গ্রামীণফোন প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার-খেলার সেই মিলনমেলা by রাজীব হাসান
ঠিকানা এখন তাঁর হুইলচেয়ার। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। মুখে বয়সের ছাপ। ঘোলা হয়ে এসেছে দৃষ্টি। দর্শকসারির আলো-আঁধারিতে নিশ্চুপ বসে ছিলেন কবির আহমেদ। দুই পাশের বড় পর্দায় তখন অন্য এক কবির আহমেদ; কখনো সাদা-কালো ফ্রেমে, কখনো রঙিন।
সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এল তাঁর বর্ণাঢ্য ক্রীড়াজীবনের আবেগময় বর্ণনা। হুইলচেয়ারে ঠেলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চের সামনে। উঁচু মঞ্চে ওঠার উপায় ছিল না। বাড়িয়ে ধরা মাইক্রোফোনেও কিছু বলতে পারেননি।
মঞ্চে না উঠেও অন্য এক উচ্চতায় উঠে গেলেন এককালের কৃতী এই ফুটবলার। কিছু না বলেও অশ্রুর প্লাবনে ভাসা দুই চোখ দিয়েই যেন বলে দিলেন অনেক কথা। তাঁর সম্মানে হল উপচে পড়া দর্শক তখন দাঁড়িয়ে। করতালি থামছেই না। সে এক আবেগময় দৃশ্য। ভাষার সাধ্য নেই সেই দৃশ্যকে আঁকে। ক্যামেরার সাধ্য নেই সেই দৃশ্যের জীবন্ত অনুভূতি তুলে আনে। কাল ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেন ছিল এমনই আবেগময়, কখনো হাস্যোজ্জ্বল, কখনো প্রাপ্তির আনন্দে উদ্ভাসিত, কখনো না-পাওয়ার বেদনায় ম্লান। কাল যে এখানে, এক ছাদের নিচে মিলিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সব খেলার মানুষ। গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার হয়ে উঠেছিল আবেগময় মিলনমেলায়।
অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ আলো ছিল সাকিব আল হাসানের ওপরই। গত দুই বছর অনুষ্ঠানটি হয়নি। ফলে এ বছর একসঙ্গে তিন বছরের সেরাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো পুরস্কার। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অবশ্যই বর্ষসেরাকে নিয়ে। তিন বছরের দুবারই বর্ষসেরা হয়েছেন সাকিব—২০০৯ আর ২০১১ সালে। মাঝখানের বছরটিতে, ২০১০ সালে ব্যক্তিগত সাফল্য দিয়ে সাকিবকে হারিয়ে দিয়েছেন গলফার সিদ্দিকুর রহমান। সাকিব অবশ্য সেই ‘দুঃখ’ কিছুটা পুষিয়ে নিয়েছেন ‘পাঠকের ভোটে সেরা’ বিভাগের পুরস্কারটি পেয়ে। সব মিলে তিনটি পুরস্কার উঠেছে তাঁরই হাতে।
দুটি পুরস্কার জিতেছেন সাকিবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু তামিম ইকবাল। ২০০৯ আর ২০১০-এর বর্ষসেরা রানারআপ হয়েছেন এই ওপেনার। দুটি পুরস্কার পেয়েছেন সিদ্দিকুরও। ২০১০-এর বর্ষসেরার পাশাপাশি ২০১১-এর রানারআপও হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে গলফকে পরিচিত করে তোলা এই তরুণ। বর্ষসেরা ও আজীবন সম্মাননা জয়ীরা ক্রেস্টের পাশাপাশি পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা। বর্ষসেরা রানারআপ, বর্ষসেরা নারী, উদীয়মান এবং পাঠকের ভোটে সেরা এরা প্রত্যেকে ক্রেস্টের পাশাপাশি পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার।
তিন বছরে সব মিলে ১৭টি পুরস্কার। এন মধ্যে আটটি পুরস্কারই জিতেছেন ক্রিকেটাররা। খুবই স্বাভাবিক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বেশি খেলছেন। সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল তাঁরাই। তবে গলফের পাশাপাশি ফুটবল, কারাতে, সাঁতার, শ্যুটিং, সাইক্লিং ও দাবার অঙ্গনের ক্রীড়াবিদেরাও পেয়েছেন এই পুরস্কার। দাবার ষাটোর্ধ্ব রানি রানী হামিদ যেমন পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা, তেমনি দাবারই মাত্র নয় বছর বয়সী ফাহাদ রহমান জিতেছে বর্ষসেরা উদীয়মানের পুরস্কার। অন্য আজীবন সম্মাননাটি পেয়েছেন সাবেক ফাস্ট বোলার, বাংলাদেশের ক্রিকেট কোচিংয়ের পথিকৃৎ আলতাফ হোসেন।
ভিন্ন ভিন্ন যুগের, বয়সের, ভিন্ন কালের, ভিন্ন খেলার সব ক্রীড়াবিদ এভাবেই কাল মিলেছেন একই স্রোতে। জন্ম নিয়েছে টুকরা টুকরা আবেগময় কিছু মুহূর্তের। মাত্র কদিন আগে মা হয়েছেন ববিতা খাতুন। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর এসে পৌঁছেছেন সেই কুষ্টিয়া থেকে। এমনিতেই কালকের রাজনৈতিক উত্তাপের কারণে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পথের ধকল সইতে পারবেন না বলে কোলের শিশুকে রেখে এসেছেন কুষ্টিয়াতেই। ২০০৯ সালের বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার জেতা এই সাঁতারু বললেন, ‘ছুটে এসেছি শুধু এই অনুষ্ঠানের টানেই।’ বাড়ি ফেরার পথে কোল অবশ্য খালি থাকছে না তাঁর। এবারই নতুন নকশায় বানানো ক্রেস্টটি যে থাকছে!
অদম্য মায়ের গল্প শোনালেন জ উ প্রু। ২০১০-এর বর্ষসেরা নারী পুরস্কার জেতা এই কারাতেকা ২০১০ সাফ গেমসে জিতেছেন দুটি সোনা। কিন্তু এর পেছনে যে অনেক ঘাম ঝরানোর গল্প আছে, আছে আত্মত্যাগ, সেটাই শোনালেন এই পাহাড়ি-মেয়ে, ‘সব সময় চেয়েছি দেশের পতাকার জন্য কিছু করি। এ জন্য মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে অনুশীলন করেছি। সাফের অনুশীলনের সময় আমার সঙ্গে ছিল আমার দেড় বছর বয়সী ছেলে। অনুশীলনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ওকে নিয়ে। কিন্তু সেই কষ্ট ভুলে গেছি লাল-সবুজ পতাকার জন্য।’
নারীরাই পারে সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করতে। এ কারণে নারীদের পক্ষেই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালেন দাবার কিংবদন্তি, ১৮ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ। ২০১০ সালের আজীবন সম্মাননার পুরস্কার হাতে নিয়ে বলেছেন, ‘দুজন নারী কিছুদিন আগে এভারেস্ট জয় করে প্রমাণ করে দিয়েছেন, প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দিলে নারীরাও পর্বতবাধা জয় করতে পারে।’ ২০০৯ সালে তামিমের পাশাপাশি বর্ষসেরা রানারআপ জেতা সাইক্লিস্ট আকাশী সুলতানা বলেছেন, ‘২৮ বছর ধরে খেলছি। ৪৮টি সোনা জিতেছি। আমার সময়ের অনেকেই এখন খেলা ছেড়ে দিয়ে কোচ হয়েছে। কিন্তু আমি এখনো খেলছি। আরও অনেক বছর খেলতে চাই। কুড়িতেই বুড়ি কথাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে চাই।’
