বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪২৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম সাহসী এক যোদ্ধা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে কর্ণফুলী নদীর তীরে কালুরঘাট। সেখানে উত্তর দিক থেকে হালদা এবং দক্ষিণ দিক থেকে সাঙ্গু নদী এসে মিলিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় এখানে ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও ছাত্র-যুবক সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। নদীর পশ্চিম পূর্ব তীরের একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন হারুন আহমেদ চৌধুরী।
চট্টগ্রাম শহর দখলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল অগ্রসর হয় কালুরঘাট অভিমুখে। ১১ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারি, মর্টার ও নৌবাহিনীর গান ফায়ারের সাপোর্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তুমুল আক্রমণ শুরু করে। কালুরঘাটের পশ্চিমে চট্টগ্রামের দিকে রাস্তা এবং আশপাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে থাকে।
কিন্তু পাকিস্তানি আক্রমণ ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত, ব্যাপক ও সুবিন্যস্ত। সম্মুখভাগে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। আক্রমণের তীব্রতায় তাঁরা পেছনে কালুরঘাট সেতুতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো খবর দিতে পারেননি।
এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয় সেতুর দিকে। হারুন আহমেদ চৌধুরী তাঁর দল নিয়ে ছিলেন সেতু এলাকায়। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের শিকার হন। একদম কাছাকাছি দূরত্বে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
হারুন আহমেদ চৌধুরী কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেতুর পশ্চিম প্রান্তে ডান দিকে ছিলেন। এ সময় তিনি প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তখন হঠাৎ করে তাঁর একেবারে সামনে শত্রু পাকিস্তানি সেনারা দৃশ্যমান হয়। ভয়াবহ এক পরিস্থিতি।
মুক্তিযোদ্ধা সেখানে মাত্র ৩৫ জন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা কমপক্ষে ১০০ জন। হারুন আহমেদ চৌধুরী বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি গুলি এসে লাগল তাঁর পেটে। সেতুর ওপর তিনি লুটিয়ে পড়েন।
হারুন আহমেদ চৌধুরী সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান। গোলাগুলির মধ্যেই তাঁর দুই সহযোদ্ধা—লেফটেন্যন্ট এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান (বীর বিক্রম, পরে মেজর এবং ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ও দণ্ডিত) ও মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী (বীর প্রতীক, তখন ছাত্র, পরে মেজর) তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নেন। এই কাজটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী প্রেষণে ইপিআরে ছিলেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টরের অধীন ১৭ নম্বর উইংয়ের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) সহ-উইং কমান্ডার হিসেবে। এর অবস্থান ছিল কাপ্তাইয়ে। ২৫ মার্চ রাতেই ১৭ উইংয়ে কর্মরত বাঙালি ইপিআর সদস্যরা তাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে কালুরঘাটে সমবেত হন।
কালুরঘাট যুদ্ধে আহত হারুন আহমেদ চৌধুরীকে প্রথমে পটিয়ায়, পরে কক্সবাজার জেলার উখিয়াতে নেওয়া হয়। এর পর তিনি মিয়ানমারে যান। মক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হারুন আহমেদ চৌধুরীকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫।
হারুন আহমেদ চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিলেট (আদিনাবাদ, চরখাই) জেলায়। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায় (বাড়ি ১৪২, লেন ৪, ইস্টার্ন রোড, মহাখালী ডিওএইচএস)। তাঁর বাবার নাম আবদুস সোবহান চৌধুরী। তিনি বিচারপতি ছিলেন। মা জাহানারা বেগম চৌধুরী। স্ত্রী নিঘাত হারুন। তাঁদের দুই মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
চট্টগ্রাম শহর দখলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল অগ্রসর হয় কালুরঘাট অভিমুখে। ১১ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারি, মর্টার ও নৌবাহিনীর গান ফায়ারের সাপোর্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তুমুল আক্রমণ শুরু করে। কালুরঘাটের পশ্চিমে চট্টগ্রামের দিকে রাস্তা এবং আশপাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে থাকে।
কিন্তু পাকিস্তানি আক্রমণ ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত, ব্যাপক ও সুবিন্যস্ত। সম্মুখভাগে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। আক্রমণের তীব্রতায় তাঁরা পেছনে কালুরঘাট সেতুতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো খবর দিতে পারেননি।
এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয় সেতুর দিকে। হারুন আহমেদ চৌধুরী তাঁর দল নিয়ে ছিলেন সেতু এলাকায়। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের শিকার হন। একদম কাছাকাছি দূরত্বে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
হারুন আহমেদ চৌধুরী কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেতুর পশ্চিম প্রান্তে ডান দিকে ছিলেন। এ সময় তিনি প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তখন হঠাৎ করে তাঁর একেবারে সামনে শত্রু পাকিস্তানি সেনারা দৃশ্যমান হয়। ভয়াবহ এক পরিস্থিতি।
মুক্তিযোদ্ধা সেখানে মাত্র ৩৫ জন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা কমপক্ষে ১০০ জন। হারুন আহমেদ চৌধুরী বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি গুলি এসে লাগল তাঁর পেটে। সেতুর ওপর তিনি লুটিয়ে পড়েন।
হারুন আহমেদ চৌধুরী সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান। গোলাগুলির মধ্যেই তাঁর দুই সহযোদ্ধা—লেফটেন্যন্ট এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান (বীর বিক্রম, পরে মেজর এবং ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ও দণ্ডিত) ও মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী (বীর প্রতীক, তখন ছাত্র, পরে মেজর) তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নেন। এই কাজটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী প্রেষণে ইপিআরে ছিলেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টরের অধীন ১৭ নম্বর উইংয়ের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) সহ-উইং কমান্ডার হিসেবে। এর অবস্থান ছিল কাপ্তাইয়ে। ২৫ মার্চ রাতেই ১৭ উইংয়ে কর্মরত বাঙালি ইপিআর সদস্যরা তাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে কালুরঘাটে সমবেত হন।
কালুরঘাট যুদ্ধে আহত হারুন আহমেদ চৌধুরীকে প্রথমে পটিয়ায়, পরে কক্সবাজার জেলার উখিয়াতে নেওয়া হয়। এর পর তিনি মিয়ানমারে যান। মক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হারুন আহমেদ চৌধুরীকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫।
হারুন আহমেদ চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিলেট (আদিনাবাদ, চরখাই) জেলায়। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায় (বাড়ি ১৪২, লেন ৪, ইস্টার্ন রোড, মহাখালী ডিওএইচএস)। তাঁর বাবার নাম আবদুস সোবহান চৌধুরী। তিনি বিচারপতি ছিলেন। মা জাহানারা বেগম চৌধুরী। স্ত্রী নিঘাত হারুন। তাঁদের দুই মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments