রাজস্ব আয়-আয়কর প্রদানে বৈষম্য হ্রাস জরুরি by আসজাদুল কিবরিয়া
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অর্থমূল্য প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে সর্বশেষ অর্থবছরে কত টাকা আয়কর দিয়েছেন, তাও জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। ৯ সেপ্টেম্বর অনলাইনে আয়করবিবরণী দাখিল কার্যক্রমের পরীক্ষামূলক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব তথ্য তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক ও শুভ দিক। এর মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী জনগণের প্রতি তাঁর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতিফলন ঘটালেন। তবে তাঁর সহকর্মীরা এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন কি না, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
তবে অর্থমন্ত্রীর প্রদত্ত আয়করের অঙ্কটি সামান্যই বলতে হবে। আয়করবিবরণীতে তিনি এক কোটি ২৭ লাখ ২৫ হাজার ৬৪৬ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব দিয়েছেন। এর মধ্যে তিন লাখ ৪৯ হাজার ৪৯৬ টাকার করযোগ্য আয়ের বিপরীতে তাঁর প্রদত্ত কর ১৯ হাজার ১৩০ টাকা।
তাতে অবশ্য আপাতত কিছু এসে-যায় না। অর্থমন্ত্রী যে নিয়মিত আয়কর দেন এবং তা প্রকাশে তাঁর যে কোনো কুণ্ঠা নেই, এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জনসাধারণকে আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকার যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ও নিচ্ছে, সেসবের নৈতিক ভিত্তিটা অনেক জোরালো হলো।
বস্তুত আয়কর প্রদানে অনেকের মধ্যেই অনীহা থাকে। চিন্তাটা এ রকম যে, নিজের পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ থেকে সরকারকে কেন ভাগ দেব। আয়করের প্রয়োজনীয়তা ও সুবিধা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব যেমন এই অনীহার কারণ, তেমনি কারণ হলো করবিষয়ক জটিলতা ও হয়রানি।
তবে নিবিড়ভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, কর ফাঁকি দিতে পারার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ নিহিত আছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কমবেশি সবাই সেই আনন্দ উপভোগের চেষ্টা করে থাকি। আর যদি সেটা হয় আয়কর, তাহলে তো কথাই নেই। আয় অনুসারে সঠিক কর দিয়ে নয়, বরং বিভিন্নভাবে ফাঁকফোকর গলে কমিয়ে কর দেওয়াই বুঝি বা কৃতিত্ব। এই সমাজে এমন অনেক মানুুষ আছেন, যাঁরা ১০০ টাকা আয়কর কমিয়ে ৫০ টাকা করার জন্য প্রয়োজনে আরও ৫০ টাকা ব্যয় করবেন, তবুু কিছুতেই রাষ্ট্রের কোষাগারে পুুরোটা আয়কর দেবেন না। এ জন্য নানা ধরনের যুক্তিরও অবতারণা করা হয়।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের কর প্রশাসন বহুলাংশে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু সচেতন নাগরিক হিসেবে এই অদক্ষতা ও দুর্নীতি হ্রাসে আমরা আমাদের ভূমিকাটুকু সঠিকভাবে পালন না করলে তো অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। আয়কর সঠিকভাবে দেওয়ার মাধ্যমেই সেই ভূমিকা পালিত হয়।
যাঁরা বেতনভোগী ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, তাঁদের আয়কর নির্ধারণ তুলনামূলকভাবে সহজ। তাঁদের আয়-উপার্জনের তথ্য অনেকটাই প্রকাশ্য। তাই তাঁদের পক্ষে ফাঁকি দেওয়াও কঠিন। কিন্তু যাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে বেতনভোগী নন ও আয়ের পরিধি বিস্তৃত, তাঁদের আয়কর নির্ধারণ তুলনামূলকভাবে কঠিন। এবং তাঁদের পক্ষেই আয়কর ফাঁকি দেওয়া সহজ। আয়করবিবরণীতে তাঁরা আয়ের যা তথ্য দেন এবং এই আয়ের সমর্থনে যে দলিলাদি উপস্থাপন করেন, সেটা কতটা সঠিক, তা একমাত্র আয়করদাতাদের পক্ষেই জানা সম্ভব। কর-কর্মকর্তারা এসব আয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই দেখা দেয় বিরোধ, ওঠে হয়রানির অভিযোগ।