বিচারকদের পক্ষ থেকে জুরি বোর্ডের প্রধান জালাল আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, ‘নিরপেক্ষতা আমাদের নির্বাচনের প্রথম ও প্রধান শর্ত। আগের পাঁচ বছরে আমাদের নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি। আমরা আত্মবিশ্বাসী, এবারের তিন বছরের নির্বাচন নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।’ পুরস্কারজয়ী, মাঠ কাঁপানো সাবেক তারকারা, আমন্ত্রিত অতিথি, বিভিন্ন খেলার আয়োজক-সংগঠকেরা একসুরে বলেছেন আরেকটি কথা। এই পুরস্কার থেকে যে প্রেরণা তাঁরা পান, সেটি মেলে না অন্য আর কিছুতেই। সাকিব তো এই পুরস্কারকে একরকম তুলনা করেছেন ফিফা বর্ষসেরার সঙ্গেও। সবার একটিই অনুরোধ, আর যেন দুই বছরের বিরতি না পড়ে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রও দুই বছরের বিরতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সামনে নিয়মিত এই আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ‘এই অনুষ্ঠান নিয়মিত করতে না পারার দায় অবশ্যই আমাদের। কিন্তু আমরা একরকম উপায়হীন ছিলাম। আমরা চাই, সব ধরনের খেলার মানুষেরা এই ক্রীড়াঙ্গনে থাকুন। সব খেলার সূচি মেলাতে গিয়েই আমাদের বিপদে পড়তে হয়। তবে আশা করছি, আগামী বছর থেকে আর এই বিরতি পড়বে না।’
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের সব খেলার ক্রীড়াবিদদের পাশে সব সময় থাকবে প্রথম আলো, ‘৪১ বছর আগে পুরো দেশ এক হয়েছিল। এর পর সারা দেশের মানুষকে এক পতাকাতলে নিয়ে আসতে পেরেছেন আমাদের ক্রীড়াবিদেরাই। ক্রিকেটসহ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের যেকোনো অর্জনের পর আমরা দেখেছি, সারা দেশের মানুষ কীভাবে রাস্তায় নেমে আসে, উল্লাস করে। তাঁরা পেরেছেন, তাঁরা আগামীতেও পারবেন। তাঁদের সঙ্গে আমরা আছি, থাকব।’
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী টোরে ইয়ানসেনও কথা দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের পাশে থাকার, ‘আমরা দীর্ঘদিন ক্রিকেটের সঙ্গে ছিলাম, ফুটবলেও। শুধু তা-ই নয়, আমরা বাংলাদেশের স্পেশাল অলিম্পিক দলের সঙ্গেও আছি, যারা স্পেশাল অলিম্পিকে অনেকগুলো সোনা এনে দিয়ে আমাদের গর্বে ভাসিয়েছে। বাংলাদেশে আমার সংক্ষিপ্ত এই অভিজ্ঞতাতেই আমি বুঝেছি, খেলা নিয়ে এ দেশের মানুষ কতটা রোমাঞ্চিত, উচ্ছ্বসিত। আমরা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সব সময়ই থাকব।’
একসময় অনুষ্ঠান শেষ হয়। মিলনমেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন দুই উপস্থাপক শারমিন লাকি ও হাবিবুল বাশার। সবাই ফেরার পথ ধরেন। ‘সবাই মিলি খেলার আনন্দে’—অনুষ্ঠানের এই সুর গুনগুন করে বাজে সবার মনে। এবার অবশ্য সুরের একটা ব্যাপারও ভালোমতোই ছিল এই অনুষ্ঠানে। গান আর নাচও যে যোগ হয়েছে প্রথমবারের মতো।
মঞ্চে না উঠেও অন্য এক উচ্চতায় উঠে গেলেন এককালের কৃতী এই ফুটবলার। কিছু না বলেও অশ্রুর প্লাবনে ভাসা দুই চোখ দিয়েই যেন বলে দিলেন অনেক কথা। তাঁর সম্মানে হল উপচে পড়া দর্শক তখন দাঁড়িয়ে। করতালি থামছেই না। সে এক আবেগময় দৃশ্য। ভাষার সাধ্য নেই সেই দৃশ্যকে আঁকে। ক্যামেরার সাধ্য নেই সেই দৃশ্যের জীবন্ত অনুভূতি তুলে আনে। কাল ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেন ছিল এমনই আবেগময়, কখনো হাস্যোজ্জ্বল, কখনো প্রাপ্তির আনন্দে উদ্ভাসিত, কখনো না-পাওয়ার বেদনায় ম্লান। কাল যে এখানে, এক ছাদের নিচে মিলিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সব খেলার মানুষ। গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার হয়ে উঠেছিল আবেগময় মিলনমেলায়।
অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ আলো ছিল সাকিব আল হাসানের ওপরই। গত দুই বছর অনুষ্ঠানটি হয়নি। ফলে এ বছর একসঙ্গে তিন বছরের সেরাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো পুরস্কার। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অবশ্যই বর্ষসেরাকে নিয়ে। তিন বছরের দুবারই বর্ষসেরা হয়েছেন সাকিব—২০০৯ আর ২০১১ সালে। মাঝখানের বছরটিতে, ২০১০ সালে ব্যক্তিগত সাফল্য দিয়ে সাকিবকে হারিয়ে দিয়েছেন গলফার সিদ্দিকুর রহমান। সাকিব অবশ্য সেই ‘দুঃখ’ কিছুটা পুষিয়ে নিয়েছেন ‘পাঠকের ভোটে সেরা’ বিভাগের পুরস্কারটি পেয়ে। সব মিলে তিনটি পুরস্কার উঠেছে তাঁরই হাতে।
দুটি পুরস্কার জিতেছেন সাকিবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু তামিম ইকবাল। ২০০৯ আর ২০১০-এর বর্ষসেরা রানারআপ হয়েছেন এই ওপেনার। দুটি পুরস্কার পেয়েছেন সিদ্দিকুরও। ২০১০-এর বর্ষসেরার পাশাপাশি ২০১১-এর রানারআপও হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে গলফকে পরিচিত করে তোলা এই তরুণ। বর্ষসেরা ও আজীবন সম্মাননা জয়ীরা ক্রেস্টের পাশাপাশি পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা। বর্ষসেরা রানারআপ, বর্ষসেরা নারী, উদীয়মান এবং পাঠকের ভোটে সেরা এরা প্রত্যেকে ক্রেস্টের পাশাপাশি পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার।
তিন বছরে সব মিলে ১৭টি পুরস্কার। এন মধ্যে আটটি পুরস্কারই জিতেছেন ক্রিকেটাররা। খুবই স্বাভাবিক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বেশি খেলছেন। সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল তাঁরাই। তবে গলফের পাশাপাশি ফুটবল, কারাতে, সাঁতার, শ্যুটিং, সাইক্লিং ও দাবার অঙ্গনের ক্রীড়াবিদেরাও পেয়েছেন এই পুরস্কার। দাবার ষাটোর্ধ্ব রানি রানী হামিদ যেমন পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা, তেমনি দাবারই মাত্র নয় বছর বয়সী ফাহাদ রহমান জিতেছে বর্ষসেরা উদীয়মানের পুরস্কার। অন্য আজীবন সম্মাননাটি পেয়েছেন সাবেক ফাস্ট বোলার, বাংলাদেশের ক্রিকেট কোচিংয়ের পথিকৃৎ আলতাফ হোসেন।
ভিন্ন ভিন্ন যুগের, বয়সের, ভিন্ন কালের, ভিন্ন খেলার সব ক্রীড়াবিদ এভাবেই কাল মিলেছেন একই স্রোতে। জন্ম নিয়েছে টুকরা টুকরা আবেগময় কিছু মুহূর্তের। মাত্র কদিন আগে মা হয়েছেন ববিতা খাতুন। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর এসে পৌঁছেছেন সেই কুষ্টিয়া থেকে। এমনিতেই কালকের রাজনৈতিক উত্তাপের কারণে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পথের ধকল সইতে পারবেন না বলে কোলের শিশুকে রেখে এসেছেন কুষ্টিয়াতেই। ২০০৯ সালের বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার জেতা এই সাঁতারু বললেন, ‘ছুটে এসেছি শুধু এই অনুষ্ঠানের টানেই।’ বাড়ি ফেরার পথে কোল অবশ্য খালি থাকছে না তাঁর। এবারই নতুন নকশায় বানানো ক্রেস্টটি যে থাকছে!
অদম্য মায়ের গল্প শোনালেন জ উ প্রু। ২০১০-এর বর্ষসেরা নারী পুরস্কার জেতা এই কারাতেকা ২০১০ সাফ গেমসে জিতেছেন দুটি সোনা। কিন্তু এর পেছনে যে অনেক ঘাম ঝরানোর গল্প আছে, আছে আত্মত্যাগ, সেটাই শোনালেন এই পাহাড়ি-মেয়ে, ‘সব সময় চেয়েছি দেশের পতাকার জন্য কিছু করি। এ জন্য মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে অনুশীলন করেছি। সাফের অনুশীলনের সময় আমার সঙ্গে ছিল আমার দেড় বছর বয়সী ছেলে। অনুশীলনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ওকে নিয়ে। কিন্তু সেই কষ্ট ভুলে গেছি লাল-সবুজ পতাকার জন্য।’
নারীরাই পারে সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করতে। এ কারণে নারীদের পক্ষেই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালেন দাবার কিংবদন্তি, ১৮ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ। ২০১০ সালের আজীবন সম্মাননার পুরস্কার হাতে নিয়ে বলেছেন, ‘দুজন নারী কিছুদিন আগে এভারেস্ট জয় করে প্রমাণ করে দিয়েছেন, প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দিলে নারীরাও পর্বতবাধা জয় করতে পারে।’ ২০০৯ সালে তামিমের পাশাপাশি বর্ষসেরা রানারআপ জেতা সাইক্লিস্ট আকাশী সুলতানা বলেছেন, ‘২৮ বছর ধরে খেলছি। ৪৮টি সোনা জিতেছি। আমার সময়ের অনেকেই এখন খেলা ছেড়ে দিয়ে কোচ হয়েছে। কিন্তু আমি এখনো খেলছি। আরও অনেক বছর খেলতে চাই। কুড়িতেই বুড়ি কথাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে চাই।’
বিচারকদের পক্ষ থেকে জুরি বোর্ডের প্রধান জালাল আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, ‘নিরপেক্ষতা আমাদের নির্বাচনের প্রথম ও প্রধান শর্ত। আগের পাঁচ বছরে আমাদের নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি। আমরা আত্মবিশ্বাসী, এবারের তিন বছরের নির্বাচন নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।’ পুরস্কারজয়ী, মাঠ কাঁপানো সাবেক তারকারা, আমন্ত্রিত অতিথি, বিভিন্ন খেলার আয়োজক-সংগঠকেরা একসুরে বলেছেন আরেকটি কথা। এই পুরস্কার থেকে যে প্রেরণা তাঁরা পান, সেটি মেলে না অন্য আর কিছুতেই। সাকিব তো এই পুরস্কারকে একরকম তুলনা করেছেন ফিফা বর্ষসেরার সঙ্গেও। সবার একটিই অনুরোধ, আর যেন দুই বছরের বিরতি না পড়ে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রও দুই বছরের বিরতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সামনে নিয়মিত এই আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ‘এই অনুষ্ঠান নিয়মিত করতে না পারার দায় অবশ্যই আমাদের। কিন্তু আমরা একরকম উপায়হীন ছিলাম। আমরা চাই, সব ধরনের খেলার মানুষেরা এই ক্রীড়াঙ্গনে থাকুন। সব খেলার সূচি মেলাতে গিয়েই আমাদের বিপদে পড়তে হয়। তবে আশা করছি, আগামী বছর থেকে আর এই বিরতি পড়বে না।’
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের সব খেলার ক্রীড়াবিদদের পাশে সব সময় থাকবে প্রথম আলো, ‘৪১ বছর আগে পুরো দেশ এক হয়েছিল। এর পর সারা দেশের মানুষকে এক পতাকাতলে নিয়ে আসতে পেরেছেন আমাদের ক্রীড়াবিদেরাই। ক্রিকেটসহ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের যেকোনো অর্জনের পর আমরা দেখেছি, সারা দেশের মানুষ কীভাবে রাস্তায় নেমে আসে, উল্লাস করে। তাঁরা পেরেছেন, তাঁরা আগামীতেও পারবেন। তাঁদের সঙ্গে আমরা আছি, থাকব।’
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী টোরে ইয়ানসেনও কথা দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের পাশে থাকার, ‘আমরা দীর্ঘদিন ক্রিকেটের সঙ্গে ছিলাম, ফুটবলেও। শুধু তা-ই নয়, আমরা বাংলাদেশের স্পেশাল অলিম্পিক দলের সঙ্গেও আছি, যারা স্পেশাল অলিম্পিকে অনেকগুলো সোনা এনে দিয়ে আমাদের গর্বে ভাসিয়েছে। বাংলাদেশে আমার সংক্ষিপ্ত এই অভিজ্ঞতাতেই আমি বুঝেছি, খেলা নিয়ে এ দেশের মানুষ কতটা রোমাঞ্চিত, উচ্ছ্বসিত। আমরা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সব সময়ই থাকব।’
একসময় অনুষ্ঠান শেষ হয়। মিলনমেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন দুই উপস্থাপক শারমিন লাকি ও হাবিবুল বাশার। সবাই ফেরার পথ ধরেন। ‘সবাই মিলি খেলার আনন্দে’—অনুষ্ঠানের এই সুর গুনগুন করে বাজে সবার মনে। এবার অবশ্য সুরের একটা ব্যাপারও ভালোমতোই ছিল এই অনুষ্ঠানে। গান আর নাচও যে যোগ হয়েছে প্রথমবারের মতো।
No comments