দুর্যোগ মোকাবিলা-জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের নারীর অভিযোজন by মাহবুবা নাসরীন
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি ব্যাপক আলোচিত বিষয়। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমান সময়ে নারী ও শিশুদের নিজ নিজ স্বার্থ এবং জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ইস্যুগুলো পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
অধিকাংশ নারী এবং পরিবেশ সাহিত্যে নারীদের পরিবেশবান্ধব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এ কারণে জলবায়ু রক্ষার যেকোনো উদ্যোগ নারীর জন্য শুভ উদ্যোগ বলে বিবেচিত হয়। প্রতিবেশ নারীবাদ বর্তমান সময়ের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এর মূল কথা হচ্ছে, নারীরা পুরুষের চেয়ে প্রকৃতির বেশি ঘনিষ্ঠ। প্রকৃতিকে শোষণের ঘটনা বিরল নয়, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, প্রকৃতিতে কোনো স্তর বিভাজন নেই। সবাই সমান। মানুষের সমাজব্যবস্থা, শ্রেণীকাঠামো নিজেদের সুবিধার্থে সমাজে এবং পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম স্তর সৃষ্টি করেছে। তবুও নারীর সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনো শোষণ নেই।
প্রতিবেশকেন্দ্রিকতায় জনসংখ্যা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে অধিক জনসংখ্যার ফলে পরিবেশদূষণ কিংবা অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর এই অধিক জনসংখ্যার ঋণাত্মক চাপকে উল্লেখ করা যেতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ থেকে উত্তরে কিংবা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো কর্মসূচির সাফাই গাওয়া হয়েছে। এর ফলে আমরা ‘পৃথিবীই আগে’ ধরনের ম্যালথাসীয় আন্দোলন প্রত্যক্ষ করি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে তৃতীয় বিশ্বেও অধিকাংশ দেশকে নারীর প্রজননস্বাস্থ্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে হয়েছে, যা নারীর স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে হরণ করেছে এবং প্রতিবেশ বিনষ্টের একটি কারণ হিসেবে বর্তমানে বিবেচিত হচ্ছে। নারীর জৈবিক, প্রজনন, মানসিক ও সামাজিক অবস্থান নারীকে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ করেছে। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে এসব তথাকথিত উন্নয়ন মডেলকে সামনে রেখে বস্তুত নারীকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করার চেষ্টা চলছে। এটা শেষ পর্যন্ত পরিবেশ ধ্বংস করছে, যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব প্রতিবেশের ওপর পড়তে বাধ্য।
দক্ষিণ এশিয়াতে নারী, পরিবেশ ও উন্নয়ন (WED) ধারণাটি এসেছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা উন্নয়নে নারী, পরিবেশ সংরক্ষণে নারী এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। WED-এর আলোচনায় বনায়ন, কৃষি, সেচ ও পানিব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় উন্নয়নের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন, গ্রামীণ নারী গৃহস্থালির কাজে বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তেমনি শহরে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, রাসায়নিক শব্দদূষণ ও অন্যান্য দূষণে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। উন্নয়নশীল বিশ্বে নারীরা পরিবেশের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। তাই পরিবেশ রক্ষায় এবং পরিবেশ সমস্যায় তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের নারীদের দেখা হয় পরিবেশ-ব্যবস্থাপক হিসেবে; কারণ পরিবেশসংক্রান্ত জ্ঞান তাদেরই বেশি এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা অপেক্ষাকৃত হিসাবি ও মিতব্যয়ী। অথচ বেশির ভাগ দেশেই প্রাকৃতিক সম্পদে নারীর আইনগত অধিকার নেই।
বাংলাদেশের নারী ও সুবিধাবঞ্চিতদের কার্বন নির্গমনের হার শূন্য, অথচ আজ তারাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কাছে সবচেয়ে অসহায়। প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত দরিদ্র পরিবারের সদস্য হিসেবে। দুর্যোগকালে নারী ও শিশুদের অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে তারা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলো হচ্ছে: আশ্রয়ের সমস্যা, খাদ্যসংকট, পানীয় জলের সংকট, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাব, পরিবারের সদস্যদের বেশি সময় দেওয়ার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া, নিরাপত্তাহীনতা, ওষুধ সংগ্রহ দুরূহ, কর্মস্থলে যাওয়ার ঝুঁকি, আশ্রয়কেন্দ্রে একই ঘরে অপরিচিত লোকের সঙ্গে বসবাস ইত্যাদি। এ ছাড়া অপরিচিত লোকজনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার, ত্রাণ সংগ্রহে পুরুষদের সঙ্গে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো এবং পুরুষদের শক্তির কারণে ত্রাণ না নিয়েই লাইন থেকে চলে আসতে বাধ্য হওয়া নারীর সংখ্যাও কম নয়। প্রকৃতপক্ষে, ত্রাণসাহায্য সব সময় দুর্যোগ-আক্রান্ত মানুষের কাছে পৌঁছায় না। উপরন্তু, শিশুদের খাদ্য জোগানে নারীদের নাজুকতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির জন্য উপযুক্ত খাদ্য বা ত্রাণ সরবরাহ নিতান্তই অপ্রতুল। দুর্যোগের ফলে নারীদের শ্রমবিভাজন প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ, দুর্যোগের সময় নারীকে নিজ নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তা ও খাবার জোগানের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়। দুর্যোগকালে গর্ভবতী ও কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য-সুবিধা ব্যাপক হারে হ্রাস পায়।