আবার যিনি সঠিক বা পুরো আয় প্রদর্শন করতে চান, তাঁকে অনেক সময় নিরুৎসাহিত করা হয়। আয়কর কর্তৃপক্ষ নিরুসাহিত করে, সহকর্মী ও বন্ধুরা নিরুৎসাহিত করেন। দুর্নীতিগ্রস্ত আয়কর-কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত করে থাকেন নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য। ফলে এক ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় সঠিক আয়কর প্রদানে। বিষয়টি আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়েরও একটি প্রতিফলন।
সুতরাং, অর্থমন্ত্রী, জনসাধারণকে উৎসাহিত করার জন্য নিজের আয়করের বিষয়টি তুলে ধরলেই কাজ শেষ হলো না। মানুষজন যেন আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ পায়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এ জন্য একদিকে কর কর্তৃপক্ষকে দক্ষ হতে হবে, অন্যদিকে করযোগ্য সব আয়কে সঠিকভাবে করের আওতায় আনতে হবে। অযৌক্তিকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর ছাড় দিয়ে আয়করের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করলে তা দীর্ঘ মেয়াদে আর্থসামাজিক বৈষম্যকেই প্রকট করে।
এ প্রসঙ্গে শেয়ারবাজারে ব্যক্তির মূলধনি-আয়ের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। অর্থমন্ত্রী ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মূলধনি-মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে করারোপ করেছেন। কিন্তু অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিশ্রেণীর মূলধনি-মুনাফাকে, যার পক্ষে কোনোই যুক্তি নেই। শেয়ারবাজারে লাখ লাখ টাকা খাটিয়ে মুনাফা করবেন অথচ কোনো কর দেবেন না—এটা অত্যন্ত বৈষম্যমূলক। লভ্যাংশ থেকে আয় যদি করের আওতার বাইরে না থাকে, চাকরিজীবী ও বেতনভোগীরা যদি আয় অনুসারে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর দিতে পারেন, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য যদি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর দিতে হয়, তাহলে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়ে লাখ লাখ টাকা মূলধনি-মুনাফার আয় কেন করের বাইরে থাকবে? ভারত ও শ্রীলঙ্কায় শেয়ারবাজারের মূলধনি-মুনাফা আয়করের আওতার বাইরে নয়।
জমিজমা কেনাবেচাতেও মূলধনি-মুনাফা বা আয়ের ওপর কর আরোপ করা জরুরি। জমিজমা কেনাবেচা করে অনেকেই লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন। এমনিতেই সরকার-নির্ধারিত দরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দরে এসব জমি বেচাকেনা হলেও দলিলে সরকারি দরই উল্লেখ করা হচ্ছে। ফলে এ থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে অনেক কম। অন্যদিকে, এই প্রবণতা জমির মূল্যকে অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত করে তুলছে। জমি চলে গেছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মুষ্টিমেয় মানুষ বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়ে পড়েছে। এভাবে শেয়ারের মতো জমিও হয়ে পড়ছে ফাটকামূলক (স্পেকুলেটিভ) বিনিয়োগের বিষয়। অনেকে অর্থ ও সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে তুলছেন। এর ফলে প্রকট হচ্ছে আয়ের বৈষম্য।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে নিচের দিকে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই হার দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। অথচ পাকিস্তানে এই হার সাড়ে ১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৪ শতাংশ আর ভারতে ১২ শতাংশ। আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রতিবছর যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করে, তাতে (২০০৯ সালের প্রতিবেদন) এই হিসাব পাওয়া গেছে। এতে ১৭৯টি দেশের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাতের ধারাক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬০তম।
জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়করও অনেক কম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, এটি মাত্র ৭৩০ টাকা ৬৪ পয়সা। আবার প্রতি ১০০ টাকা আয়কর আহরণে সরকারের ব্যয় হয় ৭৬ পয়সা। এটিও খুব কম। আয়কর আহরণে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে। কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে এবং কর আদায় ও হিসাবনিকাশে কম্পিউটারভিত্তিক ইলেকট্রনিক পদ্ধতির বিস্তার ঘটানোর জন্য ব্যয় করতে হবে। ইতিমধ্যে অনলাইন ট্যাক্স ক্যালকুলেটরসহ কিছু আধুনিক পদ্ধতি চালু করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা ইতিবাচক। এগুলোকে অর্থবহ করতে হবে। জনসচেতনতা ও উৎসাহমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর পাশাপাশি আইনি কঠোরতাও সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
তবে অর্থমন্ত্রীর প্রদত্ত আয়করের অঙ্কটি সামান্যই বলতে হবে। আয়করবিবরণীতে তিনি এক কোটি ২৭ লাখ ২৫ হাজার ৬৪৬ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব দিয়েছেন। এর মধ্যে তিন লাখ ৪৯ হাজার ৪৯৬ টাকার করযোগ্য আয়ের বিপরীতে তাঁর প্রদত্ত কর ১৯ হাজার ১৩০ টাকা।
তাতে অবশ্য আপাতত কিছু এসে-যায় না। অর্থমন্ত্রী যে নিয়মিত আয়কর দেন এবং তা প্রকাশে তাঁর যে কোনো কুণ্ঠা নেই, এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জনসাধারণকে আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকার যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ও নিচ্ছে, সেসবের নৈতিক ভিত্তিটা অনেক জোরালো হলো।
বস্তুত আয়কর প্রদানে অনেকের মধ্যেই অনীহা থাকে। চিন্তাটা এ রকম যে, নিজের পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ থেকে সরকারকে কেন ভাগ দেব। আয়করের প্রয়োজনীয়তা ও সুবিধা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব যেমন এই অনীহার কারণ, তেমনি কারণ হলো করবিষয়ক জটিলতা ও হয়রানি।
তবে নিবিড়ভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, কর ফাঁকি দিতে পারার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ নিহিত আছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কমবেশি সবাই সেই আনন্দ উপভোগের চেষ্টা করে থাকি। আর যদি সেটা হয় আয়কর, তাহলে তো কথাই নেই। আয় অনুসারে সঠিক কর দিয়ে নয়, বরং বিভিন্নভাবে ফাঁকফোকর গলে কমিয়ে কর দেওয়াই বুঝি বা কৃতিত্ব। এই সমাজে এমন অনেক মানুুষ আছেন, যাঁরা ১০০ টাকা আয়কর কমিয়ে ৫০ টাকা করার জন্য প্রয়োজনে আরও ৫০ টাকা ব্যয় করবেন, তবুু কিছুতেই রাষ্ট্রের কোষাগারে পুুরোটা আয়কর দেবেন না। এ জন্য নানা ধরনের যুক্তিরও অবতারণা করা হয়।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের কর প্রশাসন বহুলাংশে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু সচেতন নাগরিক হিসেবে এই অদক্ষতা ও দুর্নীতি হ্রাসে আমরা আমাদের ভূমিকাটুকু সঠিকভাবে পালন না করলে তো অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। আয়কর সঠিকভাবে দেওয়ার মাধ্যমেই সেই ভূমিকা পালিত হয়।
যাঁরা বেতনভোগী ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, তাঁদের আয়কর নির্ধারণ তুলনামূলকভাবে সহজ। তাঁদের আয়-উপার্জনের তথ্য অনেকটাই প্রকাশ্য। তাই তাঁদের পক্ষে ফাঁকি দেওয়াও কঠিন। কিন্তু যাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে বেতনভোগী নন ও আয়ের পরিধি বিস্তৃত, তাঁদের আয়কর নির্ধারণ তুলনামূলকভাবে কঠিন। এবং তাঁদের পক্ষেই আয়কর ফাঁকি দেওয়া সহজ। আয়করবিবরণীতে তাঁরা আয়ের যা তথ্য দেন এবং এই আয়ের সমর্থনে যে দলিলাদি উপস্থাপন করেন, সেটা কতটা সঠিক, তা একমাত্র আয়করদাতাদের পক্ষেই জানা সম্ভব। কর-কর্মকর্তারা এসব আয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই দেখা দেয় বিরোধ, ওঠে হয়রানির অভিযোগ।
আবার যিনি সঠিক বা পুরো আয় প্রদর্শন করতে চান, তাঁকে অনেক সময় নিরুৎসাহিত করা হয়। আয়কর কর্তৃপক্ষ নিরুসাহিত করে, সহকর্মী ও বন্ধুরা নিরুৎসাহিত করেন। দুর্নীতিগ্রস্ত আয়কর-কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত করে থাকেন নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য। ফলে এক ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় সঠিক আয়কর প্রদানে। বিষয়টি আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়েরও একটি প্রতিফলন।
সুতরাং, অর্থমন্ত্রী, জনসাধারণকে উৎসাহিত করার জন্য নিজের আয়করের বিষয়টি তুলে ধরলেই কাজ শেষ হলো না। মানুষজন যেন আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ পায়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এ জন্য একদিকে কর কর্তৃপক্ষকে দক্ষ হতে হবে, অন্যদিকে করযোগ্য সব আয়কে সঠিকভাবে করের আওতায় আনতে হবে। অযৌক্তিকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর ছাড় দিয়ে আয়করের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করলে তা দীর্ঘ মেয়াদে আর্থসামাজিক বৈষম্যকেই প্রকট করে।
এ প্রসঙ্গে শেয়ারবাজারে ব্যক্তির মূলধনি-আয়ের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। অর্থমন্ত্রী ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মূলধনি-মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে করারোপ করেছেন। কিন্তু অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিশ্রেণীর মূলধনি-মুনাফাকে, যার পক্ষে কোনোই যুক্তি নেই। শেয়ারবাজারে লাখ লাখ টাকা খাটিয়ে মুনাফা করবেন অথচ কোনো কর দেবেন না—এটা অত্যন্ত বৈষম্যমূলক। লভ্যাংশ থেকে আয় যদি করের আওতার বাইরে না থাকে, চাকরিজীবী ও বেতনভোগীরা যদি আয় অনুসারে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর দিতে পারেন, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য যদি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর দিতে হয়, তাহলে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়ে লাখ লাখ টাকা মূলধনি-মুনাফার আয় কেন করের বাইরে থাকবে? ভারত ও শ্রীলঙ্কায় শেয়ারবাজারের মূলধনি-মুনাফা আয়করের আওতার বাইরে নয়।
জমিজমা কেনাবেচাতেও মূলধনি-মুনাফা বা আয়ের ওপর কর আরোপ করা জরুরি। জমিজমা কেনাবেচা করে অনেকেই লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন। এমনিতেই সরকার-নির্ধারিত দরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দরে এসব জমি বেচাকেনা হলেও দলিলে সরকারি দরই উল্লেখ করা হচ্ছে। ফলে এ থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে অনেক কম। অন্যদিকে, এই প্রবণতা জমির মূল্যকে অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত করে তুলছে। জমি চলে গেছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মুষ্টিমেয় মানুষ বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়ে পড়েছে। এভাবে শেয়ারের মতো জমিও হয়ে পড়ছে ফাটকামূলক (স্পেকুলেটিভ) বিনিয়োগের বিষয়। অনেকে অর্থ ও সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে তুলছেন। এর ফলে প্রকট হচ্ছে আয়ের বৈষম্য।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে নিচের দিকে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই হার দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। অথচ পাকিস্তানে এই হার সাড়ে ১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৪ শতাংশ আর ভারতে ১২ শতাংশ। আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রতিবছর যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করে, তাতে (২০০৯ সালের প্রতিবেদন) এই হিসাব পাওয়া গেছে। এতে ১৭৯টি দেশের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাতের ধারাক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬০তম।
জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়করও অনেক কম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, এটি মাত্র ৭৩০ টাকা ৬৪ পয়সা। আবার প্রতি ১০০ টাকা আয়কর আহরণে সরকারের ব্যয় হয় ৭৬ পয়সা। এটিও খুব কম। আয়কর আহরণে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে। কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে এবং কর আদায় ও হিসাবনিকাশে কম্পিউটারভিত্তিক ইলেকট্রনিক পদ্ধতির বিস্তার ঘটানোর জন্য ব্যয় করতে হবে। ইতিমধ্যে অনলাইন ট্যাক্স ক্যালকুলেটরসহ কিছু আধুনিক পদ্ধতি চালু করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা ইতিবাচক। এগুলোকে অর্থবহ করতে হবে। জনসচেতনতা ও উৎসাহমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর পাশাপাশি আইনি কঠোরতাও সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments