রোহিঙ্গা সংকট-৩-শিথিল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় শরণার্থীরা বেপরোয়া by মেহেদী হাসান ও রফিকুল ইসলাম

কক্সবাজারের নয়াপাড়া ও কুতুপালং শরণার্থী শিবির। সেখানে আশ্রয় পাওয়া মিয়ানমারের শরণার্থীদের সাহায্য হিসেবে পোশাক, চাল-ডাল, জ্বালানি থেকে শুরু করে সাবান পর্যন্ত দেওয়া হয় নিয়মিত। এর পরও শরণার্থীদের অনেকেই শিবিরের বাইরে গিয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন উপার্জনমুখী কাজে, ভাগ বসাচ্ছেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর


জীবন জীবিকায়, যেমনটি করছেন অনিবন্ধিত অসংখ্য অনুপ্রবেশকারী। কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং শিবিরের কাছে বখতিয়ার বাজার এলাকায় দোকান খুলে বসেছেন অনেক শরণার্থী। জীবিকার প্রয়োজনে তাঁরা কক্সবাজার তো বটেই, সারা দেশে বিচরণ করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছেন শ্রমিক হিসেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নিয়ম হচ্ছে কোনো বহিরাগতকে শিবিরে ঢুকতে হলে অনুমতি নিতে হবে, তেমনি শরণার্থীদেরও বিনা অনুমতিতে শিবিরের বাইরে যাওয়া চলবে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শরণার্থী শিবিরকে সংরক্ষিত রাখার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে শিবিরের চারপাশই খোলা।
শরণার্থীরা ইচ্ছে মতো ঢুকছে, বেরুচ্ছে। গত সপ্তাহে কুতুপালং শিবির এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মিয়ানমারের শরণার্থীরা যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, শরণার্থী পরিবারের সদস্যরা কার্ড দেখিয়ে ত্রাণ নিয়ে থাকেন। কেউ বাইরে আছে কি না বা অন্যত্র চলে গিয়েছে, তা তৎক্ষণাৎ জানার কোনো উপায় নেই। গোপনে খবর পেয়ে বা সন্দেহের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাউকে ডেকে পাঠালে দেখা যায়, তাদের আসতে আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। যখন কোনো শরণার্থীর খোঁজ করা হয় তখন সে অন্যত্র কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলেও তাদের স্বজনরা মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে আসে। ফলে তেমন কিছুই আর করার থাকে না কর্তৃপক্ষের।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, শরণার্থীদের অনেকেই আশপাশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা শরণার্থীর সংখ্যা গত জানুয়ারি মাসে ছিল ২৯ হাজার ৮৭০ জন। তারা সবাই ইউএনএইচসিআরের ত্রাণ ও সাহায্য পেয়ে আসছে। চলতি বছর শেষে এ সংখ্যা ৩০ হাজার ৭৮০ জনে উঠবে বলে ইউএনএইচসিআর ধারণা করছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ চাইলেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে পারে না। তাদের স্বেচ্ছায় যেতে হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় শিবিরের তুলনামূলক নিরাপদ জীবন ছেড়ে কেউ মিয়ানমারে ফিরে যাবেন এমনটা মনে হচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, শরণার্থীদের কেউ কেউ এমন আশায় আছেন জাতিসংঘ তাদেরকে বাংলাদেশে সম্ভব না হলে তৃতীয় কোনো দেশে রাখার ব্যবস্থা করবে। এ জন্যই তাঁরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের অব্যাহত কূটনৈতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার তার প্রকৃত নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিকতার কথা জানিয়েছে। কিন্তু ওই নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়াটাও বেশ জটিল।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করেন- এমন একটি দাতা সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা ব্যক্তিরা তাদের আসল ঠিকানা দেয় না। তারা যে ঠিকানা দেয় দেখা যায় তার কোনো অস্তিত্বই নেই। ফলে মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ইনচার্জ ও সহকারী কমিশনার জালাল উদ্দিন জানান, স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় রোহিঙ্গাদের অনেকে ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টও পেয়েছে। শরণার্থী শিবিরে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর অগোচরে কিছু ঘটলেও সঠিক তথ্যের অভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তিনি মনে করেন মিয়ানমারের পরিস্থিতি শান্ত হলে এবং ইউএনএইচসিআর ও সরকার যৌথভাবে প্রত্যাবাসন কমিটি গ্রহণ করলে শরণার্থী প্রত্যাবাসন করা সহজ হবে। এমনিতে এত সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যেতে আগ্রহী নয় বলে তিনি জানান।
শিবিরে অবস্থানরত দুই হাজারেরও বেশি শরণার্থীকে মিয়ানমার সরকার ইতিমধ্যে তার নাগরিক বলে স্বীকার করেছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, তাঁদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত। এতে অপর শরণার্থী ও শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত নন এমন অনুপ্রবেশকারীরা বার্তা পাবেন যে এ দেশে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবেন না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের সময় ঘোষিত ১৫ দফা যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার জেলার নয়াপাড়া ও কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত নিবন্ধিত শরণার্থীসহ এবং বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী বিপুল সংখ্যক অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রত্যাবাসন ইস্যু তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ সমস্যার আশু সমাধান দীর্ঘদিনের এ ইস্যুটির পরিসমাপ্তি ঘটাবে এবং পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
শরণার্থী শিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউএনএইচসিআরের ছত্রচ্ছায়ায় কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আর্থিকভাবে লাভবান স্থানীয় কতিপয় সুবিধাভোগী, নামে ও বেনামে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গ্রুপের সদস্য ও সমর্থকরা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে শরণার্থীদের প্ররোচিত করছে।
কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ফিরোজ সালাহ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরের সময় দেশটির সরকার আড়াই হাজার শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিছু রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাদের জমি, সহায়-সম্বল ফিরে পাওয়ার দাবি জানাচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'মিয়ানমারে কর্মরত ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত রাখাইন প্রদেশে সমউন্নয়ন ঘটিয়ে সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ চালানো হচ্ছে।'

No comments

Powered by Blogger.