একজন মা হিসেবে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে অসহায়। যেকোনো দুর্যোগে বাসস্থান, খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত, নিরাপত্তা ইত্যাদি সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় নারীকেই। কাজের সন্ধানে পুরুষ যখন বাইরে চলে যায়, তখন গৃহভিত্তিক কাজ ও সন্তানের দায়িত্ব নারীকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়। এ কথা সর্বজনবিদিত, উপর্যুপরি দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই ঘটে থাকে এবং তার সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে নারীকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা প্রথমে শিশুর বইগুলো রক্ষার চেষ্টা করে। নিজের নাজুকতাকে উপেক্ষা করে শিশুর খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য নারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এমনও দেখা গেছে, নিজে পানিতে দাঁড়িয়ে শিশুটিকে মাচার ওপর রেখে কোমরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। এ ছাড়া ধান ও মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন আয়মূলক কাজ করে নারীরা অভিযোজন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিযোজনের জন্য গ্রামীণ নারীরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ফসল উত্তোলন-পরবর্তী বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কার্যক্রম, গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, শাক-সবজি চাষ, হস্তশিল্প ইত্যাদি আয়মূলক কাজ করে থাকে। নারীদের এসব কর্মকাণ্ডে শিশু বিশেষত, মেয়েশিশুরা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। হতদরিদ্র নারীরা পুরুষের পাশাপাশি রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রমে নিজেদের শ্রম দিয়ে থাকে। খাদ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার (বিক্রি) করে।
প্রতিকূল পরিবেশে নারীরা তাদের দায়িত্ব পালনের পরও পরিবারের সদস্যদের দুর্যোগজনিত সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। নারীদের নেওয়া এসব অভিযোজন-কৌশল অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দৃষ্টির আড়ালে থাকে এবং স্বীকৃতি পায় না। কোপেনহেগেনে যে অ্যাকর্ড হয়েছে, সেখানে স্থানীয় অভিযোজন-কৌশলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগের সঙ্গে টিকে থাকার এসব কৌশল অবলম্বনে পরিবারের নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট নাজুকতা মোকাবিলায় যে আর্থিক প্রতিশ্রুতি আন্তর্জাতিকভাবে রয়েছে, তার সুষম বণ্টন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নারী ও শিশুর জন্য অধিক বরাদ্দ সরকারি সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় নারী ও শিশুদের প্রাধান্যের ভিত্তিতেই থাকা প্রয়োজন।
সম্প্রতি নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী দুর্যোগাক্রান্ত ও প্রান্তিক নারীদের নারী উন্নয়ন নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার পর্যায়ে রয়েছে। এভাবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে বিশেষ আইন তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্ভোগে এবং দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে নারীস্বার্থ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
মাহবুবা নাসরীন: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিবেশকেন্দ্রিকতায় জনসংখ্যা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে অধিক জনসংখ্যার ফলে পরিবেশদূষণ কিংবা অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর এই অধিক জনসংখ্যার ঋণাত্মক চাপকে উল্লেখ করা যেতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ থেকে উত্তরে কিংবা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো কর্মসূচির সাফাই গাওয়া হয়েছে। এর ফলে আমরা ‘পৃথিবীই আগে’ ধরনের ম্যালথাসীয় আন্দোলন প্রত্যক্ষ করি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে তৃতীয় বিশ্বেও অধিকাংশ দেশকে নারীর প্রজননস্বাস্থ্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে হয়েছে, যা নারীর স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে হরণ করেছে এবং প্রতিবেশ বিনষ্টের একটি কারণ হিসেবে বর্তমানে বিবেচিত হচ্ছে। নারীর জৈবিক, প্রজনন, মানসিক ও সামাজিক অবস্থান নারীকে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ করেছে। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে এসব তথাকথিত উন্নয়ন মডেলকে সামনে রেখে বস্তুত নারীকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করার চেষ্টা চলছে। এটা শেষ পর্যন্ত পরিবেশ ধ্বংস করছে, যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব প্রতিবেশের ওপর পড়তে বাধ্য।
দক্ষিণ এশিয়াতে নারী, পরিবেশ ও উন্নয়ন (WED) ধারণাটি এসেছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা উন্নয়নে নারী, পরিবেশ সংরক্ষণে নারী এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। WED-এর আলোচনায় বনায়ন, কৃষি, সেচ ও পানিব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় উন্নয়নের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন, গ্রামীণ নারী গৃহস্থালির কাজে বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তেমনি শহরে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, রাসায়নিক শব্দদূষণ ও অন্যান্য দূষণে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। উন্নয়নশীল বিশ্বে নারীরা পরিবেশের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। তাই পরিবেশ রক্ষায় এবং পরিবেশ সমস্যায় তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের নারীদের দেখা হয় পরিবেশ-ব্যবস্থাপক হিসেবে; কারণ পরিবেশসংক্রান্ত জ্ঞান তাদেরই বেশি এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা অপেক্ষাকৃত হিসাবি ও মিতব্যয়ী। অথচ বেশির ভাগ দেশেই প্রাকৃতিক সম্পদে নারীর আইনগত অধিকার নেই।
