নরসিংদীতে ডিবির ওসিসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা-নিন্দা-ধিক্কার, তিন পুলিশ কর্তাকে হাইকোর্টে তলব

নরসিংদী জজ আদালত প্রাঙ্গণে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইমান আলী শেখকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিভিন্ন মহল নিন্দা এবং ধিক্কার জানিয়েছে। বিচারকরা সভা করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনায় কারা দায়ী তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়।


এ ছাড়া ঘটনায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
নরসিংদীর ওই ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। ২০ জুন তাঁদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাঁদের তলব করা হয়েছে তাঁরা হলেন- নরসিংদীর জেলা পুলিশ সুপার, সদর থানার ওসি এবং ডিবি পুলিশের ওসি। বিচারপতি ফরিদ আহাম্মদ ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চ গতকাল সোমবার তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করে আদেশ দেন। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে এ আদেশ দেওয়া হয়। এদিকে বিচারক লাঞ্ছনার ঘটনায় নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ওসিসহ ১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গতকাল স্থানীয় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত এ মামলা গ্রহণ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
রবিবার নরসিংদী জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের হাতে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইমান আলী শেখ লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মহিউদ্দিন শামীম একটি রিট আবেদন করেন। তাঁর পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম সাইফুদ্দিন। আদালত তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করেন। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, নরসিংদী সদর থানার ওসি ও ডিবি পুলিশের ওসিকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি : বিচারক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় গতকাল আইন মন্ত্রণালয় এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-২) আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হককে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে। এ বিষয়ে গতকাল আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।
গত ১০ জুন নরসিংদী জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের হাতে নির্যাতনের শিকার হন বিচারক মো. ইমান আলী শেখ। এ ঘটনায় পুলিশের নায়েক মো. আবদুস সালাম, নায়েক রুহুল আমীন ও কনস্টেবল কলিমউল্লাহকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোকলেসুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
ঢাকায় বিচারকদের সভা : নরসিংদীতে বিচারক লাঞ্ছিত হওয়ার পর বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ঢাকায় জরুরি সভা ডাকে। গতকাল বিকেল ৫টায় ঢাকা জজশিপের জগন্নাথ-সোহেল স্মৃতি মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মজিদ সভাপতিত্ব করেন। সভায় ঢাকার বিচারক ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ সোহেল আহম্মেদের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য দেন ঢাকার জেলা জজ মো. আবদুল মজিদ, ঢাকার বিশেষ জজ মো. মোজাম্মেল হোসেন, ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) নুর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সরকার, ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ প্রণব চক্রবর্তী, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম বিকাশ কুমার সাহা, সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. শাহাজাহান সাজু, বিচারক মশিউর রহমান প্রমুখ।
সভায় বক্তারা বিচারকের ওপর হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করেন। একই সঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান। নরসিংদী আদালতে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার জরুরি নিষ্পত্তিও দাবি করেছেন তাঁরা।
বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা : বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, একজন বিচারকের ওপর পুলিশের নগ্ন হামলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বিচারকের ওপর পুলিশের হামলা প্রমাণ করে, বর্তমানে পুলিশ কতটা বেপরোয়া ও আইনের প্রতি ভ্রুকুটি প্রদর্শন করছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার কমিশন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি করেছে আসক। আসকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আইনজীবী, সাংবাদিক ও বিচারকদের প্রতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ। এটা উদ্বেগের বিষয়। এ ধরনের ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয় বলে মনে করে আসক।
ঢাকার কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুলাল মিত্র ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক অ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্যের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বিচারক লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করেছেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ পুরো বিচার বিভাগকে অসম্মান করেছে। ঘটনার পর পুলিশের দেওয়া বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাঁরা বলেন, জড়িত পুলিশ সদস্যদের পক্ষে যারা সাফাই গেয়েছে তাদেরও শাস্তি দিতে হবে।
ওসিসহ ১২ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা : নরসিংদী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বিচারক ইমান আলী শেখকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় গতকাল মুখ্য বিচার বিভাগীয় হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহার আদালতে নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ওসিসহ ১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির রাকিবুল হাসানের করা এই মামলায় ওসি মামুনুর রশিদ, নায়েক আবদুস সালাম, রুহুল আমিন ও কনস্টেবল কলিম উল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত আসামি করা হয় আরো আট পুলিশ সদস্যকে। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম শিহাবুল ইসলামকে ঘটনার তদন্ত করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ঘটনায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন। ঘটনা তদন্তে পুলিশ সুপারের গঠিত তিন সদস্যের কমিটি থেকে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধির নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে কমিটির সদস্য করা হয়েছে কোর্ট পরিদর্শক আবদুল কাইয়ূমকে।
জেলা আইনজীবী সমিতির প্রতিবাদ সভা : এদিকে বিচারককে মারপিটের ঘটনায় জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে প্রতিবাদ সভা করেন আইনজীবীরা। এর পর তাঁরা দায়ী পুলিশদের গ্রেপ্তার ও চাকরি থেকে বহিষ্কারের দাবিতে আদালতপাড়ায় একটি বিক্ষোভ মিছিল ও কর্মবিরতি পালন করেন। দাবি না মানা হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় সভায়।
সমিতির সভাপতি আবদুল বাছেদ ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী এ এম বদরুদ্দোজা জিল্লু, জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, এস এ হাদী, শওকত আলী পাঠান, আবুল কালাম আজাদ, শাহজাহান মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ শিকদার প্রমুখ।
সভা শেষে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাছেদ ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ সব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করছে। তারা জেলহাজতে মানুষকে হত্যা করে, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর নির্যাতন করে। এমনকি এবার বিচারকদের ওপর নগ্ন হামলা চালিয়েছে। আমরা অবিলম্বে এর বিচার চাই। এই বিচার না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি পালন করব।

No comments

Powered by Blogger.