানেলের কথা, অন্য আরও অনেক বৈচিত্র্যময় চ্যানেলও হতে পারে। কেন কেবল নির্দিষ্ট ছাঁচেবন্দি কিছু প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক টক শো এবং খবরভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে চ্যানেল দেওয়ার সংস্কৃতি! প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যানেল এলেই তো হবে না, চাই নতুনত্ব, সঙ্গে দায়িত্বশীল উপস্থাপন। হতে পারে এমন একটি চ্যানেল, যার কাজ খবর প্রচারের পাশাপাশি কেবল ইতিহাস প্রচার করা। আমেরিকার ইতিহাস কেবল দুইশ' বছরের, তা প্রচারের জন্য রয়েছে কয়েকটি চ্যানেল, আর আমাদের ইতিহাস তো হাজার বছরের! এই চ্যানেলটিতে আমাদের অঞ্চলভেদে যে ইতিহাস ছড়িয়ে আছে, তাও তুলে আনতে পারে। বিটিভি আমাদের জাতীয় গণমাধ্যম, কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্য-পুস্তকের ইতিহাসের পরিবর্তনের মতোই বিটিভিতেও এই পরিবর্তন দেখি! ফলে জাতি কোনো সঠিক ইতিহাস জানতে পারে না। এই ইতিহাস পরিবর্তনের রাজনীতি বন্ধ করার পাশাপাশি সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কেউ এগিয়ে আসতে পারে একটি ইতিহাসভিত্তিক চ্যানেল চালুর মাধ্যমে। কারণ, গণমাধ্যমই পারে সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে আমাদের সামনে।
হতে পারে এমন আরও অনেক বৈচিত্র্যময় চ্যানেল। কিন্তু সব কথার শেষ কথা হলো গণমাধ্যমের বিশালতা এতটাই ব্যাপক যে, এই ব্যাপকতাকে কাজে লাগাতে হবে। তথ্য বিভ্রাট আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিতে পারে, তাই তথ্য প্রচারে আমাদের সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এই সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার সম্ভব গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে যদি গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিষ্পেষিত হন, তাহলে এই লজ্জা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বেড়েই চলছে! এই দমন-নিপীড়নের সংস্কৃতি বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। তা না হলে গণমাধ্যমের যে বৈশিষ্ট্য তা হতে সরে আসবে গণমাধ্যম, যা একটি জাতির জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে উঠবে।
রাশেদা রওনক খান :সহকারী অধ্যাপক
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যমকর্মী, বর্তমানে আমেরিকায় পিএইচডি অধ্যয়নরত
No comments