বাংলাদেশের নারী ও সুবিধাবঞ্চিতদের কার্বন নির্গমনের হার শূন্য, অথচ আজ তারাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কাছে সবচেয়ে অসহায়। প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত দরিদ্র পরিবারের সদস্য হিসেবে। দুর্যোগকালে নারী ও শিশুদের অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে তারা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলো হচ্ছে: আশ্রয়ের সমস্যা, খাদ্যসংকট, পানীয় জলের সংকট, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাব, পরিবারের সদস্যদের বেশি সময় দেওয়ার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া, নিরাপত্তাহীনতা, ওষুধ সংগ্রহ দুরূহ, কর্মস্থলে যাওয়ার ঝুঁকি, আশ্রয়কেন্দ্রে একই ঘরে অপরিচিত লোকের সঙ্গে বসবাস ইত্যাদি। এ ছাড়া অপরিচিত লোকজনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার, ত্রাণ সংগ্রহে পুরুষদের সঙ্গে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো এবং পুরুষদের শক্তির কারণে ত্রাণ না নিয়েই লাইন থেকে চলে আসতে বাধ্য হওয়া নারীর সংখ্যাও কম নয়। প্রকৃতপক্ষে, ত্রাণসাহায্য সব সময় দুর্যোগ-আক্রান্ত মানুষের কাছে পৌঁছায় না। উপরন্তু, শিশুদের খাদ্য জোগানে নারীদের নাজুকতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির জন্য উপযুক্ত খাদ্য বা ত্রাণ সরবরাহ নিতান্তই অপ্রতুল। দুর্যোগের ফলে নারীদের শ্রমবিভাজন প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ, দুর্যোগের সময় নারীকে নিজ নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তা ও খাবার জোগানের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়। দুর্যোগকালে গর্ভবতী ও কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য-সুবিধা ব্যাপক হারে হ্রাস পায়।
একজন মা হিসেবে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে অসহায়। যেকোনো দুর্যোগে বাসস্থান, খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত, নিরাপত্তা ইত্যাদি সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় নারীকেই। কাজের সন্ধানে পুরুষ যখন বাইরে চলে যায়, তখন গৃহভিত্তিক কাজ ও সন্তানের দায়িত্ব নারীকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়। এ কথা সর্বজনবিদিত, উপর্যুপরি দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই ঘটে থাকে এবং তার সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে নারীকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা প্রথমে শিশুর বইগুলো রক্ষার চেষ্টা করে। নিজের নাজুকতাকে উপেক্ষা করে শিশুর খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য নারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এমনও দেখা গেছে, নিজে পানিতে দাঁড়িয়ে শিশুটিকে মাচার ওপর রেখে কোমরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। এ ছাড়া ধান ও মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন আয়মূলক কাজ করে নারীরা অভিযোজন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিযোজনের জন্য গ্রামীণ নারীরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ফসল উত্তোলন-পরবর্তী বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কার্যক্রম, গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, শাক-সবজি চাষ, হস্তশিল্প ইত্যাদি আয়মূলক কাজ করে থাকে। নারীদের এসব কর্মকাণ্ডে শিশু বিশেষত, মেয়েশিশুরা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। হতদরিদ্র নারীরা পুরুষের পাশাপাশি রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রমে নিজেদের শ্রম দিয়ে থাকে। খাদ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার (বিক্রি) করে।
প্রতিকূল পরিবেশে নারীরা তাদের দায়িত্ব পালনের পরও পরিবারের সদস্যদের দুর্যোগজনিত সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। নারীদের নেওয়া এসব অভিযোজন-কৌশল অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দৃষ্টির আড়ালে থাকে এবং স্বীকৃতি পায় না। কোপেনহেগেনে যে অ্যাকর্ড হয়েছে, সেখানে স্থানীয় অভিযোজন-কৌশলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগের সঙ্গে টিকে থাকার এসব কৌশল অবলম্বনে পরিবারের নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট নাজুকতা মোকাবিলায় যে আর্থিক প্রতিশ্রুতি আন্তর্জাতিকভাবে রয়েছে, তার সুষম বণ্টন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নারী ও শিশুর জন্য অধিক বরাদ্দ সরকারি সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় নারী ও শিশুদের প্রাধান্যের ভিত্তিতেই থাকা প্রয়োজন।
সম্প্রতি নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী দুর্যোগাক্রান্ত ও প্রান্তিক নারীদের নারী উন্নয়ন নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার পর্যায়ে রয়েছে। এভাবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে বিশেষ আইন তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্ভোগে এবং দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে নারীস্বার্থ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
মাহবুবা নাসরীন: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments