চার দিক-যতটা কাছে ততটাই দূরে by মোকারম হোসেন
টাঙ্গাইলের মধুপুর যে ময়মনসিংহের প্রান্তসীমায়, সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মানে, মধুপুর থেকে উঁকি দিলেই ময়মনসিংহ চোখে পড়ে। জানা কথা যে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যতটা কাছে, মধুপুর ততটাই দূরে। আমি গুনে গুনে দ্বিতীয়বারের মতো ভুলটি করলাম। আগেও একবার মধুপুরে গিয়েছিলাম।
তবু বোকার মতো দূরত্বটা বেমালুম ভুলে গেলাম। এমনিতে রাতভর ছিঁচকে বৃষ্টি। বৃষ্টির মতো এমন মধুর একটি বিষয়কে ছিঁচকে অপবাদ দেওয়ায় আমার ওপর খেপেছেন! না দিয়ে উপায় কী, বলুন। এমন একটা বর্ষা গেল বৃষ্টিছাড়া। আষাঢ়-শ্রাবণে তোমার দেখা নেই, আর ভাদ্র মাসে এসেছ জ্বালাতে। অসহ্য! সাতসকালেও আকাশের একই চেহারা। জল গড়াচ্ছে অবিরত। কিন্তু আমি বেরিয়ে পড়েছি। মনে মনে একবার দিনক্ষণ ঠিক করলে আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারি না। তা ছাড়া পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে মনে হলো, এই বৃষ্টি দুপুর অবধি থাকবে না।
মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে এসে মধুপুরের বাস খুঁজে নিতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। যাত্রা শুরু হলো। গাড়িতে আমরা মোট ১৯ জন যাত্রী। জার্নিটা ভালোই উপভোগ করছি। চারপাশে সুনসান নীরবতা। পাতার ডগা চুইয়ে শিশিরের মতো টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ছে। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, ব্যস্ততাও নেই। কিন্তু এত সুখ কি কপালে সয়! বিকেএসপি পার হয়ে থামল আমাদের গাড়ি। সামনে আরেকটি বাস দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম, কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা যাত্রী ওঠানোর জন্য দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ১৯ জনকে বিক্রি করে দেওয়া হলো সামনের বাসটিতে। আমরা আসামির মতো নীরবে গিয়ে বাসে ওঠলাম। আশ্চর্য! কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। ততক্ষণে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, ঢাকা থেকে মধুপুরে যাওয়ার কোনো ভালো গাড়ি নেই। এটা একটা লোকাল গাড়ি।
তিন-চার ঘণ্টার জার্নিতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগল। টাঙ্গাইল থেকে যখন আবার মধুপুরের দিকে যাত্রা শুরু হলো, তখন মনে হলো, এ পথ অনেক দীর্ঘ। জানালার পাশ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে ছোপ ছোপ সবুজ। কোথাও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। অবশেষে মধুপুর বাজারে এসে বাস থামল। এটাই কিন্তু শেষ গন্তব্য নয়, যেতে হবে আরও খানিকটা পথ। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। তবু আকাশের মন ভালো নেই। বাজারে দেখার মতো আছে আনারস আর কলার স্তূপ। এবার অগত্যা বিরক্তিকর বাহন টেম্পোতে চাপলাম। একটা অটোরিকশাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
টেম্পোতে ওঠার পর মনের ভেতরে একটা যুদ্ধ শুরু হলো। জলছত্র নামব কি নামব না। পুরোনো জায়গা, আগেও একবার এসেছিলাম। তখন থেকেই আউশনারা, জলছত্র নামগুলো মুখস্থ। বেশিক্ষণ যুদ্ধ করতে হলো না, জলছত্র আসতে না আসতেই আমার ‘ভেতরের আমি’ আমাকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল। এদিকেই আনারস আর কলার বাগান বেশি। দেখতে যদিও খুব ভালো লাগে, কিন্তু মনটা বেশ খারাপই হয়। এখানে সোনার টুকরো শালবন কেটেই এসব চাষবাস শুরু হয়েছে। কী আত্মঘাতী কাজ! মানুষ কীভাবে নিজেদের এমন সর্বনাশ করে! কোথায় সেই শালবন! কোথায় ভাওয়ালের গড়! বনের সবকিছু মানুষ গিলে খেয়েছে। এখানে একসময় মাইলের পর মাইল শুধু শালবনই ছিল। বনের সঙ্গে ছিল প্রাণবৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক ভারসাম্যও। আনোয়ারের কথা মনে পড়ল। প্রথমবার তাঁর আনারস-বাগানে গিয়েছিলাম। শুনেছিলাম তাঁর সুখ-দুঃখের কথা। শুধু সারের জোরেই তাঁরা কলা আর আনারস চাষ করেন। মাটি নিংড়ে সার দিয়ে তবেই আনারস-কলার চাষ। ফাঁকে ফাঁকে আবার আদা-হলুদও লাগানো হয়। এই নিরীহ মাটির জন্য খুব মায়া হলো। একসময় মনে হয়, এ মাটিতে আর আগাছাও জন্মানোর শক্তি থাকবে না। বাগানের সীমানা-লাগোয়া গৃহস্থদের ঘরবাড়ি। বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটতে থাকি। তবে এখানে তুলনামূলক বসতি কিছুটা কম। এখন আনারসের ভরা মৌসুম। খেতের পাশে আনারস রাখা হয়েছে স্তূপ করে। এখান থেকে ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যাবে। কখনো কখনো কাছের বাজারেও নিয়ে যাওয়া হয়।
আবার টেম্পো ভাড়া করলাম। এবার গন্তব্য টেলকি বাজার। বিশমাইল (স্থানের নাম) থেকে শুরু হয়েছে মাঝারি আকারের বিক্ষিপ্ত বন। বনের ভেতর দিয়েই পিচঢালা পথ। আশপাশে কোনো লোকালয় নেই। চালককে বললাম কোথাও না দাঁড়াতে। একটানে টেলকি বাজার। ছোট একটি বাজার। গোটা কয়েক দোকানঘর। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন সিরিন মারাক। যাব রবি খানের ভেষজবাগান দেখতে। তিনি ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারেননি। সে দায়িত্ব কাঁধে নিলেন সিরিন মারাক। বাজার ছাড়িয়ে খানিকটা পথ হেঁটে আমরা বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বিশাল বিশাল পাতার আজবীগাছ (স্থানীয় নাম)। হঠাৎ দেখলে চালতাপাতা বলে ভুল হতে পারে। গাছের গায়ে সুদৃশ্য নীলবনলতার ফুল ঝুলে আছে। অল্পস্বল্প শালগাছও আছে। অপরাজিতা, তুলসী, বাসক, ঘৃতকুমারী, তিসি, লজ্জাবতী, হাড়জোড়া—এসব দেখতে দেখতে একটি পরিপাটি আঙিনায় এসে দাঁড়ালাম। চারপাশের গাছগুলো বেশ গুছিয়ে লাগানো। সিরিন একের পর এক নাম বলে যাচ্ছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ভাতচিল চেনেন? পারুল ফুলকে গারোরা ভাতচিল নামে চেনে। তাঁর তাকানোর ভঙ্গি দেখে বুঝে ফেলি নামটি তিনি প্রথম শুনেছেন। আমি অবাক হই না। এখানে যখন নিবিড় বন ছিল, ছিলেন সিরিনদের পূর্বপুরুষেরা, তাঁরা হয়তো চিনতেন এই বনে ভাতচিল নামে একটি পুষ্পবৃক্ষ ছিল।
মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে এসে মধুপুরের বাস খুঁজে নিতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। যাত্রা শুরু হলো। গাড়িতে আমরা মোট ১৯ জন যাত্রী। জার্নিটা ভালোই উপভোগ করছি। চারপাশে সুনসান নীরবতা। পাতার ডগা চুইয়ে শিশিরের মতো টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ছে। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, ব্যস্ততাও নেই। কিন্তু এত সুখ কি কপালে সয়! বিকেএসপি পার হয়ে থামল আমাদের গাড়ি। সামনে আরেকটি বাস দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম, কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা যাত্রী ওঠানোর জন্য দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ১৯ জনকে বিক্রি করে দেওয়া হলো সামনের বাসটিতে। আমরা আসামির মতো নীরবে গিয়ে বাসে ওঠলাম। আশ্চর্য! কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। ততক্ষণে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, ঢাকা থেকে মধুপুরে যাওয়ার কোনো ভালো গাড়ি নেই। এটা একটা লোকাল গাড়ি।
তিন-চার ঘণ্টার জার্নিতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগল। টাঙ্গাইল থেকে যখন আবার মধুপুরের দিকে যাত্রা শুরু হলো, তখন মনে হলো, এ পথ অনেক দীর্ঘ। জানালার পাশ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে ছোপ ছোপ সবুজ। কোথাও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। অবশেষে মধুপুর বাজারে এসে বাস থামল। এটাই কিন্তু শেষ গন্তব্য নয়, যেতে হবে আরও খানিকটা পথ। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। তবু আকাশের মন ভালো নেই। বাজারে দেখার মতো আছে আনারস আর কলার স্তূপ। এবার অগত্যা বিরক্তিকর বাহন টেম্পোতে চাপলাম। একটা অটোরিকশাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
টেম্পোতে ওঠার পর মনের ভেতরে একটা যুদ্ধ শুরু হলো। জলছত্র নামব কি নামব না। পুরোনো জায়গা, আগেও একবার এসেছিলাম। তখন থেকেই আউশনারা, জলছত্র নামগুলো মুখস্থ। বেশিক্ষণ যুদ্ধ করতে হলো না, জলছত্র আসতে না আসতেই আমার ‘ভেতরের আমি’ আমাকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল। এদিকেই আনারস আর কলার বাগান বেশি। দেখতে যদিও খুব ভালো লাগে, কিন্তু মনটা বেশ খারাপই হয়। এখানে সোনার টুকরো শালবন কেটেই এসব চাষবাস শুরু হয়েছে। কী আত্মঘাতী কাজ! মানুষ কীভাবে নিজেদের এমন সর্বনাশ করে! কোথায় সেই শালবন! কোথায় ভাওয়ালের গড়! বনের সবকিছু মানুষ গিলে খেয়েছে। এখানে একসময় মাইলের পর মাইল শুধু শালবনই ছিল। বনের সঙ্গে ছিল প্রাণবৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক ভারসাম্যও। আনোয়ারের কথা মনে পড়ল। প্রথমবার তাঁর আনারস-বাগানে গিয়েছিলাম। শুনেছিলাম তাঁর সুখ-দুঃখের কথা। শুধু সারের জোরেই তাঁরা কলা আর আনারস চাষ করেন। মাটি নিংড়ে সার দিয়ে তবেই আনারস-কলার চাষ। ফাঁকে ফাঁকে আবার আদা-হলুদও লাগানো হয়। এই নিরীহ মাটির জন্য খুব মায়া হলো। একসময় মনে হয়, এ মাটিতে আর আগাছাও জন্মানোর শক্তি থাকবে না। বাগানের সীমানা-লাগোয়া গৃহস্থদের ঘরবাড়ি। বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটতে থাকি। তবে এখানে তুলনামূলক বসতি কিছুটা কম। এখন আনারসের ভরা মৌসুম। খেতের পাশে আনারস রাখা হয়েছে স্তূপ করে। এখান থেকে ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যাবে। কখনো কখনো কাছের বাজারেও নিয়ে যাওয়া হয়।
আবার টেম্পো ভাড়া করলাম। এবার গন্তব্য টেলকি বাজার। বিশমাইল (স্থানের নাম) থেকে শুরু হয়েছে মাঝারি আকারের বিক্ষিপ্ত বন। বনের ভেতর দিয়েই পিচঢালা পথ। আশপাশে কোনো লোকালয় নেই। চালককে বললাম কোথাও না দাঁড়াতে। একটানে টেলকি বাজার। ছোট একটি বাজার। গোটা কয়েক দোকানঘর। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন সিরিন মারাক। যাব রবি খানের ভেষজবাগান দেখতে। তিনি ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারেননি। সে দায়িত্ব কাঁধে নিলেন সিরিন মারাক। বাজার ছাড়িয়ে খানিকটা পথ হেঁটে আমরা বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বিশাল বিশাল পাতার আজবীগাছ (স্থানীয় নাম)। হঠাৎ দেখলে চালতাপাতা বলে ভুল হতে পারে। গাছের গায়ে সুদৃশ্য নীলবনলতার ফুল ঝুলে আছে। অল্পস্বল্প শালগাছও আছে। অপরাজিতা, তুলসী, বাসক, ঘৃতকুমারী, তিসি, লজ্জাবতী, হাড়জোড়া—এসব দেখতে দেখতে একটি পরিপাটি আঙিনায় এসে দাঁড়ালাম। চারপাশের গাছগুলো বেশ গুছিয়ে লাগানো। সিরিন একের পর এক নাম বলে যাচ্ছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ভাতচিল চেনেন? পারুল ফুলকে গারোরা ভাতচিল নামে চেনে। তাঁর তাকানোর ভঙ্গি দেখে বুঝে ফেলি নামটি তিনি প্রথম শুনেছেন। আমি অবাক হই না। এখানে যখন নিবিড় বন ছিল, ছিলেন সিরিনদের পূর্বপুরুষেরা, তাঁরা হয়তো চিনতেন এই বনে ভাতচিল নামে একটি পুষ্পবৃক্ষ ছিল।
No